ক্রিকেটের রবীন্দ্রনাথ
ক্রিকেট আর রবীন্দ্রনাথ। এই দুটো নাম একসঙ্গে শুনতে আমরা অভ্যস্থ নই ঠিক। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় না। কবিগুরুর উন্নত শরীর-স্বাস্থ্যের কথা আমাদের কারোরই অজানা নয়। সাঁতার, কুস্তি ইত্যাদিতে তাঁর পারদর্শিতার কথাও সুবিদিত। কিন্তু ক্রিকেট নামক সাহেবি খেলাটার সঙ্গে কি তাঁর যোগ ছিল? রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখালিখিতে কিন্তু এর উত্তর নেই।
এমনিতে রবীন্দ্র-সাহিত্যে ইতিউতি উঁকি মেরেছে জনপ্রিয় এই খেলার রেফারেন্স। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত 'চিরকুমার সভা' নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে শ্রীশ দিব্যি বলছে: "তোমরা যে দিনরাত্রি ফুটবল টেনিস ক্রিকেট নিয়ে থাক, তোমরা একবার পড়লে ব্যাট্বল গুলিডাণ্ডা সবসুদ্ধ ঘাড়-মোড় ভেঙে পড়বে।" ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘গোরা’ উপন্যাসের এক জায়গায় পাচ্ছি - ‘এখানকার মেলা উপলক্ষেই কলিকাতার একদল ছাত্রের সহিত এখানকার স্থানীয় ছাত্রদলের ক্রিকেট-যুদ্ধ স্থির হইয়াছে। হাত পাকাইবার জন্য কলিকাতার ছেলেরা আপন দলের মধ্যেই খেলিতেছিল। ক্রিকেটের গোলা লাগিয়া একটি ছেলের পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে।’ সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগে যেখানে য্-ফলা শেখানো হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে ক্রিকেটের উল্লেখ - “অগত্যা বাইরে ব’সে আছি। দেখছি, ছেলেরা খুশি হয়ে নৃত্য করছে। কেউ বা ব্যাটবল খেলছে। নিত্যশরণ ওদের ক্যাপ্টেন।”
কিন্তু এ-তো গেল সাহিত্যে ক্রিকেটের প্রসঙ্গ। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, কবিগুরু কি ক্রিকেট খেলেছেন কখনও?
১৯৬২ সালের ৩ রা জানুয়ারি আনন্দবাজারে জগদীশচন্দ্র রায়ের লেখা একটি চিঠি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। চিঠিটার একটা অংশ শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর বিখ্যাত বই ‘সারাদিনের খেলা’-য় উদ্ধার করেছেন -
"১৯নং স্টোর রোডে (বালীগঞ্জ) স্বর্গীয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় থাকতেন। তিনি তাঁর পেনসনের সমস্ত টাকাটাই দেশের জন্য খরচ করতেন। বিশেষ করে পালোয়ানদের ও লাঠিয়ালদের মাহিনা দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার ছোট-ছোট ছেলেদের সংগঠন [sic?] ও শক্তিশালী করতেন। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে সপ্তাহে তিন দিন নিয়মিত এসে খেলায় যোগ দিতেন।
১৯নং স্টোর রোডের সামনেই মিলিটারী মাঠ; সেই মাঠের একপাশে তখনকার দিনের ভারত-বিখ্যাত সাহেবদের ক্রিকেট-ক্লাব। ঐ ক্লাবে ভারতীয়দের সভ্য হবার কোন উপায় ছিল না, তাঁরা যতই বড় হউন না কেন।
কোনো একদিন ঐ ক্লাবের ক্রিকেট-খেলা দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেজদাদাকে বলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ম্যানেজার মিঃ ভোগেল এবং আমাকে ব্যাট, বল, নেট প্রভৃতি কিনতে পাঠিয়েছিলেন। ঐ সঙ্গে বলে দেন – ভারতীয় দোকান থেকে জিনিস কিনতে। আমরা এস্প্ল্যানেডের উত্তর দিকের দোকান থেকে সমস্ত জিনিস কিনে ফিরি। তার পরদিন থেকেই খেলা আরম্ভ হয়। সত্যেন্দ্রনাথ দুই জন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানকে মাইনে দিয়ে খেলা শিখাবার জন্য নিযুক্ত করলেন। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে প্রত্যহই খেলা দেখতে ও খেলতে আসতেন। রবীন্দ্রনাথের এই খেলা কিন্তু মোটেই ভাল লাগেনি। তার কারণ একদিন খেলতে-খেলতে একটা বল তাঁর পায়ে লাগে এবং তিনি জখম হন। তাছাড়া ক্রিকেট খেলার যা বিশেষ দরকার, তা তাঁর ছিল না। অর্থাৎ তিনি তাঁর মন ও চোখ ঠিক রাখতে পারতেন না। প্রায় তিন মাস পরে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় খেলা লাঠি নিয়ে থাকতেন। তাঁর দাদা অবশ্য বৃদ্ধ বয়সেও ক্রিকেট খেলতেন।”
ফলে বোঝাই যাচ্ছে ক্রিকেট ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
...............
ঋণ : শঙ্করীপ্রসাদ বসু, সারাদিনের খেলা
#Cricket #Rabindranath Tagore #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #ক্রিকেট #silly পয়েন্ট