অথঃ পাতুরি পদাবলি
কনফুসিয়াস বলেছিলেন- “আহারে স্বর্গের স্বাদ”। আর সেই আহারনামায় যদি থাকে পাতুরির যোগ তাহলে তো কোনও কথাই নেই। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই পাতুরির উল্লেখ করেননি। সম্ভবত ‘পাতড়া’ শব্দ থেকে পাতুরি শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ যে খাদ্যদ্রব্য পাতায় মুড়ে প্রস্তুত করা হয় মোটাদাগে তাকে পাতুরি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ভোজনবিলাসী বাঙালির খাদ্য-তালিকায় পাতুরির যোগ ঠিক কবে থেকে তার সালতামামি নির্দেশ করা হয়তো সম্ভব নয়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এই যে, স্বাদে ও আঘ্রাণে পাতুরি অতিউপাদেয় একটি রসবস্তু হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় পাতুরির উল্লেখ তুলনায় অনেক কম। তবে পাতুরির প্রস্তুতির আভাস দিয়েছিলেন মুকুন্দ মিশ্র। কবির ‘বাঁশুলীমঙ্গল’ কাব্যে দেখা যায় যে স্বামী ধূসদত্তের জন্য রুক্মিণী যেসব রান্না প্রস্তুত করেছিলেন পাতুরিও তাদের মধ্যে একটি। এখানে সর্ষে সহযোগে মাছের পাতুরির উল্লেখ রয়েছে। মাছের পাতুরির কথা যখন উঠলই তখন বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের জবানবন্দি ছাড়া তা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। বিপ্রদাসের মতে সব মাছেরই পাতুরি হয়। কিন্তু বড় কইমাছের পাতুরি হলে আরও ভালো হয়। তবে রন্ধন-বিশেষজ্ঞদের মতে ছোট ও কম কাঁটাযুক্ত মাছের পাতুরিই বেশি স্বাদু।
আসলে পাতুরি মোটামুটি সবরকম উপাদান সহযোগেই হতে পারে। অর্থাৎ নিরামিষ ও আমিষ দুই-ই পাতুরিতে থাকতে পারে। আবার পাতুরি রান্নায় ঠিক কোন পাতা ব্যবহার করা হচ্ছে সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাতুরি রান্নার মুখ্য উপকরণ কলাগাছের পাতা। আগুনের ভাপে হালকা করে সেঁকে নিলে কলাপাতা ভাঁজ করা সহজ হয়। এরপর রাঁধুনির হাতযশে নিরামিষ বা আমিষ রান্না হয়ে উঠতে পারে অতুলনীয়। সাধারণত পাতুরিতে কলাপাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকলেও শালপাতা, হলুদ গাছের পাতা, লাউপাতা প্রভৃতি ব্যবহার করা চলে। এই পাতা ব্যবহারের মধ্যেও আঞ্চলিকতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন মেদিনীপুর ও উড়িষ্যার দিকে শালপাতায় পাতুরির বেশ প্রচলন আছে। ওইসব এলাকায় শালবনের প্রাচুর্য এর অন্যতম কারণ। অনেকসময় আবার কীসের পাতুরি রান্না হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে পাতুরির জন্য উপযুক্ত পত্রচয়ন। যেমন ধরুন যদি পুঁটি মাছ বা ছোট মাছের সর্ষে-পাতুরি রান্না হয় সেক্ষেত্রে হলুদ গাছের পাতাই প্রশস্ত। ছোট মাছের নিজস্ব স্বাদের সঙ্গে সর্ষেবাটা ও সর্ষের তেলের যুগলববন্দি ঘটে এবং তার সঙ্গে যদি হলুদের মৃদু আঘ্রাণ জড়িয়ে থাকে তাহলে সেই রান্নার স্বাদের মাত্রা অনেকদূর পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আবার ভাতের মধ্যেই মাছের সঙ্গে জুতসই মশলা মিশিয়ে লাউপাতায় মুড়ে ভাপে দেওয়া হয়। অবশ্য সেক্ষেত্রে পাতুরির পাতা পুড়ে তৈরি হওয়া অনাবিল গন্ধটুকু অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায় ডাল-পাতুরি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। শুকনো শুকনো করে মুসুর ডাল বেটে পরিমাণমতো নুন, লংকা, টমেটো, ধনেপাতা মিশিয়ে আলতো করে কলাপাতায় মুড়ে আঁচে বসিয়ে এই পাতুরি রান্না করা হয়। রান্নার পরে মুসুর ডাল শক্ত হয়ে ঠিক কেকের মতো দেখতে হয়ে যায়। গরম ভাতে তার আস্বাদন উপমাহীন। একই পদ্ধতিতে তৈরি হয় কচুর পাতুরি। কচুর লতির সর্ষে-পাতুরিও একটি উপাদেয় খাবার। ইদানিং নিমন্ত্রণ বাড়ির মেনুকার্ডের দৌলতে ভেটকি মাছের পাতুরির সঙ্গে সকলেই কমবেশি পরিচিত। এই ধরনের পাতুরি তৈরি হয় সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে। কখনও আঁচে তাওয়া বসিয়ে তার উপর হালকা তাপে পাতুরি তৈরি করা হয়। দ্বিতীয়ত, গরম জলের ভাপেও পাতুরি হয়ে থাকে। কিন্তু উপরের দুটি পদ্ধতির কোনোটিতেই পাতুরির প্রকৃত স্বাদ জোটে না। মাটির উনুনে সব রান্নার শেষে ছাইয়ের গরম আঁচে যে পাতুরি রান্না হয়, তার স্বাদ হয় সবথেকে সেরা। পাতাপোড়ার আলতো গন্ধ যদি নাই পেলুম তবে পাতুরি খাওয়ার সার্থকতা থাকে কই! হালফিলের স্মার্টফোনে রান্নার লাইভ ইউটিউব-ভার্সন যেহেতু সবার কাছেই সহজলভ্য তাই পাতুরি রান্নার আয়োজন অনেকেই করতে পারেন। কিন্তু সেকালের হেঁশেলের মাটির উনুন আর দক্ষ রাঁধুনির হাতযশ ছাড়া পাতুরি কি আদৌ সম্ভব!