কান্তাগর্ভ
॥ এক ॥ পূর্ব-পূর্ব বহুবারের মতো আবারও ত্রৈলোক্যে উঠল হাহাকার। কল্মষ নামক এক মহাদুরাচারী অসুর কমলযোনি ব্রহ্মার বরে অজেয় হয়ে সুরনরনিপীড়নে করল আত্মনিয়োগ। দেবলোকের দেবেন্দ্র, নরলোকের নরেন্দ্র, নাগলোকের নাগেন্দ্র প্রভৃতি সকলেই সিংহাসন হারালেন। মানুষ ছুটল দেবতার মন্দিরে। দেবগণ ছুটলেন ব্রহ্মার মন্দিরে। ব্রহ্মা ছুটলেন বিষ্ণুর আলয়ে। গিয়ে দেখেন, নারায়ণ নাগশয্যায় অঘোরে যোগনিদ্রিত। সে ঘুম কখন ভাঙবে, কেউ জানে না। অগত্যা সুবর্ণকমলা দেবী লক্ষ্মীকেই ব্রহ্মা বললেন, "সব দোষ এই আমার মাগো। অসুররা অমরত্ব চায়। আমি অমরত্ব দিতে অস্বীকৃত হয়ে অন্য বর চাইতে বলি। তখন তারা যেসব উদ্ভট বর চায়, তা দিলেও বিপদ। আবার না দিলেও নয়। এই যেমন এবার।" --"হ্যাঁ, এবারের বর নাকি সত্যিই ভারী অদ্ভুত ! তা কী সেই বর, সৃষ্টিপতি ?" কমলার অধরে হাস্য ; নয়নে রহস্য। --"সে কি যেমন তেমন অদ্ভুত বর মা ? দুষ্টমতি অসুর বলে কিনা, পতি যখন পত্নীকে কন্যারূপে প্রসব করবে -- তখন যেন সেই কন্যার হাতে আমার মৃত্যু হয়। তুমিই বলো তো মা, এমন সব কুটিল বুদ্ধি এরা পায় কোথায় !" --"বিদ্যা-বুদ্ধির দেবীকে নিয়ে যে ঘর করে, তার মুখে এই কথা !" লক্ষ্মীদেবী বৃষ্টির শব্দের মতো রিমঝিম করে হেসে ওঠেন। বলেন, "চতুর্মুখ ব্রহ্মা ! তুমি নামে চতুরানন হলেও কাজে কিন্তু অসুররাই বেশি চতুর। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।" --"কিন্তু উপায় ? উপায় কী হবে মা ? শ্রীহরি যে নিদ্রিত ! তবে কি কৈলাসে ভগবতীর দরবারে যেতে হবে ?" --"মাকে এখনই বিব্রত করে কাজ নেই, হে বিধাতা। একটু ধৈর্য ধরো। দেখি, কী করতে পারি। দেবগণকে গিয়ে অভয় দাও।" --"অভয় দিলেই তাঁরা নির্ভয় হবেন কেন মা ? মানুষ দেবতার দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছিল বলে দুষ্ট কল্মষ সমস্ত পূজার্চনা নিষিদ্ধ করেছে। একদিকে নেই স্বর্গ। অন্যদিকে নেই নৈবেদ্য ও আহুতি। দেবগণ ক্ষীণদেহে আমার প্রত্যাবর্তনের আশায় অপেক্ষমাণ। কী বলে তাঁদের..." ব্রহ্মার কথা শেষ হওয়ার আগেই নারায়ণের চরণপদ্মে টুপ করে একটি সচন্দন তুলসীমঞ্জরী এসে পড়ল। সেদিকে প্রসন্ননয়নে তাকিয়ে প্রসন্নকণ্ঠে কমলা বললেন, "মর্তলোকে দেবপূজা একেবারেই কি বন্ধ হয়েছে, বিধাতা ? মনে তো হয় না। এই নাও অন্নপ্রসাদ। দেবগণকে তৃপ্ত করো। আমি দেখছি।" সন্তোষ ও সংশয়ে দোদুল্যমান বিধাতা নিজলোকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ॥ দুই ॥ দাক্ষিণাত্যের চোলপ্রদেশে ব্রাহ্ম মুহূর্তে এক বৃদ্ধা শয্যাত্যাগ করে উঠে পড়লেন। রেবাম্মা তাঁর নাম। দন্তধাবনাদি নিত্যকর্মগুলি সমাধা করে এবার তিনি দীর্ঘিকায় যাবেন স্নানার্থে। তার আগে একটি পাত্রে তিনি নিয়েছেন আমলকীজাত তৈল, চন্দনপঙ্কের বিলেপন প্রভৃতি। কাঁধে নিয়েছেন ধৌত শুক্লবস্ত্র। রেবাম্মা স্নানে চললেন। রেবাম্মার স্বামী ছিলেন চম্পকেশ্বর বিষ্ণুমন্দিরের প্রধান পুরোহিত। সুখেই দিন কাটত নিঃসন্তান বৃদ্ধ দম্পতির। কিন্তু কল্মষের আদেশে সমস্ত দেবারাধনা বন্ধ হল। দৃষ্টান্ত হিসেবে হত্যা করা হল রেবাম্মার স্বামীসহ আরও বহু পূজারি ব্রাহ্মণকে। প্রাণভয়ে সকলে পূজার্চনা বন্ধ করল। রেবাম্মাও। অন্তত লোকে তো তাই বলে। দীর্ঘিকায় যাওয়ার পথের দুপাশে এটা-সেটার খেত। রেবাম্মা আপন মনে এটা-ওটা ছিঁড়তে-ছিঁড়তে যান। দীঘির ধারে পৌঁছে প্রতিদিনের মতো দেখেন, রাক্ষসীদের পাহারা। "ওরে জরতী রেবাম্মা ! পুজো করতে আসিসনি তো ? রাজার হুকুম মনে আছে নিশ্চয়ই ?" "আ মরণ ডাইনির দল ! সব সময়ে সবাইকে খালি পুজো করতেই দেখে মর তোরা। সগ্গের দেবতাদের ডেকে আর কী হবে ? আমার যা বয়েস, তাতে দুদিন পর এমনিতেই সগ্গে যাব। ওখানেই তাঁদের পুজো করব খন।" "স্বর্গে কোনও দেবতাকেই আর পাবি না রে বুড়ি। সবকটাকে তাড়ানো হয়েছে। বরং নরকে গেলে ওদের দেখা পেলেও পেতে পারিস।" "হ্যাঁ রে ভূতমুখী রাক্কুসীর জাত ! রোজ সকালে তোদের মুখ দেখে যা পুণ্যি হয়, তাতে নরকেই যেতে হবে বইকি ! নে, রঙ্গ রাখ। ঘাট ছাড়। নাইতে দে। নাকি তোদের রাজা নাইতেও মানা করেছে লোককে ?" "না, নাইতে মানা নেই।" "বটে ? তোদের দেখে তো মনে হয় না। শরীরে যা দুর্গন্ধ ! সর সর।" "দাঁড়া রেবাম্মা। তোর আঁচলে ওগুলো কী বাঁধা ? খোল দেখি ?" অম্লানবদনে রেবাম্মা আঁচল খোলেন। "কী আবার ? গোটাকয় তুলসীপাতা। এত ভোরবেলায় চান করলে রোজ রাতে কাশি ওঠে। তাই মধু দিয়ে মেড়ে খাব বলে নিয়ে এসেছি। এই দেখ বাপু, এই বাটিতে মধুও আছে। বিশ্বেস হল তো ?" "তা ওষুধ-বিষুধ খাবি তো নিজের বাড়িতে বসে খা না। এখানে বয়ে এনেছিস কেন ? তোর মতলবটা কী বল তো ?" "মতলব আমার মাথা আর তোদের মুন্ডু। কবরেজ মুখপোড়া বললে, চানের পর যখন গায়ে কাঁপুনি দেবে, তখনই মধু-তুলসী খেতে। তাহলে আর ঠান্ডা লাগবে না। ঘাড় মটকাতে গেলে কবরেজের ঘাড় মটকা। আমার ঘাড় বয়েসের ভারে এমনিতেই মটকে আছে হতভাগীর দল।" "বয়েস ? বয়েসের খেয়াল তোর আছে নাকি রে বুড়ি ? এই বয়সে গা ভরা গয়না ! হাতে মকরমুখো বালা ! গলায় ঝিনুক-মানিক হার ! রোজ যা আমলকী-চন্দন ঘষিস গায়ে-মাথায়, আরও কী কী সব মাখিস, তাতে ভর যুবতিরাও হার মানবে। বলি, চিতায় উঠেও চন্দন মাখবি, নাকি ?" "চিতায় উঠে চন্দন মাখব কেন রে শতেকখোয়ারি ? বরং চন্দন কাঠের চিতাতে উঠব। তোদের ইচ্ছে হলে তোরাও সঙ্গে উঠিস খন। এবার সরবি ? না অন্য ঘাটে যাব ?" প্রতিদিনই ইত্যাকার কিছু গালাগালের গালবাদ্যের পর রাক্ষসীরা সরে দাঁড়ায়। রেবাম্মা ঘাটে বসে চটুল সুরে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চান করেন। না হোক, অন্তত দশবার ডুব দেন। সেদিনও ডুব দিলেন রেবাম্মা। দিয়েই গলার ঝিনুক-মানিক হারের সোনার ঝিনুকটি খুলে ভিতর থেকে মানিকের বদলে বের করলেন একটি সুদৃশ্য ছোট্ট শালিগ্রাম শিলা। ডুবজলে তাঁকে স্নান করালেন। পরের ডুবে অতি গোপনে তাঁকে দিলেন সচন্দন তুলসী। তার পরের ডুবে খোঁপায় জড়ানোর নতুন মালা থেকে খুলে নেওয়া একটি কুন্দ ফুল। এভাবেই এক-একটি ডুবে এক-একটি উপচারে পুজো হল শালিগ্রামরূপী বিষ্ণুর। রাক্ষসীরা তো আর জানে না যে, রেবাম্মা শুধু পুরোহিতপত্নী নন ! তিনি নিজেই পূর্ণাভিষিক্তা কৌল সাধিকা ! গুরুদত্ত শালিগ্রামের সেবাধিকারিণী। প্রতিটি গৃহে এখন অসুরদের পাহারা। সমগ্র চোল প্রদেশে যত দেববিগ্রহ, দেবপট, দেবশিলা ছিল-- নষ্ট হয়েছে কল্মষের সেনার হাতে। অবশিষ্ট আছেন কেবল এই শালিগ্রামটি-- ভক্তিমতী বুদ্ধিমতী রেবাম্মার কণ্ঠলগ্ন হয়ে। সাদা কাপড়টি পরে, সাদা চন্দন মেখে, সাদা ফুলের মালা মাথায় জড়িয়ে রাক্ষসীসেনার চোখের উপর দিয়ে ভৈরবী রেবা দেব্যম্বা বাড়ি ফিরলেন। ॥ তিন ॥ রোজই দিবানিশি অহরহ রেবাম্মা প্রার্থনা করেন, এই তামসিক অপশাসনের শেষ হোক। দিন কয়েক পর, এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, কে এক অত্যুজ্জ্বলা রমণী তাঁকে বলছেন, "রেবাম্মা ! আমি এসেছি ! আজ তুমি আমার দেখা পাবে।" রেবাম্মা বললেন, "কে গো তুমি ?" রমণী বললেন, "তোমার মা, তোমার মেয়ে, তোমার সই। বাকিটা তোমার নারায়ণ জানেন।" নারায়ণের নাম শুনে তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে গেল রেবাম্মার। দেখলেন, ব্রাহ্মমুহূর্ত সমাগত। নিত্যপুজোর সময় সমুপস্থিত। স্বপ্নটির কথা ভাবতে ভাবতে তিনি স্নানে চললেন। রাক্ষসীদের সঙ্গে প্রাত্যহিক বচসার পর ঘাটে এলেন রেবাম্মা। ডুব দিলেন। সোনার ঝিনুক খুলে বের করলেন শালিগ্রাম। অবাক কাণ্ড ! গোলকাকার শালিগ্রামের চক্র ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে একটি অতি ক্ষুদ্র অঙ্কুর ! ঠিক যেন নারায়ণের