ফিচার

মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি কোনো দেবদাসীর নাম নয়

রোহন রায় Sep 26, 2022 at 7:10 pm ফিচার

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার বিধাতা কেন দেননি সে নিয়ে কান্নাকাটি করতে বসেননি মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি। বড় হয়ে উঠতে উঠতেই টের পেয়ে গেছিলেন অধিকার চেয়েচিন্তে ভিক্ষা করে নেবার জিনিস নয়, লড়াই করে ছিনিয়ে নেবার জিনিস। নিজের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার তিনি নিজেই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। দেবদাসীর মেয়ে তিনি। সবাই বলেছিল, দেবদাসীই হতে হবে তাঁকে। মুথুলক্ষ্মী দেবদাসী হননি। ডাক্তার হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে হয়েছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা বিধায়ক। শুধু তা-ই নয়, নারীমুক্তির জন্যও লড়ে গেছেন সারাজীবন।

মুথুলক্ষ্মীর জন্ম ১৮৮৬ সালের ৩০ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজে। সেখানে তখন রমরমিয়ে চলছে দেবদাসী প্রথা। দেবতার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার নামে আজীবন মন্দিরের এবং মন্দির-কর্তৃপক্ষের সেবাদাসী করে রাখা হত অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েদের। লাঞ্ছনা আর অপমানে মাখা মর্মান্তিক সেই নিয়মকে বৈধতা দেওয়া হত পাথরের ভগবানের নাম নিয়ে। সেই হতভাগ্য মেয়েদের মধ্যেই একজন ছিলেন চন্দ্রাম্মাল। অবশ্য তাঁর একদিক থেকে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, কারণ তাঁর জীবনে আলো হয়ে এসেছিলেন মহারাজা কলেজের অধ্যক্ষ এস. নারায়ণস্বামী আইয়ার। সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারায়ণস্বামী বিয়ে করেছিলেন চন্দ্রাম্মালকে। পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছিল সমাজও। একঘরে হতে হয়েছিল তাঁদের। সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল নারায়ণস্বামীর পরিবারও। মেয়ে মুথুলক্ষ্মীকে নিয়ে চরম মুশকিলে পড়েছিলেন এই দম্পতি। দেবদাসীর মেয়েকে দেবদাসীই হতে হবে - এই মর্মে চাপ আসতে লাগল বিভিন্ন দিক থেকে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য অল্পবয়সেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন মা। কিন্তু মুথুলক্ষ্মী নিয়তির কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে চাননি। খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলেন পড়াশোনাকে। এ ব্যাপারে তাঁর সবচেয়ে বড় সহায় ছিলেন তাঁর বাবা। কিন্তু মেয়েদের উচ্চশিক্ষার তখন সুযোগ কোথায়? পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট মহারাজা কলেজেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসলেন মুথুলক্ষ্মী। আর পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়ে ঢুকে পড়লেন সেই কলেজেই। স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করলেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। এরপর মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেন তিনি। ভারতের প্রথম যুগের মহিলা সার্জনদের অন্যতম মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ১৯৫২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'আদিয়ার ক্যান্সার ইন্সটিটিউট'। চিকিৎসক মুথুলক্ষ্মীর জন্মদিনটিকেই 'হাসপাতাল দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেছে আজকের তামিলনাড়ু সরকার। 


কিন্তু এহ বাহ্য। মুথুলক্ষ্মীর পরিচয় এখানেই শেষ নয়। সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে, নিজের শর্তে বাঁচতে তাঁকে যে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল, নিরাপদ তটভূমিতে পৌঁছে তা তিনি ভুলে যাবার চেষ্টা করেননি। তীব্রভাবে মনে রেখে দিয়েছিলেন। মনে রেখে দিয়েছিলেন বলেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অন্য মেয়েদের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সে সময়ের নারী-আন্দোলনের অন্যতম মুখ। দলিত মহিলাদের সম্মান রক্ষা করার জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন। সে সময় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের স্তন্যপান করাবার জন্য নিয়োগ করা হত দলিত মহিলাদের। মুথুলক্ষ্মীর চেষ্টাতেই রদ হয় এই প্রথা। নিজের বাড়িতেই সহায়-সম্বলহীন দলিত, স্বামী-পরিত্যক্তা মহিলা, কুমারী মা ও পতিতালয়ের মহিলাদের আশ্রয় দেওয়া শুরু করেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে পরে গড়ে তোলেন 'আভভাই হোম' নামের একটি আশ্রয়ভবন। আইন করে দেবদাসী প্রথা রদ করারও চেষ্টা করেছিলেন মুথুলক্ষ্মী। বাল্যবিবাহ সেসময়ে ভারতীয় সমাজে অতি সাধারণ ঘটনা। কন্যাশিশুদের বিয়ে দিলে নাকি গৌরীদানের পুণ্য অর্জন করা সম্ভব, এমনই বিশ্বাস করতেন অধিকাংশ মানুষ। সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স যাতে ১৬ করা যায়, আর ছেলেদের ২১, আপ্রাণ সেই চেষ্টাও করেছিলেন মুথুলক্ষ্মী। তাঁর সুপারিশে মাদ্রাজে মুসলিম ছাত্রীদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা হয়। হরিজন ছাত্রীদের নিয়মিত স্কলারশিপের ব্যবস্থাও তাঁর চেষ্টাতেই শুরু হয়েছিল। মহিলাদের জন্য 'স্ত্রী ধারুমম' নামে একটি পত্রিকা চালাতেন মহিলাদের নিয়ে। 'My Experience as a Legislator' নামে একটি স্মৃতিকথা লিখে গেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২২ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। 

আরও পড়ুন : দেশে প্রথম মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের ‘মানবাধিকার’-এর দাবিতে লড়েছিলেন সাবিত্রী / তোড়ি সেন

সব আন্দোলন তাৎক্ষণিক সাফল্য পায় না। প্রদীপ তো আর রাতারাতি জ্বলে না। তার আগে থাকে দীর্ঘ এক সলতে-পাকানোর পর্ব। নারীমুক্তির সেই সলতে-পাকানোর কাজটা যাঁদের হাত ধরে এদেশে শুরু হয়েছিল, তাঁদের একজন এই দেবদাসী-কন্যা। যিনি নিজে দেবদাসী হতে অস্বীকার করেছিলেন। এবং শুধু নিজের না, পাল্টে দিয়েছিলেন বহু মেয়ের জীবন।  

আরও পড়ুন : পুরুষের ছদ্মবেশে প্রথম মহিলা বিশ্বভ্রমণকারী : জাঁ বারে মন্দিরা চৌধুরী 


বিশেষ ঋণ : রণিতা চট্টোপাধ্যায় 

................................. 

 সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র 

#Muthulakshmi Reddy #medical practitioner #social reformer #নারীপক্ষ #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

7

Unique Visitors

219110