ডাকঘর নাটক ও প্রথম 'অমল' আশামুকুল
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত 'ডাকঘর' নাটকটি লেখেন ১৯১১ সালে, শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন। নাটকটি প্রকাশ পায় ১৯১২ সালের ১৬ জানুয়ারি। তবে মজার কথা, বাংলায় অভিনয়ের আগেই কিন্তু 'ডাকঘর' ইংরাজি ভাষায় অভিনীত হয়েছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেবব্রত মুখোপাধ্যায় 'Post Office' নামে এই নাটকের অনুবাদ করেন। অনুবাদটির মুখবন্ধ লেখেন বিখ্যাত কবি ইয়েটস। এই অনুবাদটি ডাবলিনের বিখ্যাত অ্যাবি থিয়েটারে অভিনীত হয় ১৯১৩ সালের ১৭ মে।
এই ইংরেজি অভিনয়ের ৮ মাস পর শান্তিনিকেতনে 'ডাকঘর' অভিনয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সেবার শেষপর্যন্ত নাটকটি মঞ্চস্থ হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় জোড়াসাঁকোয় এই নাটক অভিনীত হয় ১৯১৭ সালের ১০ অক্টোবর। তবে তারও আগে, জুলাই মাসে সমাজপাড়া বাল্যসমাজের আয়োজনে মেরী কারপেন্টার হলে মঞ্চস্থ হয়েছিল এই নাটক। সেবারই অমলের ভূমিকায় পাওয়া গিয়েছিল আশামুকুল দাস নামে এক বালককে। কালিদাস নাগের ডায়েরি থেকে জানা যায়, মঞ্চায়নের তারিখ ছিল ৩ জুলাই। সীতাদেবী তাঁর 'পুণ্যস্মৃতি'-তে এই অভিনয়ের কথা লিখেছেন। তাঁর কথায়, "অভিনয় সত্যই খুব ভালো হইয়াছিল।"
জোড়াসাঁকোর অভিনয়েও অমলের ভূমিকায় বেছে নেওয়া হয়েছিল বোলপুরের স্কুলছাত্র আশামুকুলকে। সেই অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তিনটি চরিত্রে অভিনয় করলেন - ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউল। মাধবের চরিত্রে গগনেন্দ্রনাথ, মোড়ল ও কবিরাজের চরিত্রে অবনীন্দ্রনাথ, রাজকবিরাজের চরিত্রে রথীন্দ্রনাথ অভিনয় করলেন। সুধার চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হল অবনীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে সুরূপাকে। মিনিমালিস্টিক মঞ্চসজ্জায় মুগ্ধ করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। আশামুকুলকে অবশ্য প্রথমেই অমল চরিত্রের জন্য বিনা দ্বিধায় বেছে নেওয়া হয়নি। অসিতকুমার হালদারের 'রবিতীর্থে' বই থেকে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় - "একদিন কোনো এক শুভমুহূর্তে কবিকে বন্ধুবর ডক্টর প্রশান্ত মহলানবিশ এসে জানালেন যে আশামুকুল দাস নামে একটি ১০-১২ বৎসরের শিশু অমলের ভূমিকায় ব্রাহ্মসমজাএ 'ডাকঘর' অভিনয় কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছে। 'ডাকঘর' প্লে করবার ভয় রবিদার সর্বদা ছিল এই অমলের পার্ট নিয়ে। ছোট শিশু অথচ স্বাভাবিকভাবে পার্টটি অভিনয় করবে এ ছিল তাঁর ভাবনার অতীত। রবিদা ছেলেটিকে আনতে বলায় মহলানবিশ তাঁকে বিচিত্রায় আনলেন একদিন রবিদার নিকট। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল আশামুকুল অভিনয় করচেন বটে কিন্তু ঠিক লাগসই হচ্চে না। অভিনয় ভঙ্গীর বাড়াবাড়ি করে একটা বিশেষ সুর দিয়ে টেনে টেনে শ্রীমান আশামুকুল যখন অমলের পার্ট বলতে আরম্ভ করলেন; কৃত্রিম আবৃত্তি শুনে কবি হতাশ হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি দিনুদা এবং আমার উপর ভার দিলেন, যদি আমরা শোধরাতে পারি। আমরা দুজনে মিলে আশামুকুলকে তৈরি করলুম অমলের পার্ট নেবার জন্য। রবিদা শুনে খুশি হলেন এবং মনোনীত করলেন আশামুকুলকে।"
আশামুকুলের অভিনয় সত্যিই মুগ্ধ করেছিল সকলকে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লেখেন, "বালক আশামুকুল যেন কবির রচনার অন্তরে প্রবেশ করিয়া অভিনয় করিয়াছিল। রথীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, "সে যেন ওই ভূমিকার জন্য তৈরি হয়েই এসেছিল।" পরে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বিশেষ স্মারকগ্রন্থে আশামুকুলের একটি স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় লিখিত স্মৃতিকথাটির শিরোনাম ছিল 'At Gurudev's Santiniketan'। সেখানে এই অভিনয় বিষয়ে আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে জানা যায় যে, জোড়াসাঁকোর ওই অভিনয়ের মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় গিয়ে রিহার্সাল দিতে হয়েছে তাঁকে। ১৯১৭ সালেই ৩১ ডিসেম্বর এই নাটকের পরবর্তী একটি অভিনয় দেখতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিলেন আশামুকুল। সেই স্মৃতিচারণাও করেছেন তিনি।
.....................
ঋণ : Ashamukul Das, At Gurudev's Santiniketan
#রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #ডাকঘর #আশামুকুল দাস #Rabindranath Thakur #silly পয়েন্ট