কানের রেড কার্পেট থেকে মণিপুরের কাংলা: নগ্নতা যখন স্লোগান
১৯৫৮ সালে মণিপুরে জারি হয়েছিল ‘আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার) অ্যাক্ট’। সংক্ষেপে আফস্পা। উপদ্রুত অঞ্চলে যাতে মাইলের পর মাইল জুড়ে শান্তিকল্যাণ বিছিয়ে রাখা যায়, তারই সুবন্দোবস্ত করার ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। পার্লামেন্টে যখন এই আইনে শিলমোহর পড়ছে, তখনও থাংজাম মনোরমার জন্মের কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। কিন্তু তাদের পৃথিবীটা যে শিশুর বাসযোগ্য নেই আর, সে কথা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত জেনে গিয়েছিল খুব দ্রুত। ‘চিংকি’-দের বাঁচামরা নিয়ে বাকি ভারতের কোনও দিনই বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না অবশ্য। আর আপাতত উপদ্রুত এলাকা আইন (ডিস্টার্বড এরিয়া অ্যাক্ট)-এর বলে আরও কোণঠাসা করে দেওয়া গিয়েছিল তাদের। মনোরমার জন্ম, আর তারপর বেড়ে ওঠার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ এক-একটা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিল একজন দুজন করে লোক। ভারত তখন বিশ্বকাপ জিতছিল। বিশ্বের মঞ্চে অনেক আলোর ঝলকানির মধ্যে মিস ওয়ার্ল্ড কিংবা মিস ইউনিভার্সের খেতাব উঠছিল ভারতের মেয়েদের মাথায়। আর অন্য এক ভারতের পেটের ভিতর বসে প্রাণপণে সব আলো থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখতে চাইছিল মনোরমা-রা। ক্রমাগত গুলির শব্দ, বারুদের গন্ধ, টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ— এ সবকিছু অভ্যাস করে নিতে নিতে মনোরমার বয়স পা রেখেছিল বত্রিশে। আর ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক তারপর।
এক রাতে বাড়ি থেকে থাংজাম মনোরমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কিছু পুরুষ। গায়ে তাদের ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর উর্দি। মনোরমা জানত, ওরা ১৭ অসম রাইফেলস-এর সেনা। দিনের পর দিন এই পাণ্ডববর্জিত এলাকায় থাকতে থাকতে সেইসব পুরুষদের খুব একা লেগেছিল হয়তো। তাই মনোরমার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। পরদিন বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মনোরমার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ক্ষতবিক্ষত। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটা লাশ। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ধর্ষণ এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মণিপুরের মেয়েটি। “এ সব ঘটে রোজ/ কোথায় কোন তরুণী পড়ে আছে/ কোথায় তার অন্য বোন নিখোঁজ”... কিন্তু সেদিন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। মনোরমার মৃত্যুর প্রতিবাদে এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মণিপুরের মায়েরা। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বারোজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছিলেন মণিপুরের কাংলা দুর্গে, অসম রাইফেলসের সদর দফতরের সামনে। তাঁদের দু’হাতে তুলে ধরা ফেস্টুনে লেখা ছিল: ‘‘ভারতীয় সেনা, আমাদের ধর্ষণ করো।’’
