মেফিস্টো: রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ, শিল্পীর মেটামরফোসিস কিংবা মৃত্যুর গল্প
গত ৪ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডে সাধারণ গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। একটি স্বাধীন দেশের সেনার হাতে খুন হয়ে গেল সে দেশের অন্তত ১৪ জন মানুষ, তা নিয়ে কারও বিশেষ বক্তব্যও প্রথমদিকে চোখে পড়েনি। এমনকি খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি পেশ করতেও দু-দুটো দিন সময় লেগে গেছে। যদিও সে বয়ানের অধিকাংশই জুড়ে আছে সেনার আত্মরক্ষার সাফাই। অবশ্য এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক। ‘চিঙ্কি’-রা এ দেশে জন্মেছে, এ দেশেই থাকে, এ দেশের নাগরিকত্বও আছে, কিন্তু ওদের এ দেশের লোক বলে ভাবার মতো বাড়াবাড়ি কেউই করে না। আর যতবার নাগাল্যান্ডে গুলি চলে, যতবার মণিপুরের মেয়েরা ধর্ষিতা হয়, আর যতবার অপরাধীরা জাতীয় বীরের মর্যাদা পায়, ততবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ১৯৩৬ সালের জার্মানিতে লেখা একটা উপন্যাস। যার নাম ‘মেফিস্টো’।
১৯৩৬ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় শ-খানেক বছর আগে জার্মান-আমেরিকান লেখক ক্লস মান-এর লেখা উপন্যাস ‘মেফিস্টো’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তার লেখক ততদিনে নিজের মাতৃভূমি থেকে বাধ্যত নির্বাসিত। সে দেশে নিষিদ্ধ তাঁর লেখা যে-কোনো শব্দ। এরও ঠিক তিন বছর আগে সেই দেশের চ্যান্সেলরের পদে এসে বসেছেন অ্যাডলফ হিটলার নামে এক স্বৈরাচারী শাসক। যিনি জার্মানি দেশটাকে কেবল বিশুদ্ধ আর্য রক্তের বাসভূমি বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান। আর তাঁর গদিতে বসার পর বড়োজোর পাঁচ সপ্তাহ লেগেছে প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটা গজিয়ে উঠতে, যেখানে ওই নোংরা ইহুদিগুলোকে সাফ করে ফেলা যাবে।
ঘটনাচক্রে, সেই ইহুদিরাও জার্মান নাগরিকই ছিল। ক্লস মানের মায়ের শরীরেও বইত ইহুদি রক্ত। সম্ভ্রান্ত পরিবারের গণিতজ্ঞ পিতার সন্তান, নিজে অভিনেত্রী, তবু, ইহুদি তো। হিটলারের নীল রক্তের জার্মানির সামনে যারা নোংরা আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ক্লস মানের বাবা, নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক টমাস মানকেও জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় প্রাণ হাতে করে। হিটলারের শক্তি সংগ্রহের সময়েই যিনি নাৎসি বাহিনীর উত্থানকে ‘একসেন্ট্রিক বারবারিজম’ বলে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি, পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায়ও ছিল না। তবু তাঁর লেখারা জার্মানিতে রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর ছেলের সেই সৌভাগ্যও হয়নি। আর এই পরিস্থিতিতে, আমস্টারডামে বসে নিজের ফেলে আসা স্বদেশের আর্তনাদ শুনতে শুনতে ক্লস মান তাগিদ অনুভব করেছিলেন এই সময়টাকে ধরে রাখার। সেই তাগিদ থেকেই লেখা হয়ে উঠেছিল ‘মেফিস্টো’। আর আজ, এই ২০২১ সালে যখন একাধিক শক্তিশালী অভিনেতা-নির্দেশক-শিল্পী সেই উপন্যাসকে বাংলার মঞ্চে রূপ দেওয়ার কথা ভাবেন, তাঁরাও এই সময়টার একটা অন্যরকম ভাষ্য খুঁজতে চান সেই নাট্যনির্মাণের মধ্যে দিয়ে। বাংলা নাট্যমঞ্চে সুমন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে বারে বারে ফিরে এসেছে এই নাটক। প্রত্যেকবারই কোনও না কোনও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক আবহে। প্রথমবার ২০০২ সালে, গুজরাত গণহত্যার পর। দ্বিতীয়বার ২০১৩ সালে, এ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রাক্কালে। আর এবার এ নাটক সুমন মঞ্চস্থ করার কথা ভেবেছিলেন গত বছর, বাংলার নির্বাচনী আবহে। এ নাটককে তাই কেবলমাত্র থিয়েটারের আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা অসম্পূর্ণ, হয়তো অপ্রয়োজনীয়ও।
এ নাটকের মূল কেন্দ্রে রয়েছে আসলে সেই চিরাচরিত প্রশ্ন, শিল্প এবং শিল্পীর সঙ্গে রাষ্ট্রের, তথা ক্ষমতাকেন্দ্রের সম্পর্ক ঠিক কেমন। সেই প্রশ্নকেই ধারণ করে আছে এ নাটকের প্রেক্ষাপট, জার্মানির হামবুর্গ শহরের আর্টিস্ট’স থিয়েটার। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা থিয়েটার করে, কিন্তু তার জন্য সরকারের পোষা পালাকার হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি তাদের। পড়েনি, যতদিন হিটলারের হাতে শাসনের রশিটি তুলে দেয়নি দেশের জনগণ। হ্যাঁ, ভেতরে ভেতরে হিটলারের কিছু চ্যালাচামুণ্ডা জটলা পাকাচ্ছিল বটে, তবে কমিউনিস্ট আর নাৎসি পার্টির সদস্যদের একসঙ্গে থিয়েটার করাটা তখনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং নাটকের দুই সহকর্মী, হেন্ড্রিক হফগেন আর অটো উয়েলরিখ স্বপ্ন দেখত, একদিন তারা একটা বিপ্লবী থিয়েটার গড়ে ফেলবে, যার রাশ থাকবে সম্পূর্ণত শ্রমিক শ্রেণির হাতে। রাশিয়ার সাম্যবাদী মতাদর্শে জারিত দুই অভিনেতার এমন লক্ষ্য থাকাই স্বাভাবিক। মনে পড়তে পারে, ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন এমন এক রাশিয়ার কথা, যেখানে দিনের শেষে সাধারণ শ্রমিকও ‘ব্যাটলশিপ অফ পোটেমকিন’-এর মধ্যে নিজের বিনোদন খুঁজে নেয়। সাম্যবাদের প্রয়োগ তো এমনই হওয়ার কথা, কেবল ধনসম্পদের সমবণ্টন নয়, চিন্তা-চেতনারও সমানাধিকার বটে। কিন্তু গল্পটা বদলাতে শুরু করল ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারির পর, যখন রাইখের চ্যান্সেলর হিসেবে নির্বাচিত হলেন হিটলার। সাম্প্রতিক ভারতের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি বক্তৃতায় রোমিলা থাপার স্পষ্ট বলেছিলেন, মেজরিটেরিয়ানিজম আসলে ন্যাশনালিজমও নয়। তবু পাকচক্রে ন্যাশনাল-মুখোশের আড়ালে বস্তুত সংখ্যাগুরু ভূতের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। বিশ শতকের সেই জার্মানিতেও অবস্থাটা পাকেচক্রে তেমনই দাঁড়িয়েছিল। ন্যাশনালিজমের ধুয়ো