যৌনতা নয়, জীবনের পাঠ
ওয়েব সিরিজ: সেক্স এডুকেশননির্মাতা: লরি নানশ্রেষ্ঠাংশে: আসা বাটারফিল্ড, এমা ম্যাকি, জিলিয়ান অ্যান্ডারসন, এনকুতি গাটওয়া, কনর সুইন্ডেলসপরিবেশক : নেটফ্লিক্স
সেক্স এডুকেশন। নব্বইয়ের দশকে জন্মানো যেসব বাচ্চারা স্কুলজীবনে একটু বেশি পাকা ছিল, তাদের অনেকেরই হয়তো খবরের কাগজে বা টিভি চ্যানেলে দু’একবার এই শব্দটির সঙ্গে মোলাকাত হয়ে থাকবে, জীবনবিজ্ঞানের জনন অধ্যায়টির সুবাদে হয়তো বিষয়টি সম্বন্ধে আবছা ধারণাও জন্মাতে পারে। কিন্তু ওইটুকুই সার, তার বেশি জানতে চাইলেই জুটত মা বাবার বকুনি, বা গুরুজনের সমালোচনা। কারণ? ওসব নাকি ‘বড়দের’ ব্যাপার!
বস্তুত, যৌনতা নিয়ে ছুৎমার্গ আমাদের প্রাক্তন শাসকদের দেশেও বড় কম নয়। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, ইংল্যান্ডের কথাই বলছি। অনেকেই একথা বলে থাকেন, যৌনতা বিষয়ক যে ঢাকঢাক গুড়গুড়ের রেওয়াজকে আমরা ভদ্রলোকীয় সংস্কৃতি বলে বুক ফুলিয়ে জাহির করি তা নাকি অনেকাংশেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভিক্টোরিয় ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রভাব। মনে পড়ে ট্রেন টু পাকিস্তান উপন্যাসে খুশবন্ত সিংহের মন্তব্য, যে দেশে যৌনতা নিয়ে ছুৎমার্গ যত বেশি, প্রকৃতপক্ষে সেই দেশ যৌনতা নিয়ে তত বেশি আগ্রহী। তাই বোধহয় সভ্য ইংল্যান্ডে রাজপরিবারের আভ্যন্তরীণ যৌন কেলেঙ্কারির খবর জোগাতে নিয়মিত খরচ হয় কোটি কোটি নিউজপ্রিন্ট, আর সংস্কৃতিবান ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র পরিবেশক শহর মুম্বইয়ে নির্মিত নব্বই শতাংশ ছবির মূল বিষয় হল প্রেম ও যৌনতা। দ্বিচারিতায় ভরা এহেন পরিবেশে তাই নেটফ্লিক্সের সেক্স এডুকেশন নামক ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজখানি যেন বেপরোয়া এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতোই। এই কাহিনির প্রধান কুশীলব ইংল্যান্ডের কোনো এক পাবলিক স্কুলে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় উপনীত কিছু ছেলেমেয়ে এবং তাদের জীবন কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিচিত্র সব ঘটনা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যৌনজীবন নিয়ে একাধারে প্রবল আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতার অভাব লক্ষ্য করে ওটিস মিলবার্ন এবং মেইভ ওয়াইলি জুটি বেঁধে স্কুলের মধ্যেই তাদের গোপনে যৌনজীবন বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার ব্যবসা ফেঁদে বসে। বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের যৌনজীবন সংক্রান্ত সমস্যা দিয়ে প্রত্যেকটি পর্ব শুরু হলেও শরীরের সুড়সুড়ি অতিক্রম করে এই সিরিজের প্রকৃত বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে যুবসমাজ, তাদের মন জুড়ে থাকা হরেক রকম আশা আকাঙ্ক্ষা সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার খোঁজ। চরিত্রহীন পিতা ও বিবাহবিচ্ছিন্না সেক্স থেরাপিস্ট মায়ের সন্তান ওটিসের জীবনে স্বাধীনতার বড় অভাব, মায়ের অতিরিক্ত মনোযোগ যে কখন ছেলের গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসছে তা তিনি বুঝতে পারেন না। মেইভ ওয়াইলির সমস্যা ঠিক উল্টো, অভিভাবকের স্নেহ থেকে সে বরাবরই বঞ্চিত, উল্টে তাকেই সময় বিশেষে মাদকাসক্ত মা অথবা দায়িত্বজ্ঞানহীন দাদার দেখভাল করতে হয়। হেডমাস্টার গ্রফের ছেলে অ্যাডাম বাবার প্রচণ্ড প্রত্যাশার ভারে ক্লান্ত, তার আত্মবিশ্বাসের পথে বাড়তি কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় তার উভকামিতা। প্রত্যাশার চাপ অসহ্য হয়ে