Rams - একটি নির্বান্ধব ভেড়াদের ছবি
সাদা ধপধপে হিমেল ব্যাকড্রপে নির্জন উল্কির মতো জেগে থাকা পিচরাস্তা ধরে শ্লথ বুলডোজার তার মুঠোর মধ্যে প্রায় নিথর একটা শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চালক অতিশয় বৃদ্ধ তবে ঠিক রুগ্ন নয়, মুখের বলিরেখা সরল তবু আশঙ্কাহীন নয়। হাসপাতালের ফটকের সামনে বুলডোজার মুঠো উলটে শরীরটা ফেলে দিয়ে চলে যায়। দু-চারজন নার্স দৌড়ে বেরিয়ে আসে, নির্লিপ্ত চলে যাওয়াটার দিকে চেয়ে থাকে। যাকে ফেলে রেখে গেল আর যে রেখে গেল, তারা দুই ভাই – কিডি (Kiddi) আর গামি (Gummi)। যদিও ওদের মধ্যে সম্পর্ক বলতে খালি কয়েক দশকের টুঁটি টেপাটেপি, তাও সরাসরি নয় কারণ এমনিতে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। তাই মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে যাওয়া কিডি’র প্রতি গামি সাবধানী। সে নিজে হাত লাগায়না, যন্ত্রের হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালে, শরীরটা রেখে আসে ফটকে – ব্যস এইটুকুই। রাগের পরতে যেমন অভিমানের রেশম ভেসে থাকে, না থাকার মতো তবু না হলেই নয়; এমন নিষ্ঠুর সত্যের আগে ডবল এক্স বসতে দেখে অস্বস্তি হয়। যে গল্প নিয়ে কথা বলছি তার নাম Rams (Hrutar), একটা আইসল্যান্ডিক ছবি। গল্প বলার কাজটা করেছেন Grimur Hakonarsan।
এ গল্পের বেড়া আইসল্যান্ডের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের দুই বৃদ্ধ ভাই ও তাদের ভেড়াদের ঘিরে। কী কারণে গামি আর কিডি’র মধ্যে রেষারেষি সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে, নিদারুণ ভালোবাসা আর উত্তাল ঘৃণা – এই দুইয়ের আফিং লোফালুফির অসহায় পরিণতিই এই গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। আইসল্যান্ডে মানুষের থেকে ভেড়ার সংখ্যা বেশী, প্রায় দ্বিগুণ। স্বভাবতই ভেড়ার প্রতি তাদের বাৎসল্যও অপত্য মেঘের মতো নীল। গামি আর কিডি’র ভেড়ারা গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্রিডের গর্বপোশাকে লাল। তবে হঠাৎই ফ্লুয়ের মতো ছোঁয়াচে Scrappie নামক গবাদি-মারণ রোগে উপত্যকার কিছু ভেড়া আক্রান্ত হয়। এর পরিণতি - অল্প সময়ের মধ্যে উপত্যকার সমস্ত ভেড়ার মধ্যে ঐ রোগের সংক্রমণ। রেমেডি একটাই – উপত্যকার সমস্ত ভেড়াকে মেরে মাটিতে পুঁতে খামারবাড়িগুলোও জ্বালিয়ে দেওয়া। স্থানীয় স্বাস্থ্যদপ্তর ভেড়া নিধনের বরাত পেলেও গামি নিজে হাতে পিস্তল দিয়ে তার ভেড়াদের করোটিতে শূন্যতা গেঁথে দেয়। Bruno Ganz অভিনীত ‘Downfall’ ছবিতে হিটলারের সহচর Joseph Goebbels-এর স্ত্রী Magda Goebbels তার ছয় সন্তানের মুখে ঘুমের মধ্যে সায়ানাইড ক্যাপসুল পুড়ে দিয়েছিল। বাৎসল্যপ্রেম বারবার নিজের পিঠে চাবুক মেরে সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণাকে সংক্ষিপ্ত করে দিতে চায়। গোটা উপত্যকা