তুলে নিষিদ্ধ হচ্ছিল বই, নিষিদ্ধ হচ্ছিল শিল্প, নিষিদ্ধ হচ্ছিল মানুষ। আর সেই পরিস্থিতিতে, যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা এতদিন ভেবেছিলেন “আর্ট ফর আর্ট’স সেক”-ই আসলে শিল্পের মূল মন্ত্র হওয়া উচিত, তাঁদের নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল হিটলারের স্বৈরতান্ত্রিক উত্থান। আবার যাঁরা এতদিন বিপ্লবী থিয়েটারের চেতনা লালন করে এসেছেন, সরকারি থিয়েটারে বাতিল হয়ে গেল তাঁদের কনট্র্যাক্ট। আর যাঁরা নিজেরা ইহুদি, কিংবা কারও স্ত্রী, কারও ঠাকুমা অথবা বংশের কেউ না কেউ ইহুদি রক্তের উত্তরাধিকারী, হিটলারের জার্মানির শিল্পমহলে তাঁরা হয়ে পড়লেন অপাঙ্ক্তেয়।
এসবের বাইরেও, আরও একটা অদ্ভুত বদল ঘটছিল। দলবদল। কমিউনিজমের আদর্শ ছেড়ে কেউ কেউ গায়ে চাপিয়ে নিচ্ছিল নাৎসি জোব্বা। এই যুক্তিতে, যে, সে “শুধু একজন অভিনেতা”। অতএব অভিনয় করার সুযোগ বাঁচিয়ে রাখাই তার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। আরেকদিকে, নাৎসি দলে থাকা কারও কারও স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যাচ্ছিল, যখন আর্য জাতীয়তাবাদের আফিমের নেশা দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কোনও কিছুকেই আর চাপা দিয়ে রাখতে পারছিল না। এই টানাপোড়েনের মধ্যে নিখুঁত মেফিস্টোর মতো নাৎসি ক্ষমতাতন্ত্র খুঁজে নিচ্ছিল, তার পতাকার যোগ্য বাহকদের। তাই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে মরে যাচ্ছিল নাৎসি দলের সদস্য হান্স মিকলাস, প্রতিবাদের স্বর জিইয়ে রাখতে রাখতে মরে যাচ্ছিল অটো উয়েলরিখ, হারিয়ে যাচ্ছিল ইহুদি কেরুলা কিংবা কালো চামড়ার জুলিয়েট-রা। আর আসর জাঁকিয়ে বসছিল মাথামোটা লরেন্স, কিংবা অতি চালাক হেন্ড্রিক হফগেন।
হেন্ড্রিক হফগেনকে অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ নাটকে ‘মেফিস্টো’-র চরিত্রে অভিনয়। কিন্তু জীবনের রঙ্গমঞ্চে সে যে কখন ফাউস্ট হয়ে গেছে, সে কথা সে বুঝেই উঠতে পারেনি। সেই ফাউস্ট, যে ভালো থাকার জন্য নিজের আত্মা বন্ধক রেখেছিল সাক্ষাৎ শয়তানের কাছে। আর যে মানুষের আত্মা নেই, সে কি শয়তানের হাতের ক্রীড়নক, নাকি নিজেই শয়তান? এই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এ নাটক। হয়তো সেজন্যই, নাটকে ব্যবহৃত অল্প কিছু প্রপসের মধ্যে সিংহভাগ দখল করে থাকে গ্রিনরুমের কিংসাইজ আয়না। যার সামনে মানুষ সাজ ছেড়ে ফেলে নিজের আসল চেহারার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়। আবার আয়নার নড়াচড়া পালটে দিতে পারে সেই চেহারাকেও। আয়নার নড়াচড়ায় হফগেনের শীর্ষে, আরও শীর্ষে ওঠার তাড়না বিকৃত বৃহদাকার চেহারা নিতে থাকে। আর শেষমেশ পর্দার পিছনে গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে ছিটকে ওঠে তার বিরাট ছায়া, সবাইকে ছাপিয়ে যায়। আসলে এই ক্ষমতা দখলের তাড়নাই তো মানুষকে ভেতর থেকে রূপান্তরিত করতে থাকে। সেই