আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে
ছোটবেলায় যখন চৌবাচ্চার এক পাইপ দিয়ে জল ঢুকে অন্য পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যেত আর আমি হাজার চেষ্টা করে, খাতায় অনেকবার পেন ঘষেও অঙ্কের হিসেবে জল ঢুকে যাওয়া আটকাতে পারতাম না, তখন বাবা খুব গম্ভীর গলায় বলতেন, “তোর দ্বারা আর কিছু হবে না, শেষে চাষবাস করে কাটাবি”। অবোধ আমি, চাষি হওয়ার যন্ত্রণা সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। মজার ব্যাপার হল, “৩ জন কৃষক ৭.৫ একর জমি ১১ দিনে চাষ করেন ...” – এই জাতীয় অঙ্ক না পারলেও বাবা ওই একই কথা বলতেন। এবার আমি পড়ে যেতাম মহা দ্বিধায়! চাষবাসের অঙ্কও বুঝতে পারিনা, এমন ছেলে চাষিই বা হবে কী করে! যাই হোক, মোদ্দা কথাটা হল এই যে গড়পরতা বাঙ্গালির কাছে কৃষকের কদর ঠিক ওইটুকুই।
অশিক্ষিত না হলে যে কেউ লাঙল ধরে না, এই বিশ্বাস আমাদের এমন মজ্জাগত যে পরপর পঞ্চাশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার দেখলেও আপনি এমন একজনকে পাবেন কিনা সন্দেহ যে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির পরে বাঙালি আজকাল ছেলে-মেয়েকে যা পড়াতে ভালবাসে তা হল মাইক্রোবায়োলজি/বায়োটেকনোলজি। বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের বিশেষ দরকার পড়েনা, নামগুলোই চিত্তাকর্ষক। তাও যারা ফাঁকতালে ভুল করে বা ভালবেসে এগ্রিকালচারাল সায়েন্স নিয়ে এগিয়ে গেছে, তাদের মধ্যেও লাঙল ধরার তাগিদ যাদের থাকে তারা ক্ষণজন্মা। ফলত, শিক্ষিত চাষি ব্যাপারটা এখন সোনার পাথরবাটি। আপাতদৃষ্টিতে এর প্রভাব এমন কিছু সাংঘাতিক নয়; আকাশবাণীর চ্যানেল আর আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞদের প্যানেল – দুইয়ে মিলে চাষিদের জৈবসার, বীজ বপনের নতুন উপায়, সেচের প্রযুক্তি, সব বিষয়েই দক্ষভাবে জ্ঞান দিয়ে থাকে। সমস্যাটা বোঝা যায় আমাদের সরকারি কৃষিনীতির দিকে তাকালে। এমনিতে এদেশে রাজ্যভেদে জমির মালিকানার চরিত্রে ভাল মতো বদল চোখে পড়ে; পাঞ্জাবে কৃষকরা একলপ্তে অনেকটা জমির মালিক, সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ বা ওড়িশায় কৃষকমাত্রেই ছোট ছোট জমির মালিক। তার মধ্যে প্রায় ৬৩% বর্ষানির্ভর, বাকিটা সেচনির্ভর। এই কারণে সেচের রকমফের থেকে শুরু করে সঠিক ফসল বাছাই, সবকিছুই জমিবিশেষে পালটে যায়। তার উপর সবুজ বিপ্লবের সুফলের ভাঁড়ার অনেক আগেই নিঃশেষ, এখন ক্ষতিকর দিকগুলো বেশি করে সামনে আসছে। যথেচ্ছ কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, selective farming অর্থাৎ একটি ফসলের কোনো একটি বিশেষ প্রকারভেদের যথেচ্ছ চাষ, ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহার – এইসব কারণে দেশের অনেক জায়গা থেকেই বিভিন্ন ফসলের জিনগত বৈচিত্র্য কমতে শুরু করেছে। কিছু বিশেষ প্রজাতির ধান যেমন এখন আর পাওয়াই যায়না এবং এই প্রবণতা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। জনসংখ্যা প্রতি আদমসুমারিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ কৃষিজমির পরিমাণ অথবা