উজাড় হয়ে গেলে চৌকাঠে মেরুদন্ড টান করে বিষণ্ণতা এসে দাঁড়ায়। কিডি এসে গামিকে উদোম ধোলাই দেয়, খামারের মাটিতে মুন্ডু ঘষে দেয়; গামিই প্রথম Scrappie-র কথা চাউর করেছিল। গামি পেরে ওঠে না। ক্রিসমাস সন্ধ্যায় মদ খেয়ে বেহুঁশ কিডিকে বয়ে দিয়ে যায় এক যুবা, গামি’র কাছে। সে শরীরে প্রয়োজনীয় আলোর বন্দোবস্ত করে গামি। সম্পর্কের ছায়া আদিম হলে আরও গাঢ় হয়, হৃদপিণ্ডের আড়ালে কুয়াশা জমে। ইতিমধ্যে চাউর হয়ে যায় গামি তার বাড়িতে ভেড়া লুকিয়ে রেখেছে। সেটা অবশ্য সত্যি, সে তার প্রিয় ভেড়াটাকে মারতে পারেনি। তাকে বাড়ির নিচে লুকিয়ে রেখেছে, সঙ্গে কিছু মেয়ে ভেড়া। তাদের সুঠাম সঙ্গমের শব্দ যেন গামি’র ক্রিসমাস ক্যারোল। হাতে বন্দুক নিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা দরজায় পাহারা দেয়, চোখ বুজে এলেও তুড়ুক প্রতিবর্তে আবার সতর্ক হয়। কিন্তু বোঝে, এ গড়িমসি হাস্যকর। মানুষ মারার মত বাঁজখাই নয় তার ধক। তাহলে উপায়? গামি আর কিডি একসাথে তাদের পারিবারিক ব্রিডকে বাঁচাবার তাগিদে, তুষারঝড়কে পরোয়া না করে, ভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় উঁচু পাহাড়ি জমিতে। সেখানে ওরা নিরাপদ – কেউ ধাওয়া করবেনা সেখানে। ভেড়াদের প্রাণের আশঙ্কা, দুই বুড়োর এতবছরের লাঠালাঠিকে নিরপেক্ষতা দেয়। ভালবাসার সামনে বৃষ্টি হয়ে যায় মেঘ, অভিমানের চামড়া শিথিল হয়। সকাল থেকে রাত হয়ে যায় উঁচুতে উঠতে উঠতে, তুষারঝড়ে ভেড়ারা হারিয়ে যায়, গামি টর্চ নিয়ে খুঁজতে গিয়ে নিজেও ফেরেনা। সকালে কিডি বরফের মধ্যে নিথর গামিকে খুঁজে পায়। ছবির শেষ দৃশ্যে বরফের মধ্যে বানানো দুই মানুষ সমান এক গর্তে কিডি তার উদোম শরীরের তাপ দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ছোটভাই গামি’র নিথর উলঙ্গ দেহ। ঈশ্বরের নকল কোলাহল মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়।
এই ছবিতে প্রকৃতি নিজেই একটা স্বতন্ত্র চরিত্রের ভূমিকা নিয়েছে। গ্রীষ্মের সবুজে মোড়া উপত্যকা আর শীতের রুক্ষ সাদা ক্যানভাস ছবির মুডকে আশ্বস্ত করে, গভীরতা দেয়। একান্ত কোন একটা কথা না বললেই নয়, এমন ছাড়া সংলাপের ভাঁড়ারও প্রায় শূন্য। তা সত্ত্বেও শুধু শব্দ-সুর-দৃশ্য-নৈশব্দের এর ঝকঝকে বুনন, প্রায় দেড় ঘন্টার এই ছবিকে ঘাড় ধরে শেষ অবধি দেখতে বাধ্য করে। যেন দুর্দান্ত একটা স্ট্র্যাটেজি করে এই ছবিকে ভাল-না-লাগার সমস্ত সম্ভাবনাগুলো ধরে ধরে মুছে দেওয়া হয়েছে। এ ছবির কোনো statement দেওয়ার দায় নেই। চরম নাটকীয় মুহূর্তগুলো শুধুমাত্র সারল্যের পরত বেয়ে স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে। অসহায়ের মতো Rams এর নিঃসঙ্গতা বসার ঘরে ঢুকে পড়ে। তুষারঝড়ে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, হারিয়ে যাওয়া Rams-এর ঘন্টির আওয়াজ আসে শুধু।
#