কোলে তুলে গোটা প্রেক্ষাগৃহ ঘুরেছিলেন মুগ্ধ রফি : শতবর্ষে গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী
জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন সিলেটের বেহেলি গাঁয়ের বাসিন্দা। তাই যখন ছেলেবেলায় অশোকবিজয় রাহার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিতে যান, অনবধানতায় চলে এসেছিল স্বদেশীয় উচ্চারণ। ‘পাগলা হাওয়া’ কে বলে ফেলেন ‘ফাগলা হাওয়া’। কিন্তু সঙ্গীত যাঁর রন্ধ্রে, তাঁকে কি আর গান থেকে দূরে রাখা যায়! বিশেষত যেখানে গানপাগল মা স্নেহলতা আর বাবা নলিনীনাথ চাইতেন ছেলে নির্মলেন্দু যেন গায়ক হয়। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি আব্দুল মজিদ ও আব্দুর রহিমের কাছে শিক্ষা নিচ্ছিলেন লোকসংগীত ও লোকবাদ্যের। এসময় বাংলাদেশের কলেজে পড়াকালীন সরাসরি ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন নির্মলেন্দু। হুলিয়া জারি হয় তাঁর নামে। বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। এলেন খাসিয়াদের চা বাগানের বস্তিতে গা ঢাকা দিতে। একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে দেখলেন একদল স্থানীয় মহিলা সন্তানকামনায় হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে আরাধনা করছেন অস্তগামী সূর্যের। কোন বৈদিক মন্ত্রে নয় তারা সকলে গাইছিলেন লোকগানের প্রাণ আকুল করা সুর। সেই সুরে মজে গেলেন নির্মলেন্দু। ঠিক করে নিলেন আরও জানবেন, আরও শিখবেন - সংগ্রহ করবেন গারো-খাসিয়াদের গান। উদাত্ত কণ্ঠে আয়ত্ত করলেন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, বাউল, ঝুমুর আরও কত।
প্রথমজীবনে ডাকাবুকো নির্মলেন্দু এত ভালো ফুটবল, ভলিবল খেলতেন যে সবাই ভেবেছিল বড় হয়ে খেলোয়াড়ই হবেন। শোনা যায় একবার খাসিয়া ও গারো পাহাড়ের মাঝে শ্রীহট্টের মহল্লায় থাকাকালীন এক বাঘের ছানাকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন পাহাড়ি খরস্রোতা নদীতে। আবার কিশোর বয়েসে মায়ের জন্য ওষুধ আনতে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই স্টিমারে করে গিয়েছিলেন বেহেলি থেকে নদী পেরিয়ে সুনামগঞ্জে। ফেরার পথে ফেরি বন্ধ। কিন্তু প্রবল দুর্যোগ মাতৃভক্ত নির্মলেন্দুকে আটকাতে পারেনি। সাঁতরে পেরিয়ে এসেছিলেন বর্ষণপ্লাবিত সেই নদীপথ। এমনই একরোখা আর ডাকাবুকো ছিলেন। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যেন ভালোবাসতেন চিরকাল। কোলকাতার বেলেঘাটায় বসেছে গানের জলসা। হঠাৎ মাইক খারাপ। এদিকে শিল্পীর আসনে হেমন্ত, মানবেন্দ্র, শ্যামল। দর্শকরা অস্থির হয়ে উঠেছে। উদ্যোক্তারাও বিপাকে। এমন প্রতিকূলতায় শুধু দোতারা নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়লেন নির্মলেন্দু। খালি গলায় “নাইয়া রে-এ-এ-এ” বলে এমন টান দিলেন যে উপস্থিত পাঁচ হাজার দর্শক একেবারে নীরব। মঞ্চ থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মানবেন্দ্রর কথায়, এর আগে কিছু লোকসঙ্গীত গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে তাঁর নিজের মধ্যে যে অহঙ্কার তৈরি হয়েছিল সেদিন নির্মলেন্দুকে দেখে তা একেবারে ঘুচে যায়।