২০০৪ সালের ১১ জুলাই যখন মনোরমার মৃতদেহ পড়ে ছিল, তারও চার বছর আগের কথা। বিতর্কিত আফস্পা আইনের প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যেই মঞ্চে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাবিত্রী হেইসনাম। মণিপুরের খ্যাতনামা নাট্যকুশলী দম্পতি কানহাইয়ালাল ও সাবিত্রী রাষ্ট্রের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে বেছে নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘দ্রৌপদী’ গল্পটিকে। সে গল্পেও প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল নগ্নতা। যে নগ্নতা চোখের খিদে মেটায় না, যে নগ্নতার সামনে চোখ ঝলসে যায়। সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে বাদ পড়া সেই গল্পটি বলেছিল জোতদারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে খেতমজুরদের জোট বাঁধার বয়ান। খেতমজুরদের পুরোভাগে ছিল দোপদী আর দুলনা। এসব বেয়াদপি রাষ্ট্রের সহ্য হবে কেন! তাই একদিন তিনটে গ্রাম ঘিরে ফেলে গুলি চালাল পুলিশ। সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সবাই মরে গেল। অন্তত পুলিশ তাই ভেবেছিল। কিন্তু, ওই যে, কে কোথায় বিপ্লবের বারুদ জমিয়ে রাখছে তা জানতে রাষ্ট্রের এখনও বাকি আছে। মরার ভান করে পালিয়ে গিয়েছিল ওরা দুজন, দোপদী আর দুলনা। কিন্তু ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, পালিয়ে আর কতদিন বাঁচা যায়! ধরা পড়ার পর দুলনাকে গুলি করে মারে পুলিশ, কিন্তু সাতাশ বছরের দোপদী যে মেয়ে। তাই অফিসারের নির্দেশে পুলিশরা ‘বানাতে’ লাগল তাকে। সাতজন অব্দি বোধহয় দোপদীর চোখ খোলা ছিল। তারপরে জ্ঞান হারায় সে। পরদিন সকালে অফিসারের ব্রেকফাস্ট টেবলের সামনে এসে দাঁড়ায় দোপদী মেঝেন। তখন তার গায়ে একটা সুতোও নেই। তার কাপড় যারা খুলে নিয়েছে, তাকে কাপড় পরানোর অধিকার আর তাদের দেবে না দোপদী।
ঠিক এই কথাই কি বলতে চেয়েছিলেন ওই তরুণী, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সুসজ্জিত নন্দন কাননে ঝড়ের মতো ছুটে এলেন যিনি? যে রেড কার্পেটে হেঁটে যাওয়া সুন্দরীদের পোশাক, অ্যাকসেসরিজ আর মেকআপ নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ নিউজরিল খরচ হয়, ক্রমাগত ঝলসে ওঠে অসংখ্য ফ্ল্যাশবাল্ব-- ঠিক সেইখানে, গ্ল্যামারের স্বর্গরাজ্যে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা সুতোও নেই। নিম্নাঙ্গে কেবল একটুকরো লঁজেরি, তা ছাপিয়ে অনাবৃত পা পর্যন্ত পৌঁছেছে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নেরা। আর অ্যাকসেসরিজ? খোলা বুকে ইউক্রেনের জাতীয় পতাকার দুটো রং। তার উপরে অসহ্য তীব্রতায় জ্বলজ্বল করছে ঠিক তিনটে শব্দ। ‘স্টপ রেপিং আস’।
সভ্যতা পোশাক পরার কথা বলে। কিন্তু যে সভ্যতা অন্যের সম্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করে পোশাক কেড়ে নিতে পারে, সেই সভ্যতার বানানো নিয়ম মানার দায়ও শেষ হয়ে যায় সেই মুহূর্তেই। এ কথা বলতে চেয়েই বোধহয় নগ্নতাকে বারবার প্রতিবাদের পোশাক করে তুলেছেন একাধিক নারী। রাষ্ট্রের হাতে যারা ধর্ষিতা হয়, অত্যাচারিতা হয়, রাষ্ট্রের প্রচলিত নিয়মকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়েই প্রতিবাদ ছুড়ে দেয় তারা। ঠিক যেমনভাবে নগ্ন হয়ে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রবেশ করেছেন ফরাসী নারীবাদী সংস্থা ‘এসসিইউএম’-এর সদস্য ওই মহিলা। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের উপরে লাগাতার আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া, আর এই যুদ্ধের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে ইতিমধ্যেই ধর্ষিতা অন্তত দশ হাজার মহিলা। এমনকি নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি সাত বছরের নাবালিকাও। বিশ্বের দরবারে এই বর্বরতার প্রতিবাদ তুলে ধরতেই নগ্ন শরীরে ইউক্রেনের পতাকার রং বয়ে এনেছিলেন ওই মহিলা। তিনি একা নন, ২০০৮ সালে ইউক্রেনেই শুরু হয়েছিল ‘ফিমেন’ গোষ্ঠী, যা মেয়েদের