গভীর বিজন পথে
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের উত্থান, অগ্রগতি ও পরিব্যাপ্তির খতিয়ানে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই ত্রয়ী নাট্যব্যক্তিত্বের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে অউদিপাউসে শম্ভু মিত্রের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের গভীর মনস্বিতা; মঞ্চে- আলোয়-নিয়মনিষ্ঠ প্রযোজনায় উৎপল দত্তের দাপুটে দিন বদলের স্বপ্ন; ব্রেশট্, চেকভ, পিরানদেল্লোকে দুমড়ে-মুচড়ে বাঙালির অস্থি-মজ্জা দেওয়া অজিতেশের বিরাটত্বের সমান্তরালেই আরেকজন ব্যক্তি তাঁর ছোট্ট একতারাটা হাতে নিয়ে গ্রাম বাংলার রাঙা ধুলোয় বিজন পথের পথিক হয়ে হেঁটে গেছেন বহুদূর। তিনি বিজন ভট্টাচার্য। সারাটা জীবন তিনি এই পোড়া বাংলার ছাইয়ে অরূপরতন খুঁজেই বেরোলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের অবকাশে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা তাঁর ভাগ্যে সইল না।
বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯১৫ সালের ১৪ বা ১৭ জুলাই, বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্যের চাকরির সূত্রে গ্রামবাংলার মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। প্রথমে গান্ধীজির অহিংস রাজনীতির সক্রিয় সদস্য হলেও চল্লিশের দশকে তিনি কমিউনিষ্ঠ পার্টির সদস্যপদ পান। প্রগতি লেখক সংঘ ও গণনাট্য সংঘের হয়ে ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’ এবং অবশ্যই ‘নব্বান্ন’-এর প্রযোজনা তাঁকে যেমন নাট্যকাররূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তেমনই বাংলা নাট্যমঞ্চের গতিপথকেই সম্পূর্ণ অন্য খাতে নিয়ে গেছে। ১৯৪৮-এ গণনাট্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি নিজের নাট্যদল ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ তৈরি করলেন। বিভিন্ন কারণে দু’দশকে মাত্র ন’টি মঞ্চ প্রযোজনার পর নতুন দল ‘কবচ-কুণ্ডল’ তৈরি করেন। অর্থকষ্টের জন্য কিছুদিন মুম্বাইতে হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্যও লেখেন। প্রায় পঁচিশটির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পূর্বে উল্লিখিত নাটকগুলি ছাড়াও তাঁর লেখা নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম হলো হাঁসখালির হাঁস, গোত্রান্তর, ছায়াপথ, মরা চাঁদ, দেবীগর্জন, গর্ভবতী জননী প্রভৃতি। তাঁর নাট্যকার সত্তার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর গল্পকারের জীবন। মৃত্যু- ১৯ জানুয়ারি, ১৯৭৮।
বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যজীবনের সূত্রপাত কোনো পেশাদার মঞ্চে নয়। শিশির ভাদুড়ির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি তো থিয়েটারের লোক নই। রাস্তায় শিখেছি।” একদিকে শৈশবের সাপুড়েদের সঙ্গে আড্ডা, মুসলমান জেলেদের সঙ্গে টুনি মাছ ধরা, শুয়োর ধরার জন্য জাল বিছানোর কায়দা তাঁকে নাট্য উপাদানের রাস্তা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে কলকাতার রাস্তায় তিনি দেখেছেন অনাহারে মৃত্যু, স্বাধীনতাকামী বালকের বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু। গণনাট্য সংঘে এসে এই দুই জীবনের মিশ্রণ ঘটেছে। নবান্নের দুর্ভিক্ষ, জীয়নকন্যার দেশভাগ, অবরোধের শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব, জননেতার দুর্নীতি, দেবীগর্জনের তেভাগা আন্দোলন নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন গ্রাম- গ্রামান্তরে। একই সঙ্গে জীয়নকন্যায় গীতিনাট্যের ফর্মের বেদেদের গান, মরা চাঁদে উত্তরবঙ্গের অন্ধ বাউলের গান, দেবী গর্জনে পুরাণের ব্যবহার নিয়ে তিনি বাংলার লোকনাট্যের আঙ্গিক দিয়ে ঢেলে সাজাতে চেয়েছেন থিয়েটারশিল্পকে। দুই বঙ্গের মাটি থেকে তুলে আনা ভাষা আর গান দিয়ে একটা সিনথেসিস করতে চেয়েছিলেন তিনি। দেশের সময়কে তার শিল্পের জল-কাদায় মিশিয়ে এভাবে প্রতিমা নির্মাণের সচেতনতায় সমসাময়িকে তিনি অনন্য।
সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি বলতে পেয়েছেন মাত্র তিনটি পুরস্কার। অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা বাদই দিচ্ছি। অবশ্য তা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল বলে মনে হয় না। সুনীল দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন যে, এক যাত্রাদল অনেক টাকার বায়না নিয়ে এসেছে ‘দেবীগর্জন’ নাটকটার জন্য। তাদের শুধু এটাই বাড়তি অনুরোধ, আদিবাসী মেয়েটার ধর্ষণ দৃশ্যটা ‘জমিয়ে’ করে দিতে হবে, তাহলে পালাটা হিট হবে। ঘরে রেশন কেনার টাকা নেই, সামনে অনেকগুলো টাকার বায়না। তিনি উত্তর দিলেন, “আমি দিমু না, আমার টাকারও দরকার নাই, নামেরও প্রয়োজন নাই”। আজীবন বিশ্বাস করেছেন গণের উপস্থিতি ছাড়া নাটক হয় না। আবেদন ছিল একটাই, নেহাত কোনো স্লোগানধর্মী চটক নয়, বরং নাটক করতে হবে মাটির ইতিহাস-সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে। আফসোস ছিল একটাই, বৃহত্তর ‘মাসের’ কাছে তাঁর নাটক পৌঁছল না। সারাজীবন এই একরোখা আদর্শে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে পরিবার থেকেও দূরে সরে গেছেন।
আসলে বিজন ভট্টাচার্য এক অগোছালো, দরদী, আবেগপ্রবণ কবি। মঞ্চের আলো ঠিক করতে গিয়ে যার জীবনের কবিতার লাইন ভেঙে ভেঙে গেছে। নাটকের প্রতিটি স্বর-প্রক্ষেপণে তাঁর সেই বেদনার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরেও জীবনের প্রতি, নাটকের প্রতি, আদর্শের প্রতি তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভাঙা সেতারটা জুড়ে নিয়ে অরূপরতনের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। নইলে কেন মৃত্যুর দু’দিন আগেও তিনি মরাচাঁদ নাটকের অভিনয় করবেন। যেখানে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত অন্ধমানুষ পবনের কণ্ঠে তিনি গেয়ে উঠবেন,
“বাঁচব বাঁচব রে, আমরা বাঁচব রে বাঁচব
ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাঙলা গড়ব”।
#নিবন্ধ