নারায়ণ দি গ্রেট
অবশেষে চলেই গেলেন তিনি। বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বারংবার কিছু অত্যুৎসাহী লোক তাঁর ভুয়ো মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে যেত। খুব মন চাইছিল এবারেও খবরটা মিথ্যে হোক। কিন্তু হল না। কী বলব তাঁকে? শিশুসাহিত্যিক, দক্ষ অলঙ্করণ শিল্পী নাকি বাংলা চিত্রকাহিনির বেতাজ বাদশা! এ কথা বললে হয়ত ভুল হবে না, তাঁর তৃতীয় সত্তাটিই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালির ঘরে ঘরে তাঁর সৃষ্টিরা সমাদৃত হয়েছে, একান্ত আপন তারা আমাদের। তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয়, একটু বেশি প্রশ্রয় পাওয়া বাঁটুল দি গ্রেট, প্রকাশকাল হিসেবে তার চেয়ে কিঞ্চিৎ পুরনো হাঁদা ভোঁদা বা কিছুটা নবীন নন্টে ফন্টে বা আরও অগণিত কমিক্স চরিত্ররা জুড়ে আছে আপামর বাঙালির শৈশব ও কৈশোরের নস্টালজিয়ায়।
কেবল টিভি, মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপুটে সাম্রাজ্য বিস্তারের বহু আগে বাঙালি শৈশব-কৈশোরকে কার্যত একা হাতে বিনোদনের জাদুকাঠির পরশ দিয়ে গেছেন হাওড়ার শিবপুরের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ি নিবাসী এই দীর্ঘদেহী মানুষটি। আর্ট কলেজ থেকে প্রথাগত শিক্ষালাভের পর স্নো-পাউডার, আলতা-সিঁদুরের বিজ্ঞাপন আঁকা থেকে সিনেমার শিরোনামলিপি লিখন, অনেক কিছুই করতে হয়েছে তাঁকে জীবিকার তাগিদে। তারপর শুকতারা, কিশোর ভারতীর মত পত্রিকায় কিম্বা দেব সাহিত্য কুটিরের নানা জনপ্রিয় পূজাবার্ষিকীতে একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কমিক্স, তাঁর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে সেজে উঠেছে অসংখ্য বই। প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অঙ্কনশৈলীর অনুসরণে ছবি আঁকা শুরু করেও পরবর্তীকালে অ্যালেক্স রেমন্ড, জন প্রেনটিস, লসন উড সহ একাধিক ইউরোপীয় শিল্পীর ছবি খুঁটিয়ে দেখে তাঁদের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হন তিনি। কিন্তু স্বীয় প্রতিভায় অচিরেই তিনি গড়ে তোলেন আদ্যন্ত ভারতীয় মেজাজের একান্ত নিজস্ব এক বলিষ্ঠ শৈলী। রেখার সামান্য হেরফেরে মজাদার কার্টুন থেকে একেবারে বাস্তবোচিত ছবি এঁকে ফেলতেন অনায়াস দক্ষতায়। সাদা-কালো হোক বা জলরঙের মায়াবী তুলির টান, ছবির সূক্ষ্ম ডিটেলিং, নিখুঁত শারীরস্থান তাঁর ছবিকে চিনিয়ে দেয় সহজেই। শুধু কি ছবি? মুক্তাক্ষরে লেখা দুরন্ত পাঞ্চলাইনের সংলাপ, বাংলা কমিক্সের ভাষায় ‘ওঁরফ’, ‘আঁউফস’, ‘ওঁকৎ’, ‘ইল্লুস’ এর মত রকমারি ধ্বন্যাত্মক শব্দের সাবলীল প্রচলন – তাঁর কাছে বাংলা শিশুসাহিত্য ঋণী থাকবে এর জন্যেও। মার্ভেল, ডিসি, কিং ফিচার সিন্ডিকেটের মত নামী বিদেশি কমিক্স সংস্থায় যখন এক একটি কমিক্সের সংলাপ, ড্রয়িং, ইঙ্কিং, লেটারিং, লে আউট এবং রঙের জন্য একাধিক দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হয়, খরচ হয় কোটি কোটি ডলার, বঙ্গের বিস্ময় প্রতিভা নারায়ণবাবু সেখানে ছিলেন ওয়ান ম্যান আর্মি! তিনি এক্ষেত্রে নিজেই একজন সাক্ষাৎ সুপারহিরো।
আরও পড়ুন : "বিদায়' শব্দটি আমি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করি" : স্মরণে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়/ টিম সিলি পয়েন্ট
সুদীর্ঘ বর্ণময় কর্মজীবনের উপান্তে এসে তিনি সাহিত্য অকাদেমি, বঙ্গবিভূষণ বা পদ্মশ্রীর মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু আমাদের মত তাঁর গুণমুগ্ধদের মনে প্রশ্ন রয়েই যায়, সেই সম্মান আসলে কার? প্রায় আজীবন প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত অথচ তা নিয়ে ঋষিতুল্য উদাসীন অনন্য শিল্পীর নাকি তাঁকে সম্মানিত করে সংশ্লিষ্ট পুরস্কারেরই কৌলীন্য বৃদ্ধি হল? তবু এটুকু ভেবে ভাল লাগে, অন্তত জীবদ্দশাতেই তাঁকে ‘সামান্য কমিক্স শিল্পী’র তকমা হঠিয়ে একজন শিশুসাহিত্যিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এ দেশে। লালমাটি প্রকাশন থেকে পাঁচ খণ্ডে একত্রিত হয়ে মলাটবন্দি হয়েছে তাঁর দুষ্প্রাপ্য বেশ কিছু কাজ। তবে শিল্পীর নিজের কথা ধার করেই বলা যায়, আবালবৃদ্ধবণিতা পাঠকের ভালবাসার চেয়ে সেরা পুরস্কার আর কী হতে পারে একজন স্রষ্টার কাছে? সেই ভালবাসা হৃদয়ে নিয়েই নবতিপর শিল্পীর তুলি সচল ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। মহাকালের অমোঘ নিয়মে তাঁর নশ্বর দেহাবসান হল ঠিকই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিরা কালের সীমানা পেরিয়ে রয়ে যাবে বাঙালির মনে, এই আশা। নব প্রজন্মের কচিকাঁচারাও বুঁদ হবে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা খালিপায়ের কোনও বীরের গল্পে, অথবা বোর্ডিং স্কুলের গন্ডির মধ্যে কাটানো কয়েকটা দুষ্টু ছেলের মজার কীর্তিকলাপে, এই প্রত্যয় থাকুক আমাদের।
..................................
আরও পড়ুন : একজন খলনায়ক এবং কমিক্স / সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী