মেনস্ট্রুয়াল কাপ : ভাবনা, দুর্ভাবনা পেরিয়ে
![](https://firebasestorage.googleapis.com/v0/b/sillypoint-3.appspot.com/o/images%2Fthumbs%2FGe8I41636696040800%E0%A6%95%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%AA%E0%A7%8B%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0_1366x1366.jpg?alt=media)
মেয়েবেলায় প্রথম যেদিন পা দিয়ে রক্ত গড়িয়েছিল সেইদিনই মা পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছিল যে এ এক অশুচি কান্ড। এই কান্ড প্রতি মাসে ঘটেই যাবে যদ্দিন না বয়সের কাঁটা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তবে একে রাখতে হবে গোপনে। বাবা দাদা ভাইদের জানতে দেওয়া চলবে না। মুখ বুজে চুপটি করে যন্ত্রণা সহ্য করে কর্মে মনোনিবেশ করতে হবে। শুধুমাত্র মহিলাদের মধ্যেই এটি আলোচ্য, কিন্তু সেটাও ফিসফিসিয়ে। অন্দরে বাইরে সবর্ত্রই এ ধারা অব্যাহত। তবে একটু আধটু পড়াশোনা করে অল্প স্বল্প যতটা শিক্ষিত হয়েছি তাতে বুঝেছি ঐ ফিসফিসানিটাই আসলে মহাপাপ। যে জিনিস এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই এই হিসাবেই সহজে মিলে যেতে পারে, খামোখা সেটাকে জটিল করে তোলা আর কী! আসলে ঋতুস্রাবের গোটা বিষয়টাই আমাদের মননে সংস্কার কুসংস্কারে এমনভাবে জড়িত যে এই নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে গেলেই অনেক নাক সিটকানো, চোখ রাঙানো সহ্য করতে হয়। তবুও সংস্কারের 'মারের মুখের ওপর দিয়েই' আমরা গলা তুলব। 'ইশশ! যেসব কথা বলতে নেই' সেগুলোই বলব।
পিরিয়ডে আমাদের ব্যবহার্য বস্তুগুলোর বিবর্তন হয়েছে ধীরে ধীরে। কাপড়, প্যাড, ক্লথ প্যাড, ট্যাম্পন ইত্যাদি। এই সমস্ত কিছুর থেকে এক ধাপ এগিয়ে বর্তমানে সেই লিস্টিতে ঢুকেছে মেনস্ট্রুয়াল কাপ। সেই নিয়েই ক'টা কথা বলতে বসা। যদিও ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও লাখ লাখ মেয়ে নোংরা কাপড়, বালি এইসব ব্যবহার করতে বাধ্য হয় সেখানে মেনস্ট্রুয়াল কাপের প্রচার বা এ সম্বন্ধে লেখালেখি অহেতুক মনে হতেই পারে। কিন্তু আমরা যারা স্মার্টফোন খুলে এই লেখাটা পড়ার বিলাসিতাটুকু করতে পারছি তাদের সংখ্যাও তো কিছু কম নয়। তাই এই লেখার কিছু তো মূল্য ধরতেই হয়। আর এই লেখার অবতারণা কিন্তু মেনস্ট্রুয়াল কাপের প্রচার করার জন্যই। তার মূল কারণ এই বস্তুটির পরিবেশ বান্ধব রূপ। একটা ছোট্ট হিসাব করি, একজন মহিলার জীবদ্দশায় মোট ৪০০-৫০০ বার পিরিয়ড হয়। প্রতিবার গড়ে ১২টি করে প্যাড বা ট্যাম্পন লাগলেও দেখা যাচ্ছে তিনি একাই প্রায় ৫-৭ হাজারটি প্যাড বা ট্যাম্পন ব্যবহার করছেন। আর একটি প্যাড বা ট্যাম্পনের সম্পূর্ণ ডিকম্পোজ হতে সময় লাগে প্রায় ৫০০ বছর। অন্যদিকে মেনস্ট্রুয়াল কাপ তৈরি হয় মূলত মেডিকেল গ্রেড সিলিকন দিয়ে (কিছুক্ষেত্রে ন্যাচারাল লেটেক্সও ব্যবহৃত হয়) যা সম্পূর্ণ বায়োডিগ্রেডেবল। এবং একটি কাপ ৮-১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। হিসাবটা বোঝা গেল নিশ্চয়ই। আর টাকা পয়সা খরচের দিকটা না হয় ধরলামই না।
এবার মেনস্ট্রুয়াল কাপ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন আর ধারণার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
প্রশ্ন/ধারণা ১ : মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে কুমারীত্ব বা ভার্জিনিটি লোপ পায়।
আমরা জানাচ্ছি : সমাজ স্বীকৃত সতীত্বের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করছি না। একটু বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ক'টা কথা বলি। 'সতীচ্ছদা' বা হাইমেন প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রে আলাদা হয়। কারোর খুব পাতলা, কারোর মোটা আবার হাইমেন ছাড়াই জন্মেছেন এমন মহিলারাও আছেন। এবার এই হাইমেন যে শুধুমাত্র সঙ্গমের কারণে ছিঁড়ে যায় তা একেবারেই নয়। খেলাধূলা, সাইক্লিং, সাঁতার ইত্যাদি কারণেও হাইমেন ছিঁড়ে যেতে পারে। কাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হাইমেন যদি খুব পাতলা হয় তাহলে সেরকম ঘটনা ঘটতেও পারে, আবার নাও পারে। তাই এই বিষয়ে যদি মনে শঙ্কা থাকে তাহলে কাপ ব্যবহার না করাই ভালো। কিন্তু এইটুকু জেনে রাখুন হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার সাথে ভার্জিনিটির কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন/ধারণা ২ : পিরিয়ডে ব্যবহৃত কাপ আলমারিতে রাখা যায় না/পিরিয়ডের জিনিস গ্যাসে বা মাইক্রোওভেনে তুলব কীভাবে?
আমরা জানাচ্ছি : এটাও সম্পূর্ণ ঐ ঋতুস্রাব সংক্রান্ত কুসংস্কারগুলোর ফসল। এই সময় আচার ধরলে আচারে ছাতা পরে যায়, ঠান্ডা জিনিস খেতে নেই, ওটা দূষিত রক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমত কাপটি প্রতি পিরিয়ডে ব্যবহারের আগে একবার মাত্রই স্টেরিলাইজ করতে হয়। সেটা গ্যাস ওভেনে ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে বা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ৩-৪ মিনিট ফুটিয়ে করতে হয়। আপনি তো কাপটা কোনো বাটিতে ফোটাবেন নিশ্চয়ই। সেই বাটিটা ভালো করে ধুয়ে নিলেই হল। বা এর জন্য আলাদা একটা বাটিও বরাদ্দ করতে পারেন। তাও যদি মন খুঁতখুঁত করে সেক্ষেত্রে ইলেকট্রিক স্টেরিলাইজার ব্যবহার করতে পারেন। আর পিরিয়ড শেষে বেবিসোপ বা মাইল্ড বডিওয়াশ দিয়ে কাপটিকে ধুয়ে একটি কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে রাখবেন যা মোটামুটি কাপটি কেনার সময়ই সঙ্গে পাবেন। পিরিয়ডের সময় কোনো জামাকাপড়ে বা চাদরে রক্তের দাগ লাগলে সেটিকে কেচে আলমারিতে তুলে রাখেন নিশ্চয়ই, তাহলে এটির ক্ষেত্রে না পারার কোনো প্রশ্নই নেই।
প্রশ্ন/ধারণা ৩ : কাপ পরে থাকলে মলমূত্র ত্যাগ করতে অসুবিধা হয়, বারবার খুলে যাওয়ার ভয় থাকে।
আমরা জানাচ্ছি : একেবারেই তা নয়। কাপটি ভ্যাজিনার ভিতর সাকশনের মাধ্যমে আটকে থাকে, ফলে মলমূত্র ত্যাগের ক্ষেত্রে এর বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন/ধারণা ৪ : কাপ যদি ইউটেরাসের ভিতর ঢুকে যায় / যদি ভিতরে আটকে থাকে, বের করতে না পারি?
