মল্লার যেখানে নামে: পৃষ্ঠা থেকে পর্দায় জয় গোস্বামীর গল্প
‘RAY’ – নিয়ে এখন নেট দুনিয়া উত্তাল। সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু অমোঘ প্রশ্ন। সাহিত্য আর সিনেমার সম্পর্কটি ঠিক কীরকম? সিনেমা কতটুকু স্বাধীনতা নিতে পারে? সাহিত্যে যা ফুটে উঠেছিল, তাকে সিনেমায় একেবারে বদলে দেওয়া কি ঠিক? সত্যজিৎ নিজে যখন সাহিত্যনির্ভর সিনেমা করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সরে এসেছেন মূল লেখাটির থেকে। এইসমস্ত দেখে শুনে মনে হচ্ছিল সাহিত্য আর সিনেমা যেন ভীষণ অসুখী কোনও জুটি। রোজ রোজ ঝগড়া করেও যারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারেনি।
পারেনি। তাই তো সাহিত্য নিয়ে করা সিনেমা অগুনতি। কাল আড্ডাটাইমস-এ বেরিয়েছে জয়দীপ রাউতের 'মল্লার যেখানে নামে'। জয় গোস্বামীর লেখা গল্প। বেরিয়েছিল রবিবাসরীয়তে। তারও পরে প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত ‘কবির গল্প’-এর প্রথম গল্প হয়ে থেকে গেছে সে।
বিকেল আর সন্ধের কি কোনও সীমারেখা হয়? ঠিক কোন বিন্দুতে সন্ধে গড়িয়ে পড়ে রাতের শরীরে? আসলে রোজই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু অলীক প্রহর। বিকেল আর সন্ধে যখন পাশাপাশি বসে। সন্ধে মাথা এলিয়ে দেয় রাতের কাঁধে। জয়দীপ রাউতের সিনেমাটি আমাদের এনে দাঁড় করায় সেই অনামা অঙ্গনে। সিনেমা, কবিতা, গল্প, এমনকি মিঞার মল্লার যেখানে মিলে মিশে যায়। পুরো উনিশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড যেন হয়ে ওঠে রং ধোয়ার পাত্র। কোন রঙে কে মিশছে, খেয়াল থাকে না।
উনিশ মিনিট আটাশ সেকেন্ড। হ্যাঁ। এইটাই সিনেমাটির দৈর্ঘ্য। এর ভেতরেই চোখের সামনে ভেসে যাবে কিছু ছেঁড়া ছবি। ছন্ন স্বর।
সিনেমার শুরু এক কবিতা লেখার দৃশ্য দিয়ে। জয় লিখে চলেছেন একটি কবিতা। আবহে সেই কবিতাই ভেসে আসছে জয়ের ঘোর লাগা গলায়। আবৃত্তি-জানা-কিছু-বন্ধু বলেন, জয়ের কবিতাপাঠ তাঁদের ততটা প্রিয় নয়। কিন্তু জয় গোস্বামীর পাঠ যাঁরা শুনেছেন, জানেন, পাঠ শুরু করার পরেই কবি আর নিজের মধ্যে থাকেন না। নেমে পড়েন কবিতাটির বুকে। সঙ্গে নামেন সেই কবিতার শ্রোতা। একসঙ্গে। এবং একা। এই সিনেমার শুরুতেই ক্যামেরার ফোকাসে থাকে কবির কলম। সেই কলম ছুঁয়েই সিনেমাটি শুরু হল যেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের পর সম্ভবত এই প্রথম কোনও চিত্রপরিচালক জয়ের কণ্ঠকে সিনেমায় ব্যবহার করলেন। যদিও এর মধ্যে বাংলা নাটকের দর্শক সাক্ষী থেকেছেন জয়ের কবিতা পাঠের, কারুবাসনা নাটকে, তবুও বাংলা সিনেমার দর্শকের কাছে এ এক অন্য পাওয়া। যে কবিতাটি দিয়ে এই সিনেমার শুরু এবং শেষ, সেই কবিতা, “লেখক ও লিখিত মেয়েটি” খুঁজে পাওয়া যাবে জয়ের 'ওঃ স্বপ্ন!' বইয়ে।
শিল্পমাধ্যম হিসেবে কবিতা, গল্প আর সিনেমা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের ভাষাও আলাদাই। জয়দীপ রাউত কথা বলেছেন সিনেমার ভাষায়, স্বভাবতই। কিন্তু তিনি নিজে কবি। কবিতার ভাষা তিনি পড়তে পারেন। জয় গোস্বামীর প্রায় সমস্ত গল্প-উপন্যাসেই কবিতার স্বর এমন অমোঘ আর অনিবার্য হয়ে ওঠে, যে সেই ভাষা পড়তে না পারলে তাকে সিনেমায় অনুবাদ অসম্ভব। এইখানেই জয়দীপ অসাধারণ।
“সম্প্রতি এক শিল্পপতির লেখা উপন্যাসের প্রকাশ উৎসব ছিল তাজবেঙ্গলে। ঘোর পান-ভোজন ছিল। কবির যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরে ঝোলা কাচতে গিয়ে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ পত্র দেখে গৃহিণীর বিলাপ হল এই, এই, বললে না। তাজবেঙ্গলে যাওয়া যেত। নিজে তো আর কখনও নিয়ে যেতে পারবে না।”
-গল্পে ছিল এমনটাই। এই দৃশ্যের রূপায়ণে দেখা যায় স্ত্রীর প্রবল বাক্যবাণের সামনে অসহায় কবি। সঙ্গে একটি জলে ডোবার দৃশ্য। একজন জলে ডুবতে ডুবতে কার্যত খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত করে বলে চলেছেন, “আমার শব্দ আছে… শব্দ!”। এই বাক্যটিও গল্পের থেকে নেওয়া। এমনকি স্ত্রীর আক্রোশের সমস্ত কথাগুলিও। গাড়ি নেই-বাড়ি নেই- মেয়ের ইস্কুলে ভরতির টাকা নেই.. এই সমস্ত নেই-এর মাঝখানে অসহায় কবির “আমার শব্দ আছে”-এই বাক্যটি বলা। এই বলাকে জয়দীপ ধরলেন, জলে ডুবতে ডুবতে খাবি খাওয়ার দৃশ্যকল্পে। এরপরেই ডুবে যাওয়া। এবং ডুবে গিয়েই যেন খুঁজে পাওয়া সেই বিখ্যাত কবিতা। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই সিনেমার নায়িকা পড়ে চলেছেন, “অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে…”। জয়ের পাঠকের অবশ্যই মনে পড়ে যাবে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল'-র সেই দৃশ্য, যেখানে এই কবিতা আসছে। সেইখানেও কবি আর তার পাঠিকা। আর এইখানেও, কবি আর তার পাঠিকার অসমবয়সী প্রেম অনিবার্য অসহায়তায় মাথা কুটছে যেন।
সিনেমাটির শুরু হয়েছিল সমুদ্রের পাশে এক ভাঙা বাড়ির দৃশ্যে। (ফ্রেজারগঞ্জ কি?) । যেখান থেকে হেঁটে আসছে একটা সাদা শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি। পাঠিকা আর কবি। আর তাদের অসমবয়সী প্রেম। ভাঙা বাড়ি যেন হয়ে উঠছে ভাঙা প্রেমের রূপক। সেই ভাঙনের ইঙ্গিত আছে সিনেমা শুরুর কবিতায়। “সে বলে, আমি অনেকদিন আর এই দেশে থাকি না”। এই “সে” হল লিখিত মেয়েটি।
“যে মেয়েটিকে নিয়ে গল্প লিখেছিলাম, আজ হঠাৎ
সে ভেসে উঠল এই কবিতায়।
তার মুখ চুল দিয়ে ঢাকা।
ঘুরে ঘুরে তার ওপর এসে পড়ছে, যথাক্রমে
সূর্যালোক ও জ্যোৎস্না।”
এই কবিতা দিয়ে শুরু হওয়ার পর সিনেমাটিকে মনে হয় যেন এক আশ্চর্য ফ্ল্যাশব্যাক। যে ফ্ল্যাশব্যাকের শেষে আবার ফিরে আসবে ভাঙন। কবি ও পাঠিকা এসে দাঁড়াবে এক ঝড়ের দৃশ্যে। আশ্রয় নেবে এক ছাদহীন ভাঙা বাড়িতে। বাড়ি তো নয়। ইঁটের কঙ্কাল। বটগাছের শ্বাসরোধী শিকড় জাপটে রয়েছে তাকে। এই দুই ভাঙনের মাঝের রাস্তাটিতে বোনা হল এক চমৎকার প্রেমের গল্প।
“একটি বিচ্ছেদ থেকে পরের বিচ্ছেদে
যেতে যেতে
কয়েকদিন মাত্র মাঝখানে পাতা আছে মিলনের সাঁকো
মেঘ ক'রে আসবেই। পথ ঝাপসা হবেই বৃষ্টিতে
পা পিছলে তলিয়ে যাবে, তার আগে যতক্ষণ পারো
আঙুলে আঙুল আঁকড়ে রাখো।”’
বৃষ্টি এই গল্পে আর সিনেমায় খুব জরুরি একটি মোটিফ। সিনেমার সমাপ্তিকে সঙ্গত করেছে সুগত মার্জিতের কণ্ঠ। মিঞার মল্লার। গল্পটি শেষ হয়েছিল, "যখন আমার পঁচিশ বছর বয়স ছিল তখন কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে তুমি!" -কবির এই আকুতিতে। আর সিনেমার শেষ হয় মল্লার রাগে। বৃষ্টি যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে নায়িকার ওপর। ক্যামেরা একবার ধরছে সেই বৃষ্টি ধোয়া মুখ। যে মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বেদনাতুর জল। আরেকবার ক্যামেরা ধরছে নায়িকার হাত। যেখানে সে আঁকড়ে রেখেছে 'ভালোটি বাসিব'। যে বইয়ের পাতায় জমানো আছে কবির কেটে দেওয়া বাস-টিকিট। আর কবিকে লেখা চিঠি। যে চিঠি কোনও দিন পড়তে পারবেন না কবি।
দেবাশিস সেনশর্মা এবং কথা নন্দীর অভিনয় পরিচালকের ভাবনাকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে।
এই লেখা শেষ করি এক ব্যক্তিগত অভাববোধ নিয়ে। গল্পে ছিল অরুণ ভাদুড়ির গলায় মিঞা কি মল্লারে ‘বাজে ধমো ধমো’। এই গান রয়েছে ‘গান শিখি গান গাই’ নামের এক ক্যাসেটে। সেই ক্যাসেটের গানগুলির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সিনেমায় এই গানটির বদলে এসেছেন সুগত মার্জিত। এই প্রয়োগ যথাযথ সন্দেহ নেই। গেয়েছেনও অসাধারণ তিনি। তবুও ‘মল্লার যেখানে নামে’-র পাঠকের মনে গল্পটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকেন অরুণ ভাদুড়ি। ‘। “বা-জে ধমো ধমো”।
আরও পড়ুন : সত্যজিৎ, স্পর্শ, কাতরতা / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
সিনেমায় কবিতা নাকি কবিতায় সিনেমা, এই দ্বন্দ্বে না গিয়ে দেখে ফেলাই যায় ছবিটি। আজও কলকাতায় মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামবে।
.........................
[ কৃতজ্ঞতা : রূপা মিত্র বিশ্বাস। এই মল্লারের সকালে যিনি আমায় সিনেমাটি দেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। ]
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #ফিল্ম রিভিউ #মল্লার যেখানে নামে #জয় গোস্বামী #জয়দীপ রাউত #বিবস্বান দত্ত #silly পয়েন্ট