কারণেই, নাটকে ব্যবহৃত শয়তানের একাধিক মুখোশের মতোই, একাধিক মানুষ কখনও না কখনও, কোথাও না কোথাও, মেফিস্টো হয়ে ওঠে। একাধিক মানুষের মুখের আড়াল নিতে নিতে নিজের সাম্রাজ্য কায়েম করে চলে মেফিস্টো। কখনও কেরিয়ারিস্ট ‘অভিনেতা’ হফগেন। কখনও নিকোলেতা, যে এই বোধের সংকটমুহূর্তে যুঝতে না পারা নাট্যকার থিওফিল শার্ডারকে ছেড়ে হফগেনের কাছে পৌঁছয় থিয়েটারে সুযোগ পাওয়ার তাড়নায়। কখনও লাখ লাখ ইহুদির মৃত্যুপরোয়ানায় সই করা হিটলার। আর কখনও ক্ষমতা দখলের আগে নিজেদের গরজে হিটলারকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল যেসব অস্ত্রব্যবসায়ী আর পুঁজিপতি, তাদের মুখের আদলে মেফিস্টোর মুখোশ কেবল পালটে পালটে যায়। কিন্তু মেফিস্টোর সংজ্ঞায় ধ্রুব হয়ে থাকে কেবল লোভ, ক্ষমতার প্রতি তীব্র লোভ।
আসলে কোনও একক মানুষ নয়, মেফিস্টো শেষমেশ ক্ষমতাতন্ত্রেরই মূল চেহারা। আর সেই কারণেই শিল্পী-সাহিত্যিক তথা যে-কোনো মননজীবী মানুষ আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠেন কোনও রাষ্ট্রের কাছে। সমাজের প্রতি একজন বুদ্ধিজীবীর কী দায় তা বোঝাতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাইদ লিখেছিলেন, জনগণের মাঝে তাঁর ভূমিকা আগন্তুকের, ‘যা-চলছে-চলুক’ এই স্থিতাবস্থায় যিনি বিঘ্ন ঘটান। ছকে বাঁধা ভাবনাচিন্তার মধ্যে থেকে তাঁর একক স্বর উদ্যত হয়ে উঠলেই তাঁর ওপর নেমে আসতে পারে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। লুই আলথুজার যে আক্রমণকে ভেঙে দেবেন দুই ভাগে। তার একদিকে থাকবে তাৎক্ষণিক রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস, যা সরাসরি দমননীতি নামিয়ে আনে বিরুদ্ধ স্বরের ওপর। আর অন্যদিকে থাকে সুদূরপ্রসারী আইডিয়াল স্টেট অ্যাপারেটাস, থুড়ি, মগজ ধোলাই যন্ত্র। হফগেনের মতো যে মানুষ তার বিবেক বিকিয়ে দেয়, তার মস্তিষ্ক দখল করে নেয় মেফিস্টো। তারপর প্রাইম মিনিস্টারের মতো ঠান্ডা গলায় হফগেনকে চেতাবনি দেয়, “তুমি একজন অভিনেতা। শিল্পী। এসব রাজনৈতিক বিষয় তোমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তোমার যা কাজ তাই করো, নইলে বেঘোরে মরবে।” এই হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে বিবেক হারানো, বন্ধু হারানো, এমনকি মস্তিষ্কও হারিয়ে ফেলা নিঃস্ব মানুষের আর পক্ষ নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকে না। তাই নাটকের শেষে মঞ্চের ওপর মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপের মতো পড়ে থাকে একা হেন্ড্রিক হফগেন।
আপৎকালে যারা পক্ষ নিতে পারে না, নিজের ম্যাগনাম ওপাস ‘ডিভাইন কমেডি’-তে তাদের অন্তিম নিয়তির বিধান দিয়ে গেছিলেন মহাকবি আলিঘিয়েরি দান্তে। বলেছিলেন, “The darkest places in hell are reserved for those who maintain their neutrality in times of moral crisis.”
নরকের সবচেয়ে অন্ধকার স্থানে মেফিস্টো, তথা শয়তান ছাড়া আর কে-ই বা থাকতে পারে!