যৌন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাদের উপরে হওয়া যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিয়মিত টপলেস প্রতিবাদের আয়োজন করে থাকে। এর আগে ইরাক যুদ্ধের সময়েও দেখা গিয়েছে প্রতিবাদের এই বিশেষ ধরন। দেখা গিয়েছে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে উগান্ডার মেয়েদের প্রতিবাদমিছিলেও। মেয়েদের উপরে ঘটে চলা নির্যাতন ও হিংসার প্রতিবাদে ২০১৭ সালে বুয়েনস আইরেসে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান ১০০ জনেরও বেশি নগ্ন মহিলা। আবার ২০১০ সাল নাগাদ, আরব বসন্তের সময় ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন মেয়েরা। নেট দুনিয়ায় আছড়ে পড়েছিল তাঁদের একের পর এক নগ্ন ছবি। এইভাবেই তাঁদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের বাধার দেওয়াল ভাঙতে চেয়েছিলেন ওই মেয়েরা।
যুদ্ধের অনিবার্য উপজাত হিসেবে আসে মেয়েদের উপরে হওয়া অত্যাচার, পীড়ন, ধর্ষণ। তাই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে বারবারই দেখা গিয়েছে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদের ছবি। তা ছাড়া যুক্তি বলে, পোশাক পরাই যেহেতু সভ্য সমাজের শর্ত, ফলে নগ্নতা সহজেই সকলের নজর কাড়ে। সুতরাং প্রতিবাদের যা প্রাথমিক কাজ, নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তা সাধিত হয় অনায়াসে। ২০২০ সালে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পরবর্তী প্রতিবাদ মিছিলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছিল এক তরুণীকে। কেবল মাস্ক ও টুপি পরা এই মেয়েকে গ্রিক দেবী আথেনার নামানুসারে ‘নগ্ন আথেনা’ নাম দিয়েছিল সংবাদমাধ্যম। ২০১৬ সালে এইভাবেই ব্রেক্সিটের প্রতিবাদ জানান এক নগ্ন তরুণী। ‘ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে নগ্ন করে দিয়েছে’, খোলা বুকে এ কথা লিখে নিজের নগ্নতার সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন তিনি।
আমরা তো জানি, আবরণ সভ্যতার প্রথম শর্ত। জ্ঞানবৃক্ষের ফলটি খাওয়ার ঠিক পরের মুহূর্তেই প্রকৃতির শরীর ঢেকে গিয়েছিল পোশাকে। তারপর থেকে সে আবরণ কেবল শরীরকে ঢাকেনি, মনকেও ঢেকে দিয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। ধর্ম আর রাজনীতির আশকারায় সেই ঢেকে রাখা ক্রমে চেপে রাখার কাজ করেছে, হয়ে দাঁড়িয়েছে অবদমনের হাতিয়ার। বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে পোশাক নিয়ে ফতোয়া জারির ভাষ্য তো আজ আর নতুন নয়। বিয়ের সময় কনের মাথায় সাদরে লজ্জাবস্ত্র চাপিয়ে দেওয়াই হোক, কি হিজাব-নিকাব-বোরখা চাপানোর তালিবানি ফরমানই হোক— আদতে তো সেই ঢেকে দেওয়ার গল্পই। মেয়েদের নিজস্ব স্বর, নিজস্ব চিন্তা, নিজস্ব মননকে তালাবন্ধ করে রাখার যে প্রক্রিয়া পিতৃতন্ত্র সুচারুভাবে পালন করে আসছে, পোশাক কখনও কখনও হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই একরকম ম্যানিফেস্টেশন। নারীর জায়গায় যে-কোনো অপর, যে-কোনো প্রান্তিক মানুষকে কল্পনা করে নিলেও ছবিটা কিন্তু বিশেষ বদলাবে না। আর সেই কারণেই, সেই অবদমিত অপর যখন প্রতিবাদ করতে উঠবে, তাকে তো সেই চাপিয়ে দেওয়া আবরণ ছিঁড়ে বেরোতেই হবে। সিস্টেমের সামনে দাঁড়িয়ে সে-ই হবে তার সবচেয়ে বেপরোয়া চ্যালেঞ্জ। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সমাজ প্রকাশ্যে যে নগ্নতাকে প্রাণপণে চেপে রাখতে চায়, আর আড়ালে তাকে তারিয়ে তারিয়ে চেটে নেয়, তার সেই গোপন ফেটিশকে সপাটে ভেঙেচুরে দেয় ‘অপর’ বা ‘other’-এর এহেন নগ্নতা। নগ্নতা তখন হয়ে ওঠে প্রতিবাদেরই অন্য আর অনন্য এক পোশাক।