ওরিও বিস্কুট ও পদার্থবিজ্ঞান : এ ক্রিমের ভাগ হবে না!
ক্রিমক্র্যাকার বা মেরি বিস্কুটের একঘেয়ে গল্প নয়, এ গল্প হল গাঢ় বাদামি মুচমুচে আস্তরণের মধ্যে ঠাসা ভ্যানিলার ভালোবাসার গল্প। আমাদের রোজনামচায় ওরিও-র প্রবেশ হয়তো বছর দশেকের বেশি নয়, কিন্তু পৃথিবীর বুকে তার ম্যাজিক চলছে সেই ১৯১২ সাল থেকে! দুইখানি ওয়েফার কুকির মাঝে মিষ্টি ক্রিমের পরত, গোগ্রাসে চিবিয়ে খান অথবা আলাদা করে ক্রিমটুকু চেটে নিন, তার স্বাদ আপনার মন ভালো করে দেবেই। কিন্তু এই দুটো ওয়েফার আলাদা করে খাওয়ার পদ্ধতি নিয়েই হয়ে গেল আস্ত একটা আন্তর্জাতিক গবেষণা!
ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির একদল গবেষক সম্প্রতি হাতেকলমে প্রমাণ করেছেন, ওরিও-র ওয়েফার দুটিকে যেভাবেই আলাদা করা হোক না কেন, ক্রিমটা কোনোভাবেই সমান ভাগ করা যাবে না। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এ তো জানা কথা, ওরিও খেতে গেলে আমরা হামেশাই দেখেছি ক্রিম সবসময় বিস্কুটের কোনও না কোনও একটা ভাগে আটকে থাকে। চাই কী, বেশি টানাহ্যাঁচড়া করলে খাবলা হয়ে উঠে আসতে পারে, কিন্তু দুদিকে সমান ভাবে সে যাবে না। এহেন সাধারণ পর্যবেক্ষণই বিজ্ঞানীদের কাছে হয়ে উঠল ফ্লুইড গতিবিদ্যার এক জটিল ধাঁধা। কোনও তরল, অর্ধতরল বা গ্যাসীয় পদার্থের প্রবাহের যে গতিবিদ্যা, তাকে পোশাকি ভাষায় বলে রিওলজি (Rheology)। ওরিও-র ক্রিমের যে অর্ধতরল প্রকৃতি, তার গতিবিজ্ঞানের চর্চাকে তাই গবেষকরা নাম দিয়েছেন ‘ওরিওলজি’। হঠাৎ ওরিও নিয়ে একটা আলাদা শাখা তৈরি করার প্রয়োজন হল কেন? এর কারণ লুকিয়ে আছে ওরিও ক্রিমের ওই একচোখামিতে। বিজ্ঞানীরা নিরলস ভাবে গবেষণা চালিয়ে, সম্ভাব্য সবরকম ভাবে ওরিও-র ওয়েফার দুটিকে আলাদা করে দেখেছেন, মাঝের ক্রিমটুকু কোনোভাবেই সমান আস্তরণে দুদিকে বিন্যস্ত হয় না। এই কাজে তারা রোবোটিক্সের সাহায্য নিয়েও দেখেছেন, হয় একদিকের ওয়েফারে পুরো ক্রিম চলে আসে অথবা আধখানা চাঁদের আকারে ক্রিম খাবলা হয়ে লেগে থাকে দুদিকেই।
এ এক অতি আশ্চর্য বিষয়! সাধারণ প্রোব্যাবিলিটির তত্ত্ব বলে, কোনও ঘটনার সম্ভাব্য সবকটি ফলাফলই কোনও না কোনও একবার সংঘটিত হবেই। ওরিও ক্রিমের পুরু আস্তরণের দুদিকে সমান ভাবে ভাগ না হওয়ার পিছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন স্বাদের ক্রিম নিয়ে, ওরিও বিস্কুটকে কখনও দুধে আবার কখনও অন্য তরলে চুবিয়ে বারবার পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। শেষে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ওরিও বিস্কুট তৈরির পদ্ধতিতেই ক্রিমের একদিক বেশি ভারি হয়ে যায়। একটি ওয়েফারকে জমি হিসেবে ব্যবহার করে তার উপর ক্রিমের আস্তরণ চাপানো হয়, তারপর চাপানো হয় আরেকটি ওয়েফার। এই ঘটনায় নিচের ওয়েফারের ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন ক্রিমের ঘনত্ব উল্টোদিকের ওয়েফারের গায়ে লেগে থাকা ক্রিমের তুলনায় বেশি হয়। তাই হাজার চেষ্টাতেও পুঁজির অসম বন্টন আটকানো যায় না।
বিজ্ঞানীদের কাছে এই গবেষণা এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে, যেখানে একমাত্র পাথেয় ওরিও ক্রিমের সমান ধর্মবিশিষ্ট অর্ধতরল পদার্থ। গবেষকদলের অন্যতম মুখ্য সদস্য ক্রিস্টাল ওয়েন্স জানিয়েছেন, তাঁর থ্রি-ডি প্রিন্টিং সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতিতে এই গবেষণার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। ঘটনাচক্রে ওয়েন্সের ঝুলিতে থাকা একটি বিশেষ ধরনের কালি, যা কিনা কোনও বস্তুর ত্রিমাত্রিক অবয়ব বানাতে কাজে লাগে, তাকে দেখতে-শুনতে খানিকটা ওরিও ক্রিমের মতোই। এহেন থ্রি-ডি কালির মাধ্যমে একসারি কার্বন ন্যানোটিউব থেকে বানিয়ে ফেলা যায় অতি সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ। আর এই কাজের গুণগত মান নির্ভর করে কালির ফ্লুইড গতিবিদ্যার উন্নতিসাধনের উপর। ওরিও ক্রিম গবেষণা এই কাজটিকেই কয়েকধাপ এগোতে সাহায্য করেছে – এমনটাই দাবি ক্রিস্টাল ওয়েন্সের। তাঁর সে দাবি ঠিক না ভুল, সে বিচার সময়ের হাতে। আমরা আপাতত এইটুকু জেনেই খুশি থাকি যে ওয়েন্সের গবেষণায় দেখা গেছে, ওরিও বিস্কুট দুভাগ করার সবচাইতে দ্রুত পন্থা হল ওয়েফার দুটোকে আলতো প্যাঁচ দিয়ে খুলে ফেলা। এবার দেরি না করে হাতেকলমে পরীক্ষা করে ফেলুন দেখি!
********************************
তথ্যসূত্র: On Oreology, the fracture and flow of milk’s favorite cookie, Physics of Fluids