এরপরের গন্তব্য শান্তিনিকেতন। ডেকে পাঠালেন শান্তিদেব ঘোষ। সেখান থেকে ১৯৫৫ সালে পোল্যাণ্ডের ওয়ারহশ বিশ্ব যুব উৎসবের আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথমবার অংশ নিয়েই প্রথম হলেন নির্মলেন্দু। বাংলার জয়পতাকা উড়ল বিদেশের মাটিতে। সবাই সেদিন শুনেছিল “মুসলমান বলে গো আল্লা,হিন্দু বলে হরি”। কোলকাতায় যেদিন ফিরলেন সেদিন নাকি স্বয়ং উত্তমকুমার তাঁর ভাই তরুণকুমারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন নির্মলেন্দুকে রিসিভ করতে। বিশ্বের মাটিতে গোল্ড মেডেল বলে কথা! এরপর ডাক এল দিল্লি থেকে। জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে বিদেশযাত্রার সুযোগ পেলেন। সে সফরে সরকারি গানের দলে ছিলেন বিলায়েৎ খাঁ, বাহাদুর খাঁ, শান্তাপ্রসাদ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পী। ছিলেন সেকালের বিখ্যাত কত্থকশিল্পী সিতারা। প্রত্যেক শোয়ে নির্মলেন্দুর জন্য জনতার করতালি শুনে মাৎসর্যে আহত হলেন তিনি। দলনেতা অনিল চন্দকে ডেকে বললেন পরবর্তী অনুষ্ঠানে যেন নির্মলেন্দুকে পরে গাইতে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল নাচের মাধ্যমে দর্শকের আকর্ষণ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবেন সিতারা। কিন্তু নির্মলেন্দুর জেদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না তিনি। যদিও শরীর সেদিন ভালো ছিল না, তাও সিতারার নাচের পর মঞ্চে এমন গানের জাদু ছড়িয়েছিলেন যে শ্রোতাদের কোলে চড়ে মঞ্চ ছেড়েছিলেন নির্মলেন্দু আর বিজিত সিতারা সাজঘরে চোখের জলে মেনে নিয়েছিলেন নিজের পরাজয়।
আরও পড়ুন: কেরি ফাওলার ও তাঁর বীজ-সংরক্ষণ কেন্দ্র : এক অনিঃশেষ স্বপ্ন
বাংলায় গণসঙ্গীতের মাধ্যমে জনজাগরণের কাজে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের। আর তাঁর সুরমা উপত্যকা কালচারাল স্কোয়াডের ‘প্রধান গোলন্দাজ’ ছিলেন নির্মলেন্দু। বিপ্লবী হেনা দাশের স্বামী রোহিনী দাশের হাত ধরেই বামপন্থী রাজনীতিতে আসেন নির্মলেন্দু। হেনার কথায় ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় সারা ভারত কৃষক সম্মেলনের অনুষ্ঠানে ‘বাইদ্যার সুরে’ দুর্ভিক্ষের যে গান গেয়েছিলেন নির্মলেন্দু তা ওই জনসভায় উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতাকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল। হারমোনিয়ামের সর্বোচ্চ স্কেলে গেয়ে এমনভাবে প্রতিবাদের আগুন জ্বেলে দিতে নির্মলেন্দুই পারতেন।
বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরেও গান গেয়েছিলেন নির্মলেন্দু। সলিল চৌধুরীর সঙ্গেই কাজ করেছেন মুম্বাইতেও। একবার মুম্বইতে ফিল্মফেয়ারের অনুষ্ঠানে লোকসংগীত পরিবেশনের পরে মহম্মদ রফি এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁকে কোলে তুলে গোটা প্রেক্ষাগৃহ ঘুরিয়েছিলেন। নির্মলেন্দু ততদিনে ‘সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি’, ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ’, ‘ভালো কইরা বাজান গো দোতারা’—এসব গানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছেন।
বাঙালির একান্ত নিজস্ব দেশজ সুরের মায়া যে কী অমোঘ, গোটা বিশ্বের দরবারে তারই ছোঁয়াচটুকু পৌঁছে দিয়েছিলেন নির্মলেন্দু।