ম্যাও বনাম মানুষ: গুপ্তচরের আজব কিসসা
আসল গল্প সেই ছয়ের দশকের। তবে থলি থেকে বিড়াল বেরোল তার প্রায় চার দশক পর। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিভাগের বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশিত হয়। তাতে ১৯৬০ সাল নাগাদ C.I.A-পরিকল্পিত এক দুর্দান্ত প্রকল্পের কথা জানা গেছে। মা ষষ্ঠীর বাহনকে দিয়ে সোভিয়েত শিবিরে গুপ্তচরগিরি করানোর নীল নকশা ছকেছিল মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের এই দুর্দম বাহিনী। ঠান্ডা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পায়রা, দাঁড়কাক, বাদুড়, রাকুন, ডলফিন ইত্যাদি নানাবিধ প্রাণী নিয়ে সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েক দশক ধরে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেইসব পরীক্ষার ফলাফল কতদূর পৌঁছেছিল, তা বলা সম্ভব না। কিন্তু মানবেতর প্রাণীদের দিয়ে সিআইএ-র গোয়েন্দাগিরি করানোর যেসব নজির রয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিনব আর রোমাঞ্চকর চেষ্টা নিঃসন্দেহে এই মার্জার-প্রকল্প। এর জন্য বিস্তর টাকাও ঢেলেছিল তারা। যদিও অনেক সাধের এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
কে না জানে যে বিড়ালের মতো সেয়ানা প্রাণী কমই হয়। বিড়াল যে-কোনো জায়গায় অনায়াসে পৌঁছতে পারে। বিড়ালের চলাফেরা যেমন অসম্ভব ক্ষিপ্র, তেমনই অভাবনীয় তার দেহের নমনীয়তা। উপরি পাওনা তার নরম, আদুরে, আপাত নিষ্পাপ ভঙ্গি। তা ছাড়া বিড়াল যে-কোনো জায়গায় সহজলভ্য। পথে-ঘাটে, পাঁচিলে, কার্নিশে, বাড়ির আনাচেকানাচে হামেশাই বিড়ালকে ঘুরে বেড়াতে বা আয়েশ করতে দেখা যায়। ফলে একটা বিড়াল দেখলে চট করে কেউই সন্দেহ করবে না যে সে শত্রুপক্ষের চর হতে পারে। এই গুণগুলোকেই সিআইএ ব্যবহার করতে চেয়েছিল। সিআইএ-র চিকিৎসকেরা অপারেশনের মাধ্যমে বিড়ালকে আস্ত একটা ট্রান্সমিটারে পরিণত করেছিলেন। রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ‘অ্যাকুস্টিক কিটি’ নামের এই প্রজেক্টের জন্য সে সময় ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে এই একই পরিকল্পনা ইঁদুর আর কাকের মতো প্রাণীর মাধ্যমেও পূরণ করার ভাবনা ছিল। তবে বিড়ালের শারীরিক গঠন এ কাজের উপযুক্ত ছিল বলে শেষমেশ বিড়ালকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। বেশ জটিল অপারেশন করে প্রাণীটিকে (অবশ্য একটি নয়, একাধিক বিড়ালও হতে পারে) প্রস্তুত করা হয়েছিল। প্রাক্তন সিআইএ কর্মকর্তা ভিক্টর মারকেট্টি তাঁর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ‘The CIA and the Cult of Intelligence’ বইতে এ বিষয়ে সামান্য বর্ণনা দিয়েছেন– “বিড়ালের ঘাড়ের নিচের অংশে ছোট রেডিও ট্রান্সমিটার লাগানো হয়েছিল। তার সঙ্গে সরু তারের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল বিড়ালের কানের অংশে লাগানো ছোট মাইক্রোফোন। সঙ্গে ছিল অত্যন্ত ছোট আকারের ব্যাটারি ও অ্যান্টেনা। বিড়ালের কানের লতির মধ্যে মাইক্রোফোন লাগানোর একটি বড় কারণ ছিল এদের কানের বৈশিষ্ট্য। এদের কান থেকে বেশ ভালো আউটপুট পাওয়া যায়।” অপারেশনের পর তাকে পাঠানো হয় দীর্ঘ প্রশিক্ষণের জন্য। তবে এই প্রশিক্ষণ কীভাবে হত, সে বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রস্তুতি শেষে এই হাইটেক মার্জারের প্রথম অভিযান