প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ শেষ দশবছরে কিছুই বাড়েনি। তথ্যপ্রযুক্তি বা ভারি শিল্প যেভাবে লগ্নির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, কৃষিকে সেইভাবে একটা লগ্নিক্ষেত্র করে তোলার প্রয়াস ততটা চোখে পড়েনা। একেবারেই যে কিছু হচ্ছে না, এমনটা বলা ভুল। কৃষিজ পণ্যের e-retailing -এর ক্ষেত্রে Mahindra & Mahindra বা Reliance -এর প্রবেশ ঘটেছে সার্থকভাবেই, মিতসুবিশির সঙ্গে হাত মিলিয়ে IFFCO তৈরি করছে অ্যাগ্রো-কেমিক্যাল। কিন্তু সরকারি ভাবে সুস্পষ্ট নীতির অভাব কৃষিক্ষেত্রকে এখনও কম ঝুঁকির ভালো লগ্নি হিসেবে তুলে ধরতে ব্যর্থ। উল্লেখ্য, নয়া কৃষি-বিলে বহুজাতিক সংস্থার ব্যবসার রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে, কিন্তু চাষের উন্নতিকল্পে সরকারি অদূরদর্শিতা এখনও একইরকম প্রকট। অথচ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফসল-উৎপাদক দেশের বাসিন্দা আমরা; আমাদের কর্তব্য ছিল গবেষণা ও গরু চালানোর মধ্যে সেতুবন্ধন করা! সেটাও সঠিকভাবে করে ওঠা হয়নি।
অথচ একটা সময় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ হয়েছে পরিকল্পনামাফিক। সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে এসেছে High yielding variety (HYV) এবং বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ Golden Rice; সরকারি প্রচার ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির দক্ষতায় এগুলোই হয়ে উঠেছে চাষিদের একমাত্র সহায়। এর ফলাফল সম্পর্কে তর্ক চলতে পারে, তবে বাস্তব চিত্র বলছে যে কৃষকরা আগে স্বনির্ভর ছিলেন, তারাই এখন বাজারে গিয়ে বীজের দোকানে ক্রেতা হিসেবে লাইন দিচ্ছেন। যে প্রাকৃতিক শস্য-বৈচিত্র্য অতি-উৎপাদনে সক্ষম ছিল, তাদের সরিয়ে জায়গা নিয়েছে এই HYV শস্য, যা কিনা রাসায়নিক সারের সাহায্য ছাড়া উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সক্ষম নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে একটা সময় গরিবশাল ধানের চাষ হত। এই ধানের নাম আমার-আপনার কাছে অপরিচিত, কিন্তু জানলে চমকে উঠতে হয়, এই ধান প্রতি কেজিতে প্রায় ১৫ মিলিগ্রাম সিলভার অর্থাৎ রুপো আত্মীকরণ করতে পারে! প্রচলিত কথা অনুযায়ী, এই ধান নাকি ক্রনিক গ্যাস্ট্রোলজিক্যাল সমস্যায় ভালো কাজ দেয়। যদিও এই দাবী পরীক্ষিত নয়, তাও যেকোনো GM crop-এর তুলনায় এর ক্ষমতা যে অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আরেকটি অখ্যাত ধানের প্রকার, বাদশা শাল, প্রতি কেজিতে ১৩০ মিলিগ্রাম আয়রন আত্মীকরণ করতে পারে। সেখানে বহু খরচের জেনেটিক প্রযুক্তিনির্মিত Monsanto MS13-এ আয়রন থাকে প্রতি কেজিতে ৭ মিলিগ্রাম। তুলনা করাটাও হাস্যকর। বর্তমানে এই ধানগুলি প্রায় বিলুপ্তির পথে; সরকারি স্তরে এদের চাষের জন্য কোন উদ্যোগ তো নেই, উল্টে গোটা কৃষিব্যবস্থাটাকেই একমুখী করে দেওয়ার একটা জোরদার প্রচেষ্টা আছে।