দাঁড়ায় জ্যাকসনের পক্ষেও- তার শ্বেতাঙ্গিনী মা ছেলেকে এক নম্বর অ্যাথলিট বানাতে বদ্ধপরিকর, কারণ তিনি দেখিয়ে দিতে চান দুটি সমকামী মহিলা দ্বারা পালিত সন্তান প্রতিভায় কারো থেকে কম যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জ্যাকসনের কৃষ্ণাঙ্গী মা কিন্তু ছেলের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। কৃষ্ণাঙ্গী ও সমকামী- এই দ্বিমুখী প্রান্তিকতাই কি তাঁকে অধিকতর সংবেদনশীল হতে সাহায্য করেছে? জাতিভেদের ভয়ে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে থাকা এরিকের পিতা মেনে নিতে পারেন না সন্তানের সমকামী পরিচয়, তাঁর ভয় সমকামিতা তাঁর ছেলেকে করে তুলবে বর্ণবিদ্বেষের সহজ শিকার। লক্ষণীয়, সিরিজে প্রদর্শিত সবকটি পরিবারের মধ্যে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারটি এরিকের, এবং তাদের মধ্যেই পারিবারিক সম্পর্কের বুনোট সবচেয়ে দৃঢ়। বাদ যায়নি অলিভিয়ার মত অনাবাসী ভারতীয় পরিবারে বেড়ে ওঠা তরুণীর কথাও। হাসির মোড়কে তুলে আনা হয়েছে যৌন হয়রানি, বিকল্প যৌনতা, মানসিক বিকার ও বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যার মতো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়। ব্রিটিশদের সর্বাধিক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আইকন মহাকবি শেক্সপিয়রের আ মিডসামার নাইটস ড্রিম নাটকটিকে যেভাবে আগাগোড়া যৌনতার মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে তা অবশ্যই সাহসী এবং অভিনব, দেখতে গিয়ে ডেড পোয়েটস সোসাইটি বা গেট ওভার ইট প্রভৃতি ছবিতে এই নাটকের প্রসঙ্গ মনে পড়তে বাধ্য। এখানে বলা উচিত, সিরিজটির উপর শেক্সপিয়রের টেমিং অফ দ্য শ্রু অবলম্বনে নির্মিত টেন থিংস আই হেট অ্যাবাউট ইউ ছবির প্রভূত প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নানারকম ঘটনার ফাঁকেই বারেবারেই উঠে আসে যৌনতা বিষয়ক পড়াশুনোকে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে নিয়মিত ভাবে যোগ করবার বিতর্কিত বিষয়টি। প্রধান শিক্ষক ও অভিভাবকদের যাবতীয় ছুৎমার্গ নস্যাৎ করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা জানায়, ওটিসের মা জিন মিলবার্নের পেশাদার পরামর্শে বিশেষ উপকৃত হয়েছে তারা। অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনয় উপহার দিয়েছেন আসা বাটারফিল্ড, দ্য বয় ইন স্ট্রাইপড পাজামাস, হুগো, মিস পেরেগ্রিনস হোম ফর পিকিউলিয়ার চিলড্রেন প্রভৃতি ছবির দ্বারা শিশু বয়সে পুষ্ট হয়েছে যার অভিনয় জীবন, তার থেকে তো ঠিক এতটা ভালো কাজই প্রত্যাশিত। মেইভ ওয়াইলির চরিত্রে এমা ম্যাকির সাবলীল অভিনয় ইতিমধ্যেই তাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি এনে দিয়েছে। আলাদা করে বলতে হবে ওটিসের প্রিয় বন্ধু এরিকের চরিত্রে এনকুতি গাটওয়া ও স্নেহবঞ্চিত, আত্মপ্রত্যয়হীন, প্রকাশে অক্ষম অ্যাডামের চরিত্রে কনর সুইন্ডেলসের মর্মস্পর্শী অভিনয়ের কথা। নির্মাতা লরি নানের সাথেই প্রশংসা প্রাপ্য টোলগা কাহরাম্যান, ম্যাট বিফা, সিয়ারা লুইস প্রমুখ সিরিজের বিভিন্ন সঙ্গীত পরিচালকদের। জেমি কেয়ার্নি ও ওলি রাসেলের সিনেম্যাটোগ্রাফি সিরিজের মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিটি ফ্রেম ভরিয়ে তুলেছে ঝকঝকে ঔজ্জ্বল্যে। করোনাভাইরাসের বাধা পেরিয়ে তৃতীয় সিজনের শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে, কুচুটে আইজ্যাকের কারণে ওটিস ও মেইভের সম্পর্কে আসবে কোন নতুন মোড়- আপাতত সেটা জানতেই অধীর আগ্রহে সারা পৃথিবী জুড়ে অপেক্ষা করছে সেক্স এডুকেশন সিরিজের ভক্তকুল।