পড়শিদের কথা : দুর্গা টুনটুনি
পাখিদের ইস্কুলে একই নামে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর বাস। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পদবী বদলে বদলে যায়। যেমন আমাদের আজকের পড়শির নাম দুর্গা টুনটুনি। 'টুনটুনি' নামটির সঙ্গে আমরা ছোটোবেলা থেকে পরিচিত হলেও ইনি কিন্তু রঙে-ঢঙে বেশ অনেকটাই আলাদা।
পাখিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের একেবারে প্রথম দিকে ইনি নিজে থেকেই একদিন আসেন। এবং সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ইনি শুধু আমাকে ছুটিয়েছেন, নাকাল করেছেন। ছাদে সেদিন পায়চারি করছি। সূর্য সেদিনকার মতো বিদায় নেবে নেবে করছে। এমন সময় বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের সুপুরিগাছ থেকে একটা মৃদু মিষ্টি আওয়াজ কানে এল। পাখির ঠিক অমন ডাক কানে আসেনি আগে, ঠিক যেন শব্দ হচ্ছে ‘চি হুইট চি হুইট’।
এক ঝলকে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। বেশ খানিক সময় চোখ চালিয়ে দেখলাম ক্ষুদ্রকায় একটি কালো রঙের কিছু তিরতির করছে গাছের ঠিক মাথায়। আরে না না! ঠিক কালো তো নয়, গলার কাছটা যেন কেমন নীলাভ বেগুনী চিকচিক করে উঠল। পড়ন্ত আলোয় এ পাখির রং বোঝা যে সে লোকের কম্মো নয়।
আমার এই পড়শিটি বড্ড দুরন্ত। এই এক ডালে তো পলক ফেলতে না ফেলতেই অন্য ডালে। আর ছবি তোলার সুযোগ দেওয়া এর ধাতে নেই। যদি বা দেন কখনও, বাঁকানো সরু ঠোঁট ফুলের মধ্যে ঢুকিয়ে বসে থাকেন। ওভাবেই তাকে লেন্স-বন্দী করা যায়। ওই মধুর লোভেই তবু তাকে দু'দন্ড একজায়গায় বসিয়ে রাখা যেতে পারে। তাই এর আরেক নাম ‘মধুচুষকি’। মধু খাওয়ার জন্য এরা ঠোঁট ফুলে ডুবিয়ে ডানা ছড়িয়ে ঝুলে থাকতে পারে শূন্যে। পশুপাখিদের মধ্যেও কিন্তু নারী-পুরুষ দৈহিক পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। সেদিন যাকে ছাদে দেখেছিলাম সে ছিল পুরুষ। তার গায়ের রং ধাতব বেগুনি বা গাঢ় নীল। একটু আলো পড়লেই দেখা যাবে বুকে পেটে লাল, কখনো হালকা হলুদ রঙের অগোছালো দু'একটা পালক… দেখা দিয়েই হারিয়ে যাবে আবার। অভিযোজনগত কারণেই ঠোঁটটি সরু এবং বাঁকানো ।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি দুর্গা টুনটুনির ইংরাজি একখান নাম রয়েছে। Purple Sunbird। 'পার্পেল' নামকরণ সে অর্থে পুরুষ পাখিটির গায়ের রং মাথায় রেখেই। মহিলা-দুর্গা টুনটুনির গায়ের রং এক্কেরে আলাদা। পিঠের দিকটা ধূসর জলপাই রঙা আর পেটের দিকটা মন ভোলানো হালকা হলুদে রাঙানো । ঠোঁটটি তারও অমনই বাঁকানো। আরে বাবা, নারী হয়ে জন্মেছে বলে কি তার মধু খাওয়া আটকানো যায়! এই একরত্তি দুর্গাটুনটুনির দৈর্ঘ্য বড়জোর ১০ সেন্টিমিটার।
পুরুষ পাখিটি গান গাইতেও বেশ ওস্তাদ। বলা চলে ওই গানের সুর দিয়েই সে প্রেমরসে জড়ায় মহিলা-দুর্গা টুনটুনিকে। ব্যাস তারপরেই কেল্লা ফতে। সংসার তিনি পাতলেন বটে, এদিকে বাসা তো বাঁধতে হবে স্ত্রী টুনিকে। পুরুষ পাখিটি মাঝে মাঝে এসে একটু ইন্সট্রাকশন দিয়ে যান, ব্যাস ওটুকুই। এরা মূলত দল বেঁধেই এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে উড়ে মধু খেয়ে বেড়ায়। এরা সাধারণত মানুষের এলাকার কাছাকাছি বাসা বাঁধে। দূর থেকে সে বাসাকে আবর্জনা বলে বোধ হলেও তাদের নিজেদের জন্য সে বাসা রাজপ্রাসাদোপম এবং বিজ্ঞানসম্মতও বটে। ফুলের পাপড়ি , গাছের ছাল, শুকনো পাতা, মাকড়সার জাল দিয়ে মূলত তৈরী হয় বাসাটি। শুধুমাত্র ওপরের দিকে একটি ছোট গোলাকার ছিদ্র রাখা হয় যাতে সহজেই তারা ঘরে বাইরে সমান তালে যাতায়াত করতে পারে।
এরা মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা। বংশবিস্তারের জন্যে এরা শীত ও বসন্ত ঋতুটিকেই বেছে নেয়। এই পাখিদের ডিমেও কিন্তু বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। হাঁস-মুরগির ডিমের মতো মোটেই দেখতে হয় না। একরত্তি পাখির ডিম কেমন করেই বা সেরকম হবে! এদের ডিম ধূসর বা সবুজাভ রঙের হয়। বাদামি বা বেগুনী রঙের ছোপও ডিমে থাকতে পারে। দুর্গা টুনটুনির জীবনকাল ৮ থেকে ১২ বছর। International Union for Conservation of Nature বা IUCN এদের ‘ন্যূনতম বিপন্ন’ বলে চিহ্নিত করেছে। তাতে যদিও খুব উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। মানুষের আচরণে তা ঘটতে তো সময় লাগবে না।
তাই বরং একটু সতর্ক হই, আর যারা এখনো এই পড়শিটিকে চিনে উঠতে পারিনি, একটু চোখ মেলে দেখেও নিই।
ছবি : লেখক
#পাখি #প্রাণচক্র #টুনটুনি #দুর্গা টুনটুনি #অয়ন্তিকা দাশগুপ্ত