এখন সরকারি উদ্যোগ যেখানে সীমিত, সেখানে ব্যক্তিগত দক্ষতার একটা বিশেষ কদর থাকে। এমনিতেও আমাদের দেশে দলগত প্রচেষ্টার তুলনায় এক বা একাধিক হিরো বেছে নেওয়ার একটা ঐতিহ্য আছে, কুরুক্ষেত্র থেকে ক্রিকেট সর্বত্রই তা প্রযোজ্য। কৃষিকাজের মতো একটা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি করে কার্যকর। তেমনই এক প্রচেষ্টার নাম ডঃ দেবল দেব। নাম শুনলে চিনবেন না, ইনি বিশেষ কোনো কেউকেটা নন; কোনো কমিটি বা বিদেশের সেমিনারে এঁকে দেখা যায়না। ভদ্রলোক একটা সময় ফুলব্রাইট ফেলো ছিলেন, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করেছেন। শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যার প্রত্যন্ত প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে, কৃষকদের সঙ্গে থেকে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এই ক্ষ্যাপামির সন্তান হল ‘ব্রীহি’ (Vreehi, Rice in Sanskrit), ভদ্রলোকের একক চেষ্টায় স্থাপিত একটি আঞ্চলিক বীজ-ব্যাঙ্ক। দেবলবাবুর কাজ করার ধরনটি বেশ অন্যরকম; ইনি এবং এঁর সহযোগীরা মিলে বিভিন্ন প্রজাতির বিশেষ বিশেষ ধানের প্রকার খুঁজে বের করেন, তারপর নিজেদের সংস্থার জমিতে সেগুলি ফলানোর চেষ্টা করেন। ফলন সফল হলে সেই বীজ চাষিদের মধ্যে বিতরণ করেন; শর্ত একটাই, ওই বীজ থেকে ধান ফলিয়ে তাঁকে দ্বিগুণ বীজ ফেরত দিতে হবে। তাই হয় এবং ফেরত আসা বীজ তিনি আবার অন্য চাষিদের দিয়ে দেন। এই করে শুধুমাত্র উড়িষ্যায় ২০০০ চাষিদের মধ্যে প্রায় ৩৫০ প্রকার ধানের চাষ সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উপরে উল্লিখিত গরিব শাল ও বাদশা শাল ছাড়াও আছে আরও ৬৭ প্রকার আয়রন সমৃদ্ধ ধান, ১৬ প্রকার ক্ষরা-প্রতিরোধী ও ১১ প্রকার লবণ-প্রতিরোধী ধান, ১০০ প্রকার ধান যা ৪-৬ফুট জলের মধ্যেও বাড়তে পারে এবং ১৫২ প্রকার সুগন্ধী ধান। বছর কয়েক আগে এঁরা নিজস্ব উদ্যোগে ৬টি লবণ-প্রতিরোধী ধানের প্রকার সুন্দরবনে চাষ করেন। সেই চাষ যে শুধু সফল হয়েছে তাই নয়, ২০০৯-এর বিধ্বংসী আয়লাতেও এরা দিব্যি টিকে গেছে। আম্ফানের পর অবিশ্যি এত আশা না রাখাই ভাল।
সমস্যাটা এইখানে নয় যে দেশজ বিজ্ঞানীরা সবাই ঝাঁ-চকচকে গবেষণাগারের আগল ছেড়ে কেন জমিতে নেমে এইভাবে কাজ করছেন না, সেটা সবার করার কথাও নয়। সত্যি বলতে, পরীক্ষাগারের মধ্যে হওয়া গবেষণারও প্রয়োজন আছে বইকি; তা না থাকলে এই দেশের কৃষিবিপ্লব স্বপ্নই থেকে যেত। কিন্তু এই যে বিভিন্ন ফসলের চাষের ক্ষেত্রে একটা বা দুটো বিশেষ প্রকারভেদের দিকে ঠেলে দেওয়ার একটা প্রবণতা চলে এসেছে, এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্তমানে ভারতে শুধুমাত্র ধানের প্রকারভেদের সংখ্যা ৭০০০, যা একশো বছর আগেও ছিল অন্তত দশগুণ বেশি। বাকি ফসলও আস্তে আস্তে একইদিকে এগোচ্ছে। দেশের প্রাকৃতিক ফসল বৈচিত্র্য এখন প্রশ্নের মুখে এবং সরকারি স্তরে সেই নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। সমস্যাটা এইখানেই। ঈশ্বরী পাটনী থেকে আমার-আপনার বাবা-মা, সবাই অন্নপূর্ণার কাছে একটাই প্রার্থনা করে এসেছেন। আমরাও বাবা-মা হলে তাই করব। প্রশ্ন হল, দুধে তো জল অনেকদিনই মিশেছে, ভাতও বেশিদিন জুটবে কি?
#Food Crisis #Environment #Agriculture #Science #Organic farming #খাদ্যসংকট #কৃষি #জৈবকৃষি #সায়নদীপ গুপ্ত #পরিবেশ ও প্রাণচক্র