নাভিপদ্ম ! এতখানি বয়সে এমনটি দেখেননি-শোনেননি রেবাম্মা। গুপ্তপুজোর শেষে জলমগ্ন অবস্থাতেই আবারও ভালো করে দেখলেন অঙ্কুরটিকে। ফেরার পথে ভাবতে লাগলেন, কীসের অঙ্কুর এটি ! কীভাবে জন্মাল শালিগ্রামের মধ্যে ! স্নানে আসার সময়ে দুপাশের খেত থেকে পঞ্চশস্য তুলে আনেন তিনি। সেই পঞ্চশস্য নিবেদনের সময়েই কি শিলার ভিতরে প্রবিষ্ট হয়েছিল কোনও শস্য ? হতেও পারে। কিন্তু মাটি ? মাটি পেল কোথায় ? তবে কি নদীগর্ভে নারায়ণকে স্নান করানোর সময়ে কর্দমযুক্ত জল ঢুকেছিল শালিগ্রামে ? ভেবে নিজেরই হাসি পেল রেবাম্মার। স্বয়ং ভূদেবীকে যিনি নিজক্রোড়ে স্থাপন করেন, তাঁর কি মাটির অভাব ? কিন্তু এই অঙ্কুরটিকে তো সোনার ঝিনুকে বন্দি করে রাখা চলে না ! বাড়ি ফিরে ইতিউতি তাকিয়ে রেবাম্মা দেখলেন, চারপাশে আপাতত কেউ নেই। শালিগ্রাম শিলাটি বের করে-- সাবধানে-- অতি সাবধানে-- অঙ্কুরটিকে মূলসহ বের করলেন তিনি। ঘরের সামনে যে ছোট্ট বাগান-- তাতে সযতনে পুঁতলেন। জল দিলেন একটু। প্রতিদিনই নারায়ণপুজো সেরে ফেরার পর অঞ্জলি ভরে জল দিতেন সেটিকে। দিন কয়েক পর বোঝা গেল, নারায়ণের গর্ভভেদ করে যেটি বেরিয়েছিল, সেটি একটি ধানগাছের অঙ্কুর। ॥ চার ॥ মাসকয়েক কাটল। অঙ্কুর থেকে চারা, চারা থেকে গাছ। দুধ জমছে ধানের শিষগুলিতে। সবুজ কাঁচা ধান ক্রমে পাক ধরার পথে। রেবাম্মা বুঝতে পারেন, যেদিন থেকে ধানের অঙ্কুরটি বাড়িতে এসেছে, সেদিন থেকে অনেক কিছুই অন্যরকম হচ্ছে। বাড়িটি হঠাৎ হঠাৎ ভরে যায় পদ্মগন্ধে। সুমঙ্গলসূচক শ্বেত পেচক উড়ে যায় বাড়িটির চারপাশে। অসুরের পেয়াদারা বাইরে থেকেই হাঁকডাক করে। ভিতরে ঢোকে না। কী এক অজানা আনন্দে রেবাম্মার মন ভরে থাকে। সেদিন আশ্বিনের পূর্ণিমা। প্রাতঃকালে দিঘি থেকে নারায়ণপুজো করে ফেরার পর রেবাম্মা দেখলেন কয়েক ছড়া সোনার ফুলঝুরির মতো বাগান আলো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ধানগাছ। আর সেই গাছের নীচে ? সেই গাছের নীচে আপনা থেকেই জড়ো হয়ে রয়েছে বেশ কিছু চাল। বাঃ ! বেড়ে মজা তো ! ধান কাটা, ধান মাড়াই করা-- কত ঝঞ্ঝাটের পর চাল মেলে। এমন শিউলি ফুলের মতো ধানগাছ থেকে চাল ঝরে পড়ে নাকি ? এখানেই শেষ নয়। রেবাম্মা কাছে গিয়ে দেখলেন, তিন-চার প্রজাতির চাল। একই গাছ থেকে অন্ন, পুষ্পান্ন, পরমান্ন, খেচরান্ন রান্নার চাল মিলছে ! এ কি কল্পতরু নাকি ? রেবাম্মা কণ্ঠের সোনার ঝিনুকটি ছুঁয়ে ফোকলা মুখে হেসে বললেন, "পেটুক কোথাকার ! সব তোমার কারসাজি। দাঁড়াও। ভোগ রাঁধছি।" একটি-একটি