ছিল ওয়াশিংটনের উইসকনসিন অ্যাভিনিউয়ে সোভিয়েত দূতাবাসের পাশের একটি পার্কে। পাশেই একটি গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। কিন্তু বিড়ালটিকে ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্যাক্সি চাপা পড়ে বিড়ালটি মারা যায়। অপারেশনের ধাক্কা বা দেহে অত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থাকার জন্য বিড়ালটির স্বাভাবিক চলাফেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কি না সেটা একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে থেকে গেছে। ২০০১ সালে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর জেফারি রিচেলসন নামে একজন প্রাক্তন সিআইএ কর্তা বলেছিলেন, যদি গাড়ির চাকায় মারা না যেত, তাহলেও প্রাণীটার বেশিদিন বাঁচার কথা ছিল না। দেহে যথেচ্ছ অপরিকল্পিত কাটাছেঁড়ার জন্য বিড়ালটা এমনিতেই মারা যেত। তবে সিআইএ-র তৎকালীন পরিচালক রবার্ট ওয়ালেস ২০১৩ সালে বিড়ালটির মৃত্যুর কথা অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর কথায়, বিড়ালটির শরীর থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো খুলে নেওয়া হয়েছিল। এরপর বিড়ালটি দীর্ঘদিন স্বাভাবিকভাবেই জীবিত ছিল।
আসলে কী হয়েছিল সে বিষয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা থেকেই যায়। এরপরেও আরও একবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সাফল্য আসেনি। তারপর সিআইএ প্রকল্পটি বাতিল করে। পরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত কারণ তাদের ভাবাচ্ছিল। জানাজানি হলে রাজনৈতিক মহলে তো মুখ পুড়বেই, পশুপ্রেমীরাও ছেড়ে কথা বলবেন না। পাশাপাশি, প্রায়োগিক দিক থেকে এই প্রকল্পের সাফল্য নিয়েও দ্বিধান্বিত ছিলেন সিআইএ কর্তারা। ওয়ালেসের কথায়, ভাবনার দিক থেকে অত্যন্ত অভিনব ও চমকপ্রদ হলেও ক্রমশ বোঝা যাচ্ছিল যে বিষয়টা তেমন বাস্তবসম্মত না। সিআইএ-র দাবি, ১৯৬৭ সালে তারা এই প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেয়।
২০০১ সালে রিপোর্ট ফাঁস হবার পর এই ‘অ্যাকুস্টিক কিটি’-র বিষয়টা নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে যায়। পরের বছর কানাডিয়ান গায়ক জন মান এই নামে একটি অ্যালবাম বের করেন। অ্যালবামের একটি গানে তিনি সিআইএ-র এই কাণ্ডকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ২০০৭ সালে এই ঘটনাকে বিষয় করে এই নামেই বব রিবারজাইকের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। পরিচালক জেনিফার শেরিডান ২০১৪ সালে এই ঘটনা নিয়ে একটি ১০ মিনিটের ছোট ডার্ক কমেডি ছবি বানান। ছবিটি সমালোচকদের প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিল।
ভার্জিনিয়ার নিজেদের হেডকোয়ার্টারস, হট স্প্রিং-এর ‘আই কিউ জু’ সহ আরও নানা গোপন ঘাঁটিতে সিআইএ বিভিন্ন পশু-পাখি নিয়ে এই ধরনের যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল, তার খুব সামান্য অংশই জানা সম্ভব হয়েছে। খোদার ওপর যেমন খুশি খোদকারি করতে গিয়ে এথিকস বা ন্যায়নীতির ধার মাড়ানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। কখনও কখনও উদ্দেশ্যে সফলও হয়েছিল। সিয়া-র বিড়াল পাশ করতে না পারলেও অন্য কেউ কেউ পাশ নম্বর তুলতে পেরেছিল। সেই ঝাঁপি খুলে বসা যাবে অন্য কোনও সপ্তাহে।
....................................