নিবন্ধ

একটি দাঁড়কাক ও মৃত্যুবিলাসীর অমরত্বের কাব্য: এডগার অ্যালান পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’

রাজর্ষি গুপ্ত Jan 19, 2021 at 7:32 am নিবন্ধ

চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস বারনাবি রাজ-এর (১৮৪১) পুস্তক সমালোচনায় তিনি অনেক প্রশংসার পাশাপাশি আক্ষেপ করেছিলেন, আরও কেন্দ্রীয় অবস্থান দাবি করা কথা-বলা দাঁড়কাক গ্রিপের চরিত্রটিকে নেহাত মজারু করে না রেখে তাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো ‘প্রফেটিক’ গাম্ভীর্যে উন্নীত করা যেতে পারত। তিনি নিজেই সংশোধনে লাগলেন। ফল— ১৮৪৫ সালের ২৯শে জানুয়ারি নিউ ইয়র্কের ‘ইভনিং মিরর’-এ বেনামে কবিতা ছাপতেই অভ্যস্ত লেখকের স্বনামে ছেপে বেরোল এই কবিতা। এবং দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক চমকপ্রদ গল্প-কবিতা লিখেও সাহিত্যজগতে ঘষটে চলা মানুষটির নাম রাতারাতি আমেরিকার পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দিল। যদিও এতে তাঁর লক্ষ্মীলাভ তেমন কিছু হল না।

মানুষটির নাম এডগার অ্যালান পো, আর সাহিত্যকীর্তিটি তাঁর সর্ববিখ্যাত কবিতা ‘দ্য র‍্যাভেন’। যে ‘র‍্যাভেন’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাত্ত্বিকদের প্রশংসার পাশাপাশি জনগণের আদরও সমানভাবে পেয়ে চলেছে আজও। জনপ্রিয়তা ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ‘র‍্যাভেন’-কে নিয়ে প্যারোডি কিংবা ব্যঙ্গচিত্রও কম বানানো হয়নি। আবার তার সাহিত্যমূল্যকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মতো পণ্ডিতেরাও দেখা দিয়েছেন। ১৮৪৫ থেকে অদ্যাবধি সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত-চলচ্চিত্রে ‘র‍্যাভেন’-এর প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানান রেফারেন্সের তালিকা বানাতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। বিভিন্ন ভাষার অনুবাদকদের কাছেও অন্যতম প্রিয় কবিতা পো’র ‘দ্য র‍্যাভেন’। ফরাসি সাহিত্যের পো-প্রেম সুবিদিত— ১৮৭৫-এ প্রকাশিত ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর ফরাসি অনুবাদটির জন্য কলম ধরেছিলেন প্রখ্যাত সিম্বলিস্ট কবি স্তেফান মালার্মে আর অলঙ্করণ করেছিলেন আধুনিক চিত্রশিল্পের অন্যতম পুরোধা এডওয়ার্ড মানে। ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন টেনিয়েল, গুস্তাভ দরের মতো আরও অনেক দিকপাল চিত্রশিল্পীর নাম। সব মিলিয়ে ‘দ্য র‍্যাভেন’ আজ এক সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়েছে। 

কোন জাদুতে?

উত্তরের দিশা মেলে পো-র প্রবন্ধ ‘দ্য ফিলজফি অফ কম্পোজিশন’ (১৮৪৬) প্রবন্ধে, যেখানে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের গঠনের চুলচেরা বিচার করতে বসে কেস-স্টাডি হিসেবে ‘দ্য র‍্যাভেন’-কে বেছে নিয়ে বলেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এমন এক কবিতা লেখা, “that should suit at once the popular and the critical taste”।

