প্রকাশকের বৈঠক
বইয়ের খবর: পিওন থেকে প্রকাশকলেখক: বাদল বসুপ্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স
‘সাহিত্যজগতে প্রকাশকের ভূমিকা হল হাইফেনের মতো। পদ্মফুলের যে-ডাঁটা, যাকে বলা হয় মৃণাল, প্রকাশক ঠিক তার মতো। কোনও বই হাতে পেয়ে পাঠকরা প্রথমে দেখেন লেখকের নাম। আর পাঠক সচেতন হলে লেখকের পাশাপাশি দেখেন প্রচ্ছদশিল্পীর নাম। কিন্তু কেউ কি একবারও প্রকাশককে নিয়ে মাথা ঘামান?...মৃণাল যেমন নিজে জলের তলায় ডুবে থেকে জলের উপরে ভাসিয়ে রাখে পদ্মফুলটিকে, একজন ভালো প্রকাশকও তেমনই নিজেকে আড়ালে রেখে তুলে ধরেন লেখককে।’– ‘পিওন থেকে প্রকাশক’ গ্রন্থের প্রারম্ভিক পর্বেই লেখক বুঝে নিতে চেয়েছেন ভালো প্রকাশকের অভিধাটিকে। তিনি, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু ওরফে বাদল বসু সারাজীবন কর্মসূত্রে আনন্দ পাবলিশার্স- এর সঙ্গে যুক্ত হবার দরুন সেই ভালো প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন অক্লান্তভাবে। আর এখানে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর প্রকাশক জীবনের বর্ণিল যাপনচিত্র।
প্রথম জীবনে আর্থিক অসচ্ছলতা, সাংসারিক দায়িত্ব, গ্রামজীবনের স্মৃতির পাশাপাশি উঠে এসেছে কলকাতা শহরের প্রকাশনার দায়িত্বে থাকার বিপুল অভিজ্ঞতা। পড়াশোনার তথাকথিত ডিগ্রি পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে তিনি অর্জন করতে না পারলেও লেখকদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে নিজের জানার মানকেও সেই স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা করতেন। এই চেনাশোনার সূত্রেই বহু অজানা তথ্য তিনি সামনে এনেছেন, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ এখানে দিই। সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ-এর ছদ্মনাম ‘রূপদর্শী’ এটি সবাই কম-বেশি জানেন, কিন্তু ‘কবি কনকন গৌড়চান মোল্লা’-ও যে আসলে তিনিই, এ কথা কজন জানেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
লেখকের কথায় উঠে এসেছে আনন্দ পাবলিশার্সের নানান ধরনের বই সিরিজের কথা এবং তাকে ঘিরে নানান গুণীজনের অভিজ্ঞতা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভবতোষ দত্ত, প্রণব বর্ধন, অমিয় বাগচী, মিহির রক্ষিত, অশোক রুদ্র, কিংবা চিত্রকলা সিরিজের ক্ষেত্রে নীরদ মজুমদার, হেমেন মজুমদার, পরিতোষ সেন, অশোক মিত্র-র মতো বিশিষ্ট মানুষজনকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আসতে পেরেছিল এই প্রকাশনা সংস্থা। পূর্ণেন্দু পত্রী, সত্যজিৎ রায়, বিমল দাস, সুধীর মৈত্র, সমীর সরকার প্রমুখের নিপুণ অলংকরণ বা প্রচ্ছদশিল্প আনন্দকে এক অভিনব শৈল্পিক পরিচিতি দিয়েছিল।
বহু লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, নির্মাল্য আচার্য, কার কথা নেই তাঁর এই ফিরে দেখা-য়! স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে লেখক জানিয়েছেন সমরেশ বসু, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র-দের বহু লেখা এখনও লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যাওয়ার কথা।
দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি যেমন সম্মানের সঙ্গে কাজ করে গেছেন, তেমনি নিজের ভুল ত্রুটির কথাও অকপটে বলতে পিছপা হননি। সুখময় ভট্টাচার্য-এর ‘সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো গ্রন্থ কেন আনন্দ পাবলিশার্স-এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারল না, এটি তাঁর জীবনে অনন্য ব্যর্থতার স্মারক রূপে তিনি চিহ্নিত করেছেন। আবার কোন কোন গ্রন্থ পাঠকের কাছে গৃহীত হবে সেটিও তিনি জানতেন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে যে পরিচয়ের সূত্রপাত, তা যে হৃদ্যতায় পৌঁছে যেতে পারে, লেখকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে সে বয়ান রয়ে গেছে।
আবার ব্যবসায়িক ও ঘনিষ্ঠ উভয়প্রকার সম্পর্কের কারণেই বিখ্যাত মানুষদের ত্রুটি বিচ্যুতিও অনেক সময়ই ধরা পড়ে গেছে তাঁর কাছে। সহৃদয় পাঠক তা খুঁজে নেবেন বইয়ের পাতায়, কিন্তু লেখকের ব্যক্তিক অসূয়ার কোনও প্রকাশ সেখানে নেই।
ব্যক্তিগত ভাবে কারও কারও অনুপস্থিতি চোখে পড়েছে। যেমন-সম্পাদক সাগরময় ঘোষ-এর কথা খুব বড়ো পরিসরে এখানে আসেনি, তেমনি আসেনি লেখক নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ)-এর কথা। তবে স্মৃতিকথায় লেখক কাকে ঠাঁই দেবেন আর কাকে পরিহার করবেন, সেই স্বাধীনতা তো লেখকের আছেই। আনন্দ পাবলিশার্সের মতো একটি সুপ্রাচীন প্রকাশনা এবং সেই সূত্রে বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত কলমগুলিকে যাঁরা চিনে নিতে চান, এ বই তাঁদের হতাশ করবে না।
[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#বইয়ের খবর