করে চালের দানা কুড়িয়ে নিলেন রেবাম্মা। অনেক অনেক দিন পর আজ তিনি তরিজুত করে রাঁধতে বসলেন। সারা দিন ধরে রাঁধলেন অন্ন, পুষ্পান্ন, পরমান্ন, খেচরান্ন। রাঁধলেন সপ্ত ব্যঞ্জন। পুজোর আসনটি ধুয়ে মেজে আল্পনা দিয়ে সাজালেন। জ্বাললেন ধূপ-দীপ-কর্পূর। চন্দন ঘষলেন। অগুরু ছেটালেন। বহুদিন পর রেবাম্মার বাড়ি যেন কথা কয়ে উঠল ! সন্ধ্যাকালে সোনার ঝিনুকটি থেকে নারায়ণ শিলাটি বের করে আসনের উপর স্থাপন করলেন রেবাম্মা। প্রাঙ্গণ থেকে যেন কেউ বৃষ্টির জলের মতো রিমঝিমে শব্দে বলে উঠল, "তুমি নিশ্চিন্তে পুজো করো, রেবাম্মা। আমি পাহারায় রইলাম।" ॥ পাঁচ ॥ প্রকাশ্য পুজোর খবর ছুটল কান থেকে কানে। বিধবা বুড়ির এত বড়ো দুঃসাহস ! চোখের সামনে স্বামীর পরিণাম দেখেও শিক্ষা হয় না ! পাইক পেয়াদা কে আছিস ? বুড়িকে পুজোর ঘরেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মার। পাতালভেদী অসুরসেনা রেবাম্মার বাড়ির কাছে এসে দেখে, আশ্চর্য ! শত-শত পেঁচা গম্ভীর মুখে সেই বাড়ি ঘিরে বসে আছে। এগোনোমাত্রই তারা তেড়ে এল এবং ইঁদুর ধরার মতো এক-একটি অসুরকে মুখে নিয়ে এদিকে- ওদিকে উড়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশ ফাঁকা। না অসুর, না পেঁচা। খবর গেল। আরও বেশি যুদ্ধবাজ সেনার সঙ্গে এবার এল বাছা বাছা নয়জন সেনাপতি। তারা মধ্যপথে এসে দেখে, রেবাম্মার বাড়ির থেকে তিন ক্রোশ পর্যন্ত স্থান এক বহ্নিময় যন্ত্ররেখার দ্বারা রক্ষিত। সেই যন্ত্রের আটটি কোণে ও মধ্যে নয়জন পরমাসুন্দরী রমণী ক্রোধমুখে ধনুর্বাণ হাতে বিরাজমানা। অসুরসেনা যন্ত্ররেখা লঙ্ঘনের প্রয়াস করামাত্রই বিভূতি, উন্নতি, কান্তি, সৃষ্টি, কীর্তি, সন্নতি, বুদ্ধি, উৎসৃষ্টি ও ঋদ্ধি নাম্নী সেই নয় দেবী-- যাঁরা কমলার পীঠশক্তিস্বরূপা-- তাঁরা মহারোষে বাণবর্ষণ আরম্ভ করলেন। ভাদ্রের ভরা নদী যেমন মৃত জন্তুর দেহ ভাসিয়ে নিয়ে যায়, দেবীগণের সায়কস্রোতে কল্মষের সেনা তেমনই নিরুদ্দেশে ভেসে গেল। রইল বাকি কল্মষ নিজে। যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে সে যখন এল, তখন রেবাম্মার গৃহের চারপাশে না দেখল কোনও অসুরখাদক পেঁচা, না দেখল কোনও অসুরনাশিনী পীঠশক্তিকে। ঘরের ভিতরে আছেন রেবাম্মা। পুজো ছাড়া কোনও দিকে তাঁর হুঁশ নেই। আর ঘরের বাইরে আছে একটি সোনালি ধানগাছ। রুপোলি জ্যোৎস্নায় সেটি ঝলমল করছে। ধূর্ত অসুর রেবাম্মার গৃহে ঢোকার চেষ্টামাত্র করল না। একটি প্রকাণ্ড মান্ত্রিক ত্রিশির ত্রিপুচ্ছ কুম্ভীর সৃষ্টি