যুগপৎ জনপ্রিয়তা আর তাত্ত্বিক প্রশংসা লাভের জন্য তিনি কোন কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন তার ফিরিস্তি এর পর পো দিয়েছেন এই প্রবন্ধে। কিন্তু খুব ছোট করে বলতে গেলে তার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে কবিতার চিরপুরোনো অথচ চিরনতুন বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রচণ্ড চৌম্বকশক্তিসম্পন্ন এক আপাত-একঘেয়ে সুরে তার উপস্থাপনের মধ্যে। এর জন্যই ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর প্রতিটি পাঠ পাঠকের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার এক-একটি পরত খুলে দেয়। এবং সে গভীরতা থেকে উঠে আসে অন্ধকারের সঙ্গীতমূর্ছনা। সে অন্ধকার কোনও বাহ্যিক ভৌতজগৎকে নির্দেশ করে না কি ইন্দ্রিয়াতীত কোনও অলৌকিকের দুনিয়াকে, কিংবা সেসব ছাড়িয়ে মানবমনের অন্তঃশায়ী অচেনা, অপরিচিত, ভয়সঙ্কুল আঁধারজগতে নিয়ে যায় লেখক-পাঠককে— তার বিচারই ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর পাঠককুল এতাবৎ করে আসছেন। মৃত্যু এবং মৃত্যুশোক সেই জগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সত্যি বলতে, পো-র সাহিত্যজীবনকে চালনা করেছিল এই আঁধারগহন মনোজগতে ডুব দেওয়ার সাধনাই— ‘মেৎজেনগারস্টাইন’ থেকে ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’, ‘দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম’ থেকে ‘লাইজিয়া’, ‘উইলিয়ম উইলসন’ থেকে ‘দ্য টেল-টেল হার্ট’-এর মতো অগুন্তি চমকপ্রদ কাহিনি, যেগুলোকে আমরা প্রায়শই এক-কথায় ‘হরর-থ্রিলার-মিস্ট্রি’ বলে দাগিয়ে দিতে অভ্যস্ত, সেগুলো পড়লে স্পষ্ট প্রতীত হয় এই কথা। ‘দ্য র‍্যাভেন’ সেই সাধনার বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছে বলেই আজ পো-সাম্রাজ্যের রাজকীয় লাঞ্ছন হয়ে দাঁড়িয়েছে দাঁড়কাক।

‘দ্য র‍্যাভেন’ আসলে কবিতার অদ্ভুত ছন্দোময়তায় বলে চলে অত্যন্ত নাটকীয় গুণে ভূষিত একটা গল্প। খাঁটি অলৌকিক গল্পের রীতি মেনে পটভূমি নির্মাণের উপর জোর দিয়ে পো কবিতা শুরু করেন ডিসেম্বরের ঝোড়ো হাওয়া চলা এক মাঝরাতে এক বিরহী প্রেমিককে দিয়ে। প্রেমিকা লেনোরের অকালমৃত্যুর শোক ভুলতে সে তার স্টাডিতে বসে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে পড়াশোনায়। পো-র ভাষায় তার বিষয় হল, “many a quaint and curious volume of forgotten lore”। এহেন সময়ে তার দরজা খটখটিয়ে ওঠে, জানলার পর্দা হাওয়ায় দুলে ওঠে। অবাক হয়ে প্রেমিকটি দরজা খুলে দিয়েও কাউকে দেখতে পায় না বাইরে অন্ধকার কালো রাতের মধ্যে। তার চমকিত, অবাক মনে খেলে যায় আবার লেনোরের উপস্থিতির কথা। সে ফিরে আসতেই আবার একই ঠকঠকানির পুনরাবৃত্তি— এবার জানলায়। এবং জানলা খুলতেই এবারে ‘রাতের অতিথি’-র আবির্ভাব হয়— ডানা ঝাপটে ঘরে ঢুকে পড়ে একটি দাঁড়কাক এবং গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে দরজার ঠিক উপরে আলোর নীচে অবস্থিত দেবী এথেনার একটি মূর্তির মাথায়। কৌতুকবশে লোকটি তাকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম, এবং গম্ভীর স্বরে দাঁড়কাক উত্তর দেয়— “Nevermore”। বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না যে পাখিটির শব্দভাণ্ডার ওই একটি শব্দেই সীমিত, কিন্তু প্রাচীন আখ্যান-কাব্য-মিথোলজি-গুপ্তবিদ্যার ছাত্রটি ততক্ষণে দাঁড়কাকটিকে কতকটা মজার ছলেই দাঁড়কাকটিকে ত্রিকালজ্ঞ ভবিষ্যৎবক্তা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। একের পর এক সে প্রশ্ন করতে থাকে— প্রেমিকার যন্ত্রণাময় স্মৃতিকে সে ভুলতে পারবে কি? প্রেমিকার সঙ্গে তার পুনর্মিলন হবে কি? এবং তার সব আশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে মন্দ্রকণ্ঠে দাঁড়কাক ঘোষণা করে যেতে থাকে— “Nevermore”। ক্রমে ক্রমে লোকটি হতাশার সমুদ্রে ডুবতে থাকে, দাঁড়কাকটিকে ভয় পেতে থাকে। অস্তিত্বসঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে সে পাখির বলা শব্দগুলোকে অবিশ্বাস করতে চায়, তাকে তাড়িয়ে দিয়ে যন্ত্রণামুক্ত হতে চায়— “Take thy beak from out my heart, and take thy form from off my door!” কিন্তু দাঁড়কাক তার স্থান থেকে নড়ে না, তার স্থির চোখ জ্বলতে থাকে ‘স্বপ্নময় শয়তান’-এর মতো (“a demon’s that is dreaming”)। তার ঘরজোড়া ছায়া গিলে ফেলতে থাকে প্রেমিককে— সে জানে যে তার আত্মার আর এই ছায়ার হাত থেকে মুক্তি নেই।

নেহাত অলৌকিক গল্পের রসাস্বাদী পাঠক যে নিছক বিষয়বস্তুর মশলাগুণেই এককথায় এই কবিতাকে লুফে নেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? ডিসেম্বরের হিমরাত এমনিতেই ভূত-প্রেত-স্পিরিট-ডেমনের নাচনকোঁদনের জন্য পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে প্রসিদ্ধ। তার সঙ্গে প্রেমিকার আত্মার উপস্থিতির সম্ভাবনা, বিরহী প্রেমিকের মৃত্যুশোক এবং সর্বোপরি গুরুগম্ভীর গা-ছমছমে রাতে এই দিনচরা কথা-বলা পাখির রহস্যময় আকস্মিক উপস্থিতি, সব মিলিয়ে পাঠককে সার্থক ছোটগল্পের মতো সোজা গল্পের ‘সিনে’ নিয়ে গিয়ে ফেলে। নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টিই শুধু নয়, বিরহে পাগলপারা প্রেমিকের সঙ্গে দাঁড়কাকের ‘কথোপকথনের’ দৃশ্য তৈরি করে আর স্তবকে স্তবকে সাসপেন্সের পারদ চড়াতে চড়াতে যথোপযুক্ত ক্লাইম্যাক্স বুনে পো একপ্রকার সার্থক নাটকই লিখে ফেলেছেন। ‘দ্য টেল-টেল হার্ট’ কিংবা ‘দ্য ফল অফ দ্য হাউস অফ আশার’-এর লেখক পো-র নিজস্বতা এখানে স্পষ্ট— একটা সাধারণ সরলরৈখিক গল্পকাঠামোয় পো এমন নিখুঁতভাবে থমথমে ডিটেলিং বুনে দেন যে গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত অন্তিম ‘এফেক্ট’টির প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। ‘দ্য ফিলজফি অফ কম্পোজিশন’-এ তিনি সে কথা স্বীকারও করেছেন।

অলৌকিক-ছমছমে আবহ এই কবিতার এক স্তম্ভ হলে আর-এক স্তম্ভ হল গাম্ভীর্য। ট্রকেইক ছন্দের অনুবর্তন আর “Nevermore” শব্দের বারংবার ফিরে আসায় কবিতাটি প্রায় মন্ত্রোচ্চারণের গাম্ভীর্য পায়। যন্ত্রণাহর ঔষধ নেপেন্থি, সর্বরোগের মহৌষধ গিলিয়াড, প্রাচীন গ্রিক-রোমান আর ক্রিশ্চান স্বর্গ-নরকের অধিবাসী দেবদূত, দানব আর শয়তানের মতো ধ্রুপদি সাহিত্যবস্তুর উল্লেখ ফিরে ফিরে এসেছে। আবলুশকালো দাঁড়কাকটি খুব উল্লেখযোগ্যভাবেই এসে বসে দেবী এথেনার মর্মরমূর্তির উপর, যিনি গ্রিক পুরাণ অনুসারে দাঁড়কাকের আদি মালকিন— কিন্তু সাদার সঙ্গে কালোর চমকপ্রদ কন্ট্রাস্ট তৈরি করাই কেবল পো-র উদ্দেশ্য নয়। প্রেমিকপ্রবরটি দাঁড়কাককে যে অশুভ মহাজ্ঞানের মুখপাত্র ভেবে তার পায়ে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে (“prophet still, if bird or devil!”) তারই প্রতীক জ্ঞানের দেবীর শুভ্র মূর্তির উপরে ‘ত্রিকালজ্ঞ’ কালো দাঁড়কাকের উড়ে বসা।

পো প্রথমে ভেবেছিলেন ভবিষ্যৎবাণী বলাবেন একটি তোতাপাখিকে দিয়ে। কিন্তু বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য বিচার করে পরে তোতার জায়গা নেয় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকে মৃত্যুদূত, অমঙ্গলের প্রতীক, চতুর অথচ সর্বজ্ঞ বলে পরিচিত দাঁড়কাক। নর্স পুরাণের আদিদেব ওডিনের পোষা দুই দাঁড়কাক হুগিন আর মুনিন তাঁকে জগতের সব খবর এনে দেয়। হিব্রু বাইবেল অনুসারে নোয়া সাদা দাঁড়কাককে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নৌকার বাইরের জলমগ্ন পৃথিবীর খবর আনতে, কিন্তু সেটি তার বদলে শবদেহ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তিনি দাঁড়কাককে কালো হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন। আবার তালমুদ অনুসারে নোয়ার নৌকায় একমাত্র দাঁড়কাকই যৌন সম্পর্ক করেছিল বলেই নোয়া অভিশাপ দিয়েছিলেন। অ্যাপোলো যে সাদা দাঁড়কাককে তাঁর প্রেমিকা করোনিসের উপর নজর রাখতে বলেছিলেন সেটি ফিরে এসে তাঁকে করোনিসের দ্বিচারিতার খবর দিলে তিনি ক্রোধে দাঁড়কাককে পুড়িয়ে কালো করে দেন— সেই থেকে তারা কালো। এত অভিশাপ বহন করলে তো নরকগামী হতেই হবে। ক্রিশ্চানিটিতে তাই দাঁড়কাকের সঙ্গে ডেভিল আর উইচক্রাফটের অনুষঙ্গও খুব সহজেই জুড়ে যায়। পো এই সব কটি দণ্ডবায়সসূত্রকে জুড়ে দিয়েছেন এই কবিতায় (ভূষণ্ডি কাক কিংবা ধূমাবতীর বাহনদের কথা তিনি জানতেন না অবশ্যই, জানলে বেজায় খুশি হয়ে সেই রেফারেন্সও টেনে আনতেন)। এই দাঁড়কাকও বিরহী প্রেমিককে নিশ্চিত করে যে সে তার প্রেমিকাকে আর পাবে না, কিন্তু যন্ত্রণা তাকে চিরকাল পেয়ে যেতে হবে। সে গম্ভীর, সে সব জানে, সে যেন মৃত্যুর আনন্দে আনন্দিত। আর খাঁটি বিব্‌লিকাল শয়তানের ধাঁচে এই জ্বলন্ত চোখের মৃত্যুপক্ষী তার ত্রিকালজ্ঞান ব্যবহারের মূল্য হিসেবেই যেন প্রেমিকের আত্মাকে অধিগ্রহণ করে। যে মৃত্যুলোক থেকে তার আবির্ভাব সেই “Night’s Plutonian shore”-এই (গ্রিক-রোমান পুরাণে মৃত্যুর দেবতা হেডিস বা প্লুটো) সে মানুষটির আত্মাকে নিয়ে পাড়ি জমায়— অন্তত কবিতার শেষে হতাশ্বাস, অর্ধোন্মাদ বক্তার সঙ্গে স্তব্ধবাক পাঠকের সেই বিশ্বাসই জন্মায়।

...................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস] 


#Edgar Allan Poe #American writer #poet #literary critic #short story #The Raven #narrative poem #supernatural #এডগার অ্যালান পো #দ্য র‍্যাভেন #রাজর্ষি গুপ্ত #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

62

Unique Visitors

215846