নিবন্ধ

মহাসংকটে রাজাবাহাদুর : সমকাল ও রাধাকান্ত দেব

সুদেব বসু Jan 16, 2022 at 11:00 am নিবন্ধ

“আপনার শক্তির বিচারক আপনি।”

নাটমন্দিরে তখন শুধুই শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। বক্তব্যের যিনি উদ্দিষ্ট তাঁর পিছনে দুদিকে বিশাল দুটি পাখায় বাতাস করছে দুই পরিচারক। বাতাসও যেন থমকে দাঁড়িয়েছে একথা শুনে। ছোকরা বলে কী?

১৮৫৫-৫৬ এর কলকাতা। রাজা রামমোহন গত হয়েছেন। তাঁর দুই সুহৃদ প্রিন্স দ্বারকানাথ ও স্যার ডেভিড হেয়ারও আর নেই। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ তখন উদীয়মান যুগপুরুষ। আধুনিক কলকাতার প্রতিভূ হয়ে একে একে উঠে আসছেন বেথুন সাহেব, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন, কিছুটা অনুজ কেশবচন্দ্র সেন বা কালীপ্রসন্ন সিংহেরা। আর সকলের মাঝে সূর্য সেই কালো, খর্বকায়, টিকিধারী ছোকরা, যে পণ করেছে বিধবাবিবাহের প্রচলন সে করবেই। শোনা যায় বড়লাট সাহেবের সে বড় প্রীতিধন্য। সেই সূর্যের প্রাখর্য্য বাক্যাঘাত করল বিপক্ষের মহীরুহকে। