গল্প

মড়কের ঢাক

তিতাস চট্টোপাধ্যায় Oct 11, 2020 at 6:47 am গল্প

..................

(১)

খাঁ-খাঁ দুপুর। এই সময় গাঁয়ের ঘাটে লোকজন কেউ থাকে না। বেরোতে যাবে, হঠাৎই আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে থেমে গেল হলধর। নিজের মনেই বিড়বিড় করল, "নাহ্, গতিক সুবিধের ঠেকছে না। কিন্তু ছাতিটা কি বিদের কাছে?" 


বিদে হল গিয়ে বিদ্যাধর। হলধরের ছোট ছেলে। বড় ছেলে গঙ্গাধর, মাছের ভেরিতে কাজ করে। বিয়ে-থা করেছে বছরখানেক হল। আর ছোট ছেলে স্কুলে পড়ে। গঙ্গাধরের পড়াশোনায় মন ছিল না কোনও কালেই। তাই নিজের বেসাতি সে নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে। বাপের চাষের জমি নিয়ে তার কোনও হেলদোল নেই। অন্যদিকে বিদ্যাধর। আহা! বড় সাধ করে নাম রেখেছে বিদ্যাধর, যদি বিদ্যার দেবী একটা হিল্লে করেন। পড়াশোনায় মন-টন তো আছেই, তার সঙ্গে সে বড় বাপ-নেওটা। ফাঁক পেলেই চাষের জমিতেও বাবার হাতে হাত লাগায়। গঙ্গার আবার এ নিয়ে চাপা রাগ আছে। গঙ্গার বউ দুলকি তার শাশুড়ি ক্ষান্তমণির কাছে ঠারে ঠারে কম কথা বলেনি। ক্ষান্ত জানে নতুন বউয়ের মুখে মুখ লাগালে গঙ্গা কুরুক্ষেত্র বাধাবে। তাই ক্ষান্ত, ক্ষান্ত দেয় এসবে। ওদিকে বিদের কি কম গুণ! সে যেমন পড়ালেখা করে, তেমনি ঢাক বাজায়। ফি-বছর বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে ঢাক বাজানো তার নেশা। আশ্বিন এলেই মন ভালো হয়ে যায় হলধর আর বিদের। কলকাতা যাবে, মা দুগ্গার সামনে ঢাক বাজাবে, সে কত আহ্লাদ! 


হলধররা চার পুরুষ ধরে ঢাকি। সারাবছর চাষ করে, পুজো-পার্বণে ঢাক বাজায়। গঙ্গাটাকে তো আর এ পেশায় আনানোই গেল না! বলে এসব নাকি ভিখিরিরা করে। আরে ঢাক না বাজলে কি দুগ্গাপুজো হয় নাকি! ঢাকের ওই বোলে চড়েই তো মা কাশবন বেয়ে প্যান্ডেলে আসেন ফি-বছর। 


'নাহ, বিদেটা দেখছি জ্বালালে, বলি ও বিদের মা, ছাতি কোথায় জানো? আকাশে কালোপানা মেঘ করে এল যে", হাঁক পাড়ল হলধর।


মাটির টালিচালের ঘরে বসে নতুন কাঁথায় ছুঁচ পরাচ্ছিল ক্ষান্ত। হলধরের হাঁক শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, "ছাতি তো বিদে নিয়ে গেল। করিমের শরীর ভালো না। ওকে দেখতে গেছে।"


"অ।... তা সে বন্ধুর বাড়ি গেছে যখন... আচ্ছা, এখন কি না গেলেই চলছিল না?"


"কী অলুক্ষুনে কথা। ঘাটপারে নাইতে গিয়ে আমি শুনে বিদেকে বলতেই ও চলে গেল। আর যাবেনি? করিম করেনি সেবার তোমার জন্যে? বাপ-বেটায় মিলে চলে গেলে কলকাতায়। আর চাষের জমির দেখভাল করত কে? ওই ছেলেটাই তো। আর তার লগে তুমি এমন কইবে? কেন গা? তোমার ধম্মের নয় বলে?"


"আহ বউ! যা জানো না, তা বোলো না! আর ওইসব জাত-ধম্ম আমি মানিনে তুমি জানো না? শহুরে কায়দার হাওয়া ওসব। আমার ধম্ম, তোমার ধম্ম। করিমকে আমি পোলার মতোই ভালবাসি, এ কথা কি আজ তোমায় বলে দিতে হবে! কিন্তু কথা সেটা নয় বউ, কথা সেটা নয়। এ বছর মড়ক লেগেছে গো। বড় মড়ক। শহর-গাঁ ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সেদিন মাধব ঘোষালের বাড়িতে খপর দেখাচ্ছিল। দূরে দূরে থাকতে হবে। এক মাইনষের সঙ্গে কী যেন ডিসটেন্ট... যা!

তাই বলছিলাম, করিমের সেই মড়ক রোগ হয়নি তো গা? বিদে আমার গেল যে! সে রোগ যে বড় ছোঁয়াচে!"


কথাটা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ক্ষান্তমণির। তাই তো! ঘাটপাড়ে এ নিয়ে তো হামেশাই কথা চলে। তবে এ রোগ তো কলকাতার, শহরের, এই গাঁয়ে কি আসবে? মনের ভাব মুখে প্রকাশ করল না ক্ষান্ত। বরং একটু ফিকে হাসি এনে কর্তাকে বলল, "কী যে বলো! ওসব কি এখানে হয়! তুমি এসব না ভেবে যাও কোথায় যাবে বলছিলে।"


আকাশের দিকে আর-একবার তাকিয়ে, একটা গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হলধর। যদি বৃষ্টি নামে, অন্তত মাথাটা তো বাঁচবে!



(২)

করিমের শরীর দুর্বল। বিছানায় মাথা রাখা। চোখে কালি। ডাক্তারবাবু দেখে গেছেন। সঙ্গে দিয়েছেন ওষুধ-পথ্যি । বৃষ্টি মাথায় নিয়েই করিমের ছোট্ট চালাটিতে ঢুকল বিদ্যাধর। করিম প্রায় অচেতন। কপালে হাত রাখল বিদে। গা ভালোমতো গরম। আমিনাকে জিজ্ঞেস করল, "বুয়া, ডাক্তার কী বললেন?" আমিনা ছেলের মাথায় জলপটি দিচ্ছিল। বিদেকে দেখে যেন একটু বল পেল মনে। বলল, "বেটা, ছেলে আমার তেরাত্তির কিছু খায় নাই। তু এলি, দেখ তোর ইয়ারকে খাওয়াতে পারিস নাকি।"

বিদে আমিনার হাত থেকে ডালমাখানো গলা ভাতের বাটিটা নিল। আস্তে আস্তে করিমের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল, "করিম, করি, আমি বিদু। খাবি না তুই? এই করিম, একটু তাকা না!" বিদের গলা ধরে আসছে প্রায়। আমিনা দরজার দিকে এগোতে যাবে, হঠাৎ বিদ্যাধরের মনে হল একটা কথা। "বুয়া, ডাক্তার নতুন রোগের চিকিৎসা করলেন?"

আমিনা বুঝল না ঠিক। বলল, " নতুন রোগ?"

"হ্যাঁ, যার জন্যি আমাদের ইস্কুল বন্ধ, যার জন্যি মাধব ঘোষালের পুজোয় প্রসাদ দেওয়া বন্ধ, সেই নতুন রোগ। শহরময় ছেয়ে গেছে তো!"


চোখ বুজল আমিনা। বুকে হাত রেখে বলল, "আল্লাহ্! বিদু বেটা, কী বলিস! এ গাঁয়ে ও রোগ! না, না..."


বিদ্যাধর একটু ম্লান হেসে বলল, "রোগের কি আর গাঁ-শহর, বড়-উঁচু ভেদ আছে বুয়া! ধরা পড়ে গেলে ভয়ের কিছু নেই। যাগগে, তবে ডাক্তার যখন অভয় দিয়েছেন, তখন আর ভেবো না। আমি এখন চলি। আবার খবর নিতে আসব খন।"


মুখে ওড়না চাপা দিয়ে দোর থেকে আমিনা তাকায়। যতদূর বিদেকে দেখা যায়। মনে মনে আল্লার কাছে বলে, এমন রোগ যেন পরম শত্তুরেরও না হয়! বাইরে তখন আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি।


(৩)

কাকভেজা হয়ে বাড়ি ঢুকল হলধর। ক্ষান্ত সাততাড়াতাড়ি উঠে এসে শুকনো কাপড়-জামা ধরিয়ে স্বামীর হাতে দিল। বিদেও ফিরেছে একটু আগে। সবে পড়তে বসতে যাচ্ছে, এমন সময় বাবার ডাক। 

"বিদে, এদিকে আয়। সব পাকা করে এলুম বুঝলি।"

"কীসের বাবা?"

"আরে কীসের কী। জগৎ মাঝির সঙ্গে রফা করে এলুম। দিন দশেকের মধ্যে রওনা দোব, কলকাতা। বোধনের তো বিশেষ দেরি নেই আর!"

"আচ্ছা বেশ।" বলে আবার ঘরের মধ্যে চলে গেল বিদে। বৃষ্টিতে ভিজে আসা ইস্তক বেশ ঠান্ডা লাগছে। 

কলতলায় কাপড় মেলতে মেলতে কথাটা ক্ষান্তর কানে গেছল। একটু দোনামোনা করে কর্তার কাছে এসে বসল ক্ষান্ত। কণ্ঠে মধু ঢেলে বলল, "হ্যাঁ গা, এবারটা কি না হলেই নয়?"

"মানে?"

"নাই বা গেলে কলকাতায়। অত লোক। রেলগাড়ি চলছে না। নৌকা করে যাবে। তায় মড়ক লেগেছে। পুজোর কি জৌলুস থাকবে? তার চাইতে..."

"এ তোমার কেমনধারা কথা বউ! চার পুরুষের প্রথা ছাড়তে বলছ! বলো দেখি, ঢাক ছাড়া দুগ্গা মা আসে? ওই ঢাকের বোলে চড়েই তো... আহা! আমাতে আর বিদেতে যে কী মজা। তা ছাড়া এবারে লাভও বড় কম হবে না বউ। মড়ক মড়ক করে আর কু গেয়ো না তো!"


চুপ করে একটা নিশ্বাস ফেলা ছাড়া ক্ষান্তর আর উপায় নেই। জানে, হলধরের কথার নড়নচড়ন নেই।


(৪)

মাথাটা ভারী হয়ে আসছে, চোখ খুলতে পারছে না।অস্ফুট স্বরে মা-কে একবার ডাকার চেষ্টা করল। সাড়া পেল না। আস্তে করে দরজার কাছে গিয়ে ভাঙা গলায় দাদার নাম ধরে ডাকতে থাকল বিদে। সারা শরীর টলছে ওর। গা হাত পায়ে তীব্র ব্যথা। অনেকবার ডাকার পর দুলকি বেরোল। বলল, "কী ব্যাপার, অত হাঁকডাক কচ্ছিস কেন? তোর দাদা ভেড়িতে!"

"মা-বাবা কাউকে তো দেখছি না!"

"ওরে আমার নবাবপুত্তুর রে, বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমোবেন আর বাড়িসুদ্ধু লোক ওর দরজার সামনে জি হুজুর করার জন্য বোস থাকবে। বাবা চাষের কাজে। আর আজ বিষ্যুদবার। মা হাটে গেছে। একটু খোঁজখবর নাও। খালি বইখাতা নিয়ে বাবুগিরি করলে হবে! যত্তসব!"

এত কথা বলল দুলকি, কিন্তু দেখল না বিদের শরীরটা যেন সব প্রতিরোধ ভেঙে দরজাটাকে শুধু ধরে আঁকড়ে আছে কোনোরকমে। মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল দুলকি। 


(৫)

এই নিয়ে তিনদিন। একটানা জ্বর। বিদের পাশে বসে আছে ক্ষান্ত। বাইরে দাওয়ায় তামাক খাচ্ছে হলধর। ডাক্তার এসে দেখে গেছে। হঠাৎ কার হাতের ছোঁয়ায় একটু চোখটা মেলল বিদে। স্পর্শটা বড় চেনা। অতি কষ্টে তাকিয়ে দ‍্যাখে, আবছা একটা মুখ। মনে হল, করিম যেন বসে আছে মাথার শিয়রে। জ্বরের ঘোরে ভুল দেখল কি!

আবার ওর সমস্ত চোখ জুড়ে আসছে। আর তার মধ্যে কোথায় যেন ঢাক বাজছে। কলকাতা যাবার আর কতদিন বাকি! এবারের কলকাতা কেমন হবে?


(৬)

আশ্বিনের ঝড় বড় দমকা। হঠাৎ হঠাৎ ধেয়ে আসে আকাশ কালো করে, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুমিয়ে থাকে সর্বনাশ। 

এমনটাও কি হবে ভেবেছিল হলধর? আর কদিন পর ষষ্ঠী। ঘরের দোরে ঢাকদুটো পড়ে আছে। একটা ওর, একটা বিদের। 

সিভিয়ার নিউমোনিয়া। ডাক্তার বলেছিলেন। হলধরের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বিদ্যাধর চলে গেল একটা আশ্বিনের জ্বরে।

মড়ক? আর কোন মড়ককে ভয় পাবে হলধর! ওদের চার পুরুষের প্রথা, কিন্তু বিদে নেই। তবু যেতে হবে। ঢাকের বোলে চড়েই যে মা দুগ্গা আসেন। কে যাবে? একা? 

দোরটা পেরিয়ে গঙ্গাকে বলতে যাচ্ছিল হলধর। জানত, তাকে একাই যেতে হবে। তবুও বলতে যাওয়া। সদ্য ছেলেহারা বুড়ো বাপটাকে কি গঙ্গা ফেরাতে পারবে?

"গঙ্গা, ও গঙ্গা, একবার বাইরে আয় না বাপ।"

ভিতরে বসে থুতু দিয়ে সদ্য পাওয়া টাকা গুনছিল গঙ্গা। বাবার ডাক শুনে কোনোমতে টাকাটা আড়াল করে বেরিয়ে এসে বলল, "বলো, কী হল।"

"বলছি, দাওয়ায় বিদের ঢাকটা পড়ে আছে..."

"কী আর করবে, বলো তো ঘরে রেখে দিই।"

"নাহ, বলছিলাম...

চল না বাপ একবার কলকাতা! আর কদিন পর পুজো। ভাবিস না, আমি তোকে ঢাকের বোল শিখিয়ে দেব। তারপর তোতে-আমাতে..."

"শোনো বাবা, আমাকে পাগল ঠাউরেছ! এই মড়কের শহরে ঢাক বাজাতে যাব! ভালো চাও তো, নিজেও যেয়ো না..."

'' কিন্তু না গেলে হবে কী করে গঙ্গা? চার পুরুষের প্রথা। আর ঢাকের বোলে চড়েই তো মা দুগ্গা আসেন, আমরা না গেলে..."

" রাখো তোমার প্রথা। আমি যাব না। হল? বুঝলে? এখন যাও।”

বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল গঙ্গাধর।


আস্তে আস্তে ফিরে আসে হলধর নিজের দাওয়ায়। একবার বিদের ঢাকে হাত বোলায়। 'নাহ, কাল সক্কাল সক্কাল একাই রওনা দিতে হবে, বিদে রে, তোতে-আমাতে আর হল না।'


আশ্বিনের ভোর। চিরাচরিত পুঁটলিটা নিয়ে দরজার দিকে এগোয় হলধর। হাতে ঢাক। ওদিকে অনন্ত কাশবন সেজে উঠেছে। মা আসছে। কেবল বিদে নেই। বেরোতে যাবে যেই, মনে পড়ল, গেঁজেতে টাকা রাখার পুঁটলিটাই নেওয়া হয়নি। কে আর মনে করাবে! এসব তো বিদেই করত। 

এ কী! ঢাক বাজল না? উঠোনে? নাকি! কানের ভুল! ধুর, কে বাজাবে ঢাক। আছে কে এ বাড়িতে আর! কিন্তু না, কানের ভুল তো না, ওই তো ঢাক বাজছে! বিদেই তো এরকম বোল বাজাত। হ্যাঁ তো, এ তারই হাতের শেখানো!


সাততাড়াতাড়ি উঠোনে এসে হলধরের বিস্ময় আর ঘোচে না! এ কী! সাদা সরুপেড়ে ধুতি পরে ঢাক বাজাচ্ছে করিম! ক্ষান্ত ছুটে এসেছে। এসেছে গঙ্গা-দুলকিও। উন্মাদের মতো হলধর এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "এ বাজনা তোকে কে শেখাল বাবা? বিদে?"

করিম উত্তর করল না। কেবল তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে হলধরের হাতদুটো ধরে করিম বলল, "আমায় তোমার সঙ্গে নেবে, চাচা?"


নদীতে পাল তোলে নৌকা। আশ্বিনের নীল আকাশ। যতদূর দেখা যায় নৌকায় হলধর, করিম আর বিদের ঢাক...




[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]

#silly পয়েন্ট #গল্প #রবিবারের গল্প #Story #Bengali Story #Sunday Story #তিতাস চট্টোপাধ্যায় #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

40

Unique Visitors

215815