খেলা

স্মৃতির রিজার্ভ বেঞ্চ (প্রথম কিস্তি) : মহেশচন্দ্র ব্যানার্জী

অলর্ক বড়াল July 31, 2020 at 6:16 am খেলা

আধুনিক দুনিয়ায় খেলা বরাবরই সবচেয়ে গ্ল্যামারাস জিনিসগুলোর একটা।
সব খেলা নয় অবশ্যই। এ দুনিয়ায় কোনও কোনও খেলা ধর্মের সমার্থক হয়ে যায়, আর কোনও কোনও খেলার কুশীলবেরা স্বীকৃতি না পেয়েই চলে যান - চুপিচুপি, একা একা। তবে স্মৃতি জিনিসটা বড় প্রতারক। আজকের গ্ল্যামার নিমেষে ফিকে হয়ে যায় আগামীর ধুলো পড়ে। একটু পুরোনো হয়ে গেলেই প্রায় সব স্মৃতি এক পংক্তিতে বসে যায়। ভুস করে তাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে যায় আমাদের বাস। স্মৃতি খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে রিনিউ করতে করতে ডিলিট করতে থাকে পুরোনো জিনিসপত্র। এই তথ্যবিপ্লবের যুগে কিছুদিন আগের ঘটনাই যেন মনে হয় কত শতাব্দী পিছনে ফেলে আসা - সেপিয়া টোনে ছোপানো মনকেমন। বেহালার আগেও তো অনেক গর্ব করার মতো গল্প ছিল বাঙালির খেলায়। পঙ্কজ রায়েরও আগে ছিল কিছু গল্প। এমনকী কিছু গল্প ছিল সেই সাদা- কালো যুগের গোবরবাবুরও আগে। আমরা খবর রাখি না।
কেমন হয় যদি ধুলো- টুলো ঝেড়ে তুলে আনা যায় পুরোনো দিনের এমন কয়েকজন বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াব্যক্তিত্বের গল্প?

সিলি পয়েন্টের এই নতুন সিরিজে সেই চেষ্টাই ধরা থাকল, খেলা-প্রেমীদের জন্য। আজ প্রথম কিস্তিতে দাবাড়ু মহেশচন্দ্র ব্যানার্জী।


দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সূর্যশেখর গাঙ্গুলি, সন্দীপন চন্দ প্রমুখ বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টারদের সাম্প্রতিককালের সাফল্য ও সুনামের ভিড়ে হারিয়ে গেছেন দাবাড়ু মহেশচন্দ্র ব্যানার্জী। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার দাবা-আগ্রহী সাহেবমহলে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন ব্রিটিশ দাবা মহলে ‘দ্য ব্রাহ্মিণ’ নামে পরিচিত এই খেলোয়াড়ের নামটাই হয়তো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেত না, যদি না স্কটিশ দাবাড়ু জন কোচরেন লিখে যেতেন তাঁর কথা। জন কোচরেন মহেশচন্দ্রের সঙ্গে ১৮৪৮ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে নিয়মিত দাবা খেলেন ও সেই ম্যাচগুলির কথা লিখে যান লন্ডন চেস ম্যাগাজিনের পাতায়।