আমরা জানাচ্ছি : না, আপনি খুব চেষ্টা করলেও কাপ আপনার ইউটেরাসে ঢোকাতে পারবেন না। কারণ যে পথে পিরিয়ড ব্লাড বেরোয়, সেটি খুবই সরু আর তার ছাড়াও যেহেতু সাকশনের মাধ্যমে কাপ আটকে থাকে তাই সেটি খুব বেশি নড়াচড়াই করে না। একইভাবে তাই ভ্যাজিনার ভিতরে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। কাপের নীচের দিকে একটি স্টেম থাকে, সেটি ধরে সামান্য চাপ দিলেই ভ্যাকুইম তৈরি হয় ও কাপটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু যদি ভুলভাবে ব্যবহারের কারণে আটকেও যায়,তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যে কোনো গাইনোকলোজিস্ট খুব সহজেই ওটিকে বের করে দেবেন ও আপনাকে সঠিক পদ্ধতিও বুঝিয়ে দেবেন।
প্রশ্ন/ধারনা ৫ : সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ না হলে কাপ ব্যবহার করা যায় না।
আমরা জানাচ্ছি : সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। প্রথম পিরিয়ড থেকেই কাপ ব্যবহার করা যায় যদি নির্দিষ্ট মানুষটি তাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ আছেন কী না সেটার বিচারে কাপের সাইজ বোঝা যেতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে ব্যবহার করার বা না করার কোনো সম্পর্কই নেই।
প্রশ্ন/ধারণা ৬ : মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে ক্যানসার হতে পারে।
আমরা জানাচ্ছি : একদমই নয়। কাপ ব্যবহার করার সাথে কোনোরকম জেনিটাল অসুখ হওয়ার সম্পর্ক নেই। বরং প্যাড বা ট্যাম্পনে যে rash বা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে সেগুলোও কাপের ক্ষেত্রে দেখা গেছে হয়ই না। ওগুলোতে যে কেমিক্যাল, আর্টিফিশিয়াল সেন্ট ব্যবহার করা হয় সেগুলি বরং বেশ ক্ষতিকর। ট্যাম্পন রক্তের সাথে ভ্যাজিনাল ন্যাচারাল ফ্লুইডও শুষে নেয়, যা অস্বাস্থ্যকর। কাপ ব্যবহার করলে ভ্যাজিনার পিএইচ ব্যালেন্সও ঠিক থাকে। শুধুমাত্র আপনার যদি সিলিকন বা লেটেক্সে অ্যালার্জি থাকে তাহলে আপনার পক্ষে এটি ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন/ধারণা ৭ : রাস্তাঘাটে বেশিদূর যাতায়াতের ক্ষেত্রে কাপ ব্যবহার অসুবিধাজনক।
আমরা বলছি : হ্যাঁ এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে সামান্য অসুবিধা হতে পারে। সমাধান যদিও আছে, কিন্তু সেটা সবসময় সম্ভবপর নাও হতে পারে। সমাধান বলতে একটি আলাদা জলের বোতল বইতে হবে, পাবলিক টয়লেটে কাপ পরিষ্কার করতে ঐ জল ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও আবার সেই এক কথা বলছি, পিরিয়ড নিয়ে ছুৎমার্গ থাকলে এই সমাধানেও সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া পোর্টেবল ইলেকট্রিকাল কাপ স্টেরিলাইজার কিনতে পাওয়া যায়, সেটাও সঙ্গে রাখা যেতে পারে।
প্রশ্ন/ধারণা ৮ : কাপ পরে ঘুমাতে ভয় করে। খেলাধূলা, কাজকর্ম করতে অসুবিধা হতে পারে।
আমরা বলছি : কাপ পরে একদম নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়, দৌড় ঝাঁপ, খেলাধূলা, হালকা ব্যায়াম করা যায়। মায় সাঁতার পর্যন্ত কাটা যায়। এটি এমনভাবেই আমাদের ভ্যাজিনাল ডোর-এর মধ্যে আটকে থেকে যে এটি ব্যবহার করা অবস্থায় কোনোরকম শারীরিক কাজেকম্মেই কোনো অসুবিধা হয় না। মহিলাদের শরীরে এই সময় যে যে ধরনের অসুবিধা দেখা যায়, কাজের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো হয়, মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে সেই জটিল অঙ্কগুলোর উত্তর অধিকাংশ সময়ই মিলে যায়।
ভুলে গেলে চলবে না, পিরিয়ড একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা। এটাকে নিয়ে অকারণ গোপনীয়তা একেবারেই অর্থহীন। বরং আরও বেশি করে আলোচনা হওয়া, সচেতনতা তৈরি করা দরকার। একটি স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেওয়ার মত প্রাপ্তমনষ্ক হতে এই সমাজের আরও কতটা সময় লাগবে আমাদের সত্যিই জানা নেই।
..................................
কভার পোস্টার ঋণ : Maja Babic