করে সেটিকে নিক্ষেপ করল সেই গৃহের দিকে। আর সেইমাত্র এক ফুৎকারে দীপনির্বাণের মতো নিভে গেল পূর্ণিমার চাঁদ। নিভে গেল সমস্ত তারার আলো। নিকষ আঁধারের মাঝে দাঁড়িয়ে কল্মষ শুনতে পেল অভিমন্ত্রিত ও ক্রুদ্ধ কুমিরের নিরুপায় ঘুরপাকের শব্দ। কয়েক মুহূর্ত পরেই জ্বলে উঠল চন্দ্রতারকা। জ্যোৎস্নায় আবারও ভেসে গেল দশদিশি। কল্মষ দেখল, দিকভ্রান্ত কুমির তিনটি বিরাট পুচ্ছ আন্দোলিত করে মহাবেগে ধেয়ে চলেছে সম্পূর্ণ বিপরীতে-- অসুরপুরীর দিকে। এই দৈবী মায়ার সমাপ্তি যে এবার না দেখলেই নয়। ব্রহ্মার বরলব্ধ শক্তিতে সর্বাঙ্গবন্ধন করে কল্মষ রেবাম্মার গৃহাভিমুখে এগোয়। আর তখনই সেই ফলন্ত ধানগাছ বিদ্যুৎদ্যুতিতে ভরে ওঠে। জ্বলে ওঠে। আকারে বর্ধিত হতে থাকে। বর্ধিত হতে হতে সামান্য একটি ধানগাছ যেন বিশ্বমহাতরুর রূপ নেয়। আর সেই মহাতরুর মধ্যে কল্মষ প্রত্যক্ষ করে এক মহাজ্যোতির্ময়ী দিব্য রমণীকে। সেই রমণী চতুর্ভুজা। পদ্মাসনা। হিরণ্যগৌরী। সর্বালংকারসুমণ্ডিতা। হস্তচতুষ্টয়ে যথাক্রমে নাগপাশ, অক্ষমালা, স্বর্ণপদ্ম ও সৃণি। চন্দ্রমণ্ডল ঘিরে যেমন নক্ষত্রের বিভা-- তেমনই সেই মহামহিমময়ী লক্ষ্মীদেবীর চতুষ্পার্শ্বে আদিত্যাদি নবগ্রহ, ইন্দ্রাদি দশদিকপাল, মৎস্যাদি দশাবতার যুক্তকরে দণ্ডায়মান। স্বয়ং নারায়ণ যোগনিদ্রান্তে সসম্ভ্রমে নিজশক্তির লীলা নিরীক্ষণরত। কল্মষ জিজ্ঞাসা করে, "কে ? কে তুমি ?" দেবী বলেন, "দুষ্টচিত্ত কল্মষ ! তোমার বরপ্রার্থনার পর লোকপিতামহ ব্রহ্মা যে 'তথাস্তু' উচ্চারণ করেছিলেন, আমি মূর্তিমতী সেই 'তথাস্তু' বাক্য। আমি ধনধান্যস্বরূপিণী কমলাম্বিকা। তোমার কুকৃত্যের অবসানকল্পে স্বীয় পতি নারায়ণের শালিগ্রামরূপী গর্ভ থেকে সমুৎপন্না। এখন নিজমৃত্যু প্রত্যক্ষ করো।" লক্ষ্মীর শ্রীহস্ত নিক্ষিপ্ত নাগপাশ সশব্দে ছুটে আসে কল্মষের দেহ লক্ষ্য করে। পাকে-পাকে বেষ্টিত হয় সেই দুর্বৃত্ত অসুর। অতঃপর কমলা তাঁর সুতীক্ষ্ণ স্বর্ণময় সৃণির একটি আঘাতে বিদারিত করেন কল্মষের মস্তক। দিকে-দিগন্তরে জয়ধ্বনি ওঠে। ॥ ছয় ॥ পূজাশেষে চোখ মেলেছেন রেবাম্মা। সম্মুখে বাধ্য সন্তানের মতো উপবিষ্ট জলদকান্তি নারায়ণ। বামক্রোড়ে দ্যুতিগাত্রী লক্ষ্মী। যেন কালো পাথরের বুক থেকে বেরোনো প্রাণবন্ত একটি অঙ্কুর। উভয়েরই মুখে সুস্মিত প্রসন্নতা। রেবাম্মার চোখ থেকে অজান্তেই দুফোঁটা জল ঝরে পড়ে। (সমাপ্ত) (ফেসবুকে এক বন্ধুর বাড়ির শালিগ্রাম থেকে বেরোনো অঙ্কুরের ছবি দেখে গল্পটি রচিত।) [ অলংকরণ : অন্বেষা চন্দ্র ]
#গল্প