কোচরেন ছিলেন সেই সময়ের ইংল্যান্ড তথা বিশ্বের প্রথম সারির দাবা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন। তিনি হাওয়ার্ড স্টনটন ব্যতীত সকল ইংরেজ দাবাড়ুকে হারানোর পর দাবার বোর্ডে সমকক্ষ একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য মুখিয়ে ছিলেন। এই সময়ই ক্যালকাটা চেস ক্লাবের এক সদস্য মফস্বলের এক ব্রাহ্মণের খবর পান যাঁকে তখনও পর্যন্ত দাবা খেলায় কেউ হারাতে পারেননি। সেই সদস্য মহেশচন্দ্রের সঙ্গে দাবা খেলায় হেরে যান এবং তাঁকে কলকাতায় কোচরেনের কাছে নিয়ে আসেন। যদিও কোচরেনের বিপরীতে মহেশচন্দ্র হেরে যান, তবুও কোচরেন তাঁর খেলায় যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ক্যালকাটা চেস ক্লাবের বেতনভোগী সহকারী রূপে নিযুক্ত করেন। কলকাতায় আসার সময় মহেশচন্দ্রের বয়স ছিল পঞ্চাশের কোঠায় এবং তিনি দাবা খেলার ইউরোপীয় নিয়মকানুন সম্বন্ধে একেবারেই অবগত ছিলেন না। কিন্তু ভারতীয় দাবা খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। ভারতীয় দাবার নিয়মানুসারে খেলার শুরুতেই সৈন্য একেবারে দুই ঘর যেত না, সৈন্যরা বিপরীত পক্ষের যে ঘরে পৌঁছাত, সেই ঘরেরই নির্দিষ্ট ঘুঁটিকে পুনর্জীবিত করত। সেই দেশীয় খেলায় বর্তমানের ‘ক্যাসলিং’-এর নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না বরং কিস্তিবিহীন রাজা খেলা চলাকালীন একবারের জন্য মন্ত্রীর ন্যায় বিচরণ করতে পারত। কোচরেন ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে মহেশচন্দ্র দাবার পশ্চিমী রীতিনীতি সম্বন্ধে অবগত হন এবং দ্রুত এতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৮৫১ সালে ‘চেস প্লেয়ারস্‌ ক্রনিক্যাল’-এ কোচরেন বনাম মহেশচন্দ্রের অনেকগুলি খেলার খবর ছাপা হয়।

এর ঠিক আগের বছরেই উপরোক্ত পত্রিকাকে লেখা এক চিঠিতে ক্যালকাটা চেস ক্লাবের এক সদস্য জন কোচরেনকে উদ্ধৃত করে বলেন – “একমাত্র খেলোয়াড় যিনি কোচরেন সাহেবের সমকক্ষ হতে পারেন তিনি মহেশচন্দ্র ব্যানার্জী নামের এক ব্রাহ্মণ। এই সুযোগ্য ব্যক্তি সম্পর্কে স্বয়ং কোচরেন বলেছেন যে, তিনি (মহেশচন্দ্র) তাঁর (কোচরেনের) দেখা দাবা-খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম যিনি অসাধারণ সহজাত প্রতিভার অধিকারী”। মহেশচন্দ্র তাঁর খেলায় কৌশলগত সুবিধাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিচক্ষণতার সঙ্গে দাবার ঘুঁটি ব্যবহার করতেন যা এই খেলার পরিভাষায় ‘স্যাক্রিফাইস’ নামে পরিচিত। এছাড়াও তিনি দাবার বোর্ডে খেলার শুরুতে সৈন্যের পরিবর্তে দুরতিক্রম্য ঘুঁটির সাহায্যে বোর্ডের মধ্যাংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করতেন – এহেন খেলার ধরন দাবার পরিভাষায় ‘ফিয়াঞ্চেত্তো ওপেনিং’ নামে পরিচিত । মহেশচন্দ্রের এই খেলাকে জন কোচরেন ‘ইন্ডিয়ান ডিফেন্স’ নামে অভিহিত করেন। ভারতীয় দাবাখেলার রীতিতে পারদর্শী মহেশচন্দ্রের আন্তর্জাতিক দাবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অবদান রয়েছে – তিনিই সর্বপ্রথম কোচরেনের বিরুদ্ধে ১৮৫৫ সালে এক বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান । এই প্রক্রিয়াটি প্রায় সাতষট্টি বছর পর ১৯২২-এ ভিয়েনাতে আর্নস্ট গ্রুনফেল্ড তাঁর প্রতিপক্ষ আলেখাইনের বিপক্ষে ব্যবহার করেন। মহেশচন্দ্র বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও তাঁর এই বিশেষ কৌশল 'গ্রুনফেল্ড ডিফেন্স’ নামে দাবার ইতিহাসে জনপ্রিয় হয়।



কভার পোস্টার : অর্পণ দাস

#

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

6

Unique Visitors

219109