নিবন্ধ

রাম-নাম সত্য হ্যায়

নির্মাল্য কুমার ঘোষ Aug 9, 2020 at 5:17 am নিবন্ধ

ওঁরা থাকে ওপারে (পঞ্চম কিস্তি)


ভূতেদের জব্দ করবার কথা বলব, আর তাতে রামচন্দ্রের নাম আসবে না, তাই কি হয়! সেই কোন ছোটবেলা থেকেই আপনি তো জানেন যে, ভূতে ভয় লাগলে আওড়াতে হয় রাম-নাম -- "ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি / রাম লক্ষণ সাথে আছে, করবি আমার কী?" ভূতেরা রাম-নামে বড্ড ভয় পায়। একটু কানে গেলেই তাদের মরণ! এ বিষয়ে ললিতমোহন ভট্টাচার্যের 'রামায়ণ গান' একটা চমৎকার গল্প। গোপীনাথপুরের রামায়ণওয়ালাদের গান বড় ভয়ানক। তার গুঁতোয় বটগাছের ব্রহ্মদৈত্যকে উদ্বাস্তু হতে হয়। "আঁমায়ন"-এর "আঁমনাম"-কে ঠেকাতে সে দ্বারস্থ হয় এক মুটের; মুটে বাঁশপেটা করে তাড়িয়ে দেয় রামনামের দলকে। বিরাটগঞ্জের রাজকন্যার ঘাড়ে চাপে ব্রহ্মদৈত্য; মুটের সঙ্গে আপস রফায় নেমে গিয়ে মুটেকে রাজার জামাই বানিয়ে দেয়। সঙ্গে থাকে চেতাবনি, ভবিষ্যতে পাঁয়তারা না কষার! রাজার গুরুদেবের মেয়েকে ব্রহ্মদৈত্য ধরাতে বাধ্যত তার মুখোমুখি হতে হয় মুটে-জামাইকে। ব্রহ্মদৈত্যর হুংকারের মোকাবিলায় সে নিঃশব্দে ছাড়ে তার ব্রহ্মাস্ত্র -- সে খবর দিতে এসেছে, সেই রাম-নামের দল নাকি আবার আসছে!!


রাম-নামে ভূতের অ্যালার্জি নিয়ে সরস একটি গল্প লিখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী 'কালোপনিক ভূত' নামে। তার আসল নাম কালোরাম পরামানিক। "রাম"-কে ছেঁটে ফেলে তার মরণোত্তর সংক্ষেপিত নাম কালোপনিক। অভিনয় করায় তার উৎকট আগ্রহ। তাকে অভিনয় করা থেকে আটকাতে পূর্ণেন্দু যে সংলাপ দেন, তার গায়ে জড়ানো রাম-নামাবলি -- "যে-সংলাপ ওকে দিয়েছি, তার মধ্যে আঠারো বার রয়েছে ‘রাম’ শব্দটা। যেমন আরাম, ব্যারাম, হারামজাদা, রামতনুবাবু, অবিরাম, রামধনু, রামায়ণ, বিরাম, রামরাজ্য, ভ্যাবাগঙ্গারাম ইত্যাদি ইত্যাদি।" সুকুমার দে সরকারের 'ভূতো' গল্পেও মেলে রামনামের গুঁতো। দেবুর সঙ্গে দোস্তি হয় বাচ্চা ভূত "ভূতো"-র। তার বাবা "কটকটে" ভূত। সে "রাম"-এর বিকল্প উচ্চারণ বেছে নিয়েছে -- "আরে ছি ছি, ভরত ভরত!" রাম-নাম শুনলেই তারা ফানুসের মতো ফেটে যায়। গল্পে তা-ই ঘটে। দেবু সুকুমার রায়ের বিকৃত আবৃত্তি করে বন্ধু ভূতোকে বাঁচাবার জন্য -- "আরে ছি ছি আম আম বোলো না হে বোলো না --/ চলছে যা জুয়াচুরি নাই তার তুলনা।" দিদিমণি শুধরে "রাম রাম" করে দিতেই ভুতোর কম্ম কাবার!


চতুর্থ পর্ব
পড়তে হলে নীচে ক্লিক করুন


ভূতের দাওয়াই


আচ্ছা বলুন তো, রামের নামে ভূতেদের এত অ্যালার্জি কেন ? এ বিষয়ে একটা ছোট্ট তাত্ত্বিক ভাবনা মাথায় আসে। ভূত-প্রেত বা প্রমথরা শিবানুচর। সময়ে সময়ে তারা কালী, চণ্ডী, দুর্গারও সহযোগী। মোদ্দা কথা, মহেশ্বর ভট্টাচার্য আর পার্বতী ঠাকুরানির পরিবারের সঙ্গেই, বাঙালি তথা ভারতীয় অপদেবতাদের গা-মাখামাখি। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি থেকে শশিভূষণ দাশগুপ্ত, অনেকেই লক্ষ করেছেন আর্য-পূর্ব স্থানীয় দেবতাদের পৌরাণিক দেবমণ্ডলীতে স্থান দেওয়ার জন্য, আকছার তাদেরকে কোনো-না-কোনোভাবে লতায়-পাতায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে শিব-দুর্গার পরিবারের সঙ্গে। একই পদ্ধতিতে দেশি অপদেবতারাও হর-পার্বতীর বাধ্য অনুচর হয়ে উঠেছেন কি না, তা ভাবা যেতেই পারে। আর এই শিবানুচররা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বিষ্ণুর অবতার রামকে! বাংলাদেশের প্রচলিত বিভিন্ন ভূত তাড়ানোর মন্ত্রে দেখা যাবে "নরসিংহ"-এর দোহাই দেওয়া হয়। নরসিংহ যদি "নৃসিংহ" শব্দের অপভ্রংশ হয়, তাহলে তো মানতেই হয় শিবের অনুচররা বিষ্ণুর অবতারদের রীতিমতো ভয় পায়। ভারতীয় পুরাণে শিব এবং বিষ্ণুর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে, কিছু দ্বন্দ্বের আভাস আমরা পাই। ভূতেদের আশ্রয়দাতা আর ধ্বংসকর্তা এই দুই দেবতার সম্পর্ক কি সেই পৌরাণিক দ্বন্দ্বেরই কোনো ক্ষীণ অবশেষ ?

#নিবন্ধ #নিবন্ধ সিরিজ #ওঁরা থাকে ওপারে #নির্মাল্য কুমার ঘোষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

184518