স্মরণে বীণা দাস : স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিস্মৃতপ্রায় বীরাঙ্গনা
“দেশের কোনও ডাকেই সাড়া দেব না, মুক্তি সংগ্রামের নির্বাক দর্শক হয়ে থাকব…তাহলে কি হবে এই অসাড় মিথ্যা কেতাবী শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে!”
দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য বিদ্রোহের অগ্নিময়ী ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি মেয়েটি। রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া শিক্ষাকে তার নিতান্ত মিথ্যে, অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছু সময় পরে হলেও, স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন মেয়েরা, বিশেষত ছাত্রীরা। তখন বেথুন কলেজ মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আঁতুড়ঘর। রাজানুগত অধ্যক্ষের কড়া অনুশাসন সত্ত্বেও একের পর এক ছাত্রী এগিয়ে আসছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। প্রীতিলতার বিপ্লবপ্রচেষ্টার সার্থক উত্তরসূরি ছিলেন এই বিদ্যুৎশিখা। পরবর্তীতে ইতিহাস তাঁকে চিনে নেবে বীণা দাস নামে।
বীণা ছাত্রাবস্থাতেই জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় আন্দোলনে। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বিরোধী হরতালে বেথুন কলেজের মেয়েদের নেতৃত্ব দেন তিনি। বেথুন স্কুল এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে প্রায় সমস্ত ক্লাসে গিয়ে হরতালে যোগ দেওয়ার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানান এবং তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হরতালের দিন বেথুন স্কুল ও কলেজে ছাত্রীসংখ্যা ছিল শূন্য। এই বিদ্রোহে সেদিন ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নিজের অবস্থান ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন বীণা, তাই গভর্নমেন্ট কলেজে বিপ্লবী কার্যকলাপের চিন্তা বাতুলতা জেনেও তিনি পিছিয়ে আসেননি।
বেথুন কলেজে পড়াকালীনই বীণা সশস্ত্র বিপ্লবে যুক্ত হন। সহপাঠী কমলা দাশগুপ্তের সাহায্যে রিভলভার জোগাড় করেন। ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে সমাবর্তনের অনুষ্ঠান চলাকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা করতে গুলি চালান। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ও জ্যাকসন বেঁচে যান, বড়োলাটকে খুনের চেষ্টার অপরাধে বীণার নয় বছরের জেল হয়। সাত বছর পর তিনি কারামুক্ত হন। কারামুক্তির পরে বীণা জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং মহাত্মা গান্ধির অনুগামী হন। সেই সময়ে কংগ্রেসের সব কাজের সঙ্গেই বীণা জড়িত ছিলেন, পরে তিনি কলকাতা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকও হন। কংগ্রেসের সম্পাদক থাকাকালীন ১৯৪২ সালে আবার তিন বছরের জন্য বীণা কারারুদ্ধ হন।
বীণার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জীবন, সশস্ত্র সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা, কারাবাসকালীন অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী 'শৃঙ্খল ঝংকার' গ্রন্থে। এই আত্মজীবনী গ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। এটি বীণা লিখেছিলেন ছত্রিশ বছর বয়েসে। তাঁর লেখায় সমষ্টিগত বিপ্লবপ্রয়াসের চেয়েও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর অন্তর্জীবন। গভর্নরকে হত্যা করার তাঁর যে প্রয়াস, তিনি তাঁর উল্লেখমাত্র করেছেন, বরং বীণার এই বিপ্লবী পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় কমলা দাশগুপ্তের আত্মজীবনী 'রক্তের অক্ষরে'তে। বীণার আত্মজীবনীর একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে তাঁর কারাবাসকালীন অভিজ্ঞতা। বীণা নিজে ছিলেন রাজবন্দী, কিন্তু জেলের অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে তিনি খুব সাধারণভাবে মিশেছিলেন। মানসিক ভারসাম্যহীন একজন ফিরিঙ্গি মহিলা, স্বল্পমেয়াদের কারাবন্দী দুর্গি, স্বামীকে হত্যা করা শহরজান - এদের সকলের কথাই অত্যন্ত সংবেদনশীল ভঙ্গিতে বীণা লিখেছেন তাঁর আত্মকাহিনিতে।
আমৃত্যু বীণা দাস নানারকম আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলেই তাঁর লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। নোয়াখালির কুখ্যাত দাঙ্গার পর বীণা সেখানে গিয়েছিলেন দাঙ্গায় আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করতে। দাঙ্গাবিধ্বস্ত নমঃশূদ্র অধ্যুষিত গ্রামবাসীদের দুরবস্থা, বিশেষত মেয়েদের ওপর হওয়া বীভৎস অত্যাচার তাঁকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। বীণা এখানে প্রধানত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এই নোয়াখালি পর্বের বিস্তারিত বিবরণও পাওয়া যায় বীণার আত্মজীবনীতে।
আত্মকথায় বীণা মূলত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কথা বলেছেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তার বিশ্লেষণ করেছেন। তা সত্ত্বেও কোথাও কোথাও তাঁর সৌন্দর্যপ্রিয়, সংবেদনশীল, ভাবুক মনের পরিচয় মেলে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপ আর চিন্তাভাবনায় তাঁর কলম আটকে থাকেনি। অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তাঁর যে উচ্ছ্বাস, তা শুধু পর্যটকের বিস্ময়াবিষ্ট দর্শন নয়, ইতিহাসবোধও স্পষ্ট তার মধ্যে। স্বাধীনতা সম্পর্কে যে ক্ষোভ ও নৈরাশ্য তৈরি হয়েছিল তাঁর মনে, তাও তিনি বলেছেন অকুণ্ঠভাবে। বিপ্লবী,শহিদদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণকে তাঁর অসম্মান বলে মনে হয়েছিল। তিনি নিজেও সরকারের থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রামীর পেনশন নেননি। সারা জীবন কাজ করে গেছেন কোনও প্রত্যাশা না রেখে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, জরুরি অবস্থার সময়ে প্রতিবাদ করেছেন, মরিচঝাঁপিতে স্বর তুলেছেন পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আমৃত্যু দেশের ও সমাজের জন্য প্রাণপাত করা মানুষটি জীবনে একদিনের জন্যও আদর্শচ্যুত হননি। শুধুমাত্র মহিলা কারাকাহিনি রচয়িতা বা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবেই নয়, আত্মবিসর্জনে দ্বিধাহীন একজন সংগ্রামী ও সংবেদী মানুষ হিসেবে তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজন আজও ফুরিয়ে যায়নি।
#বীণা দাস #স্বাধীনতা সংগ্রামী #মন্দিরা চৌধুরী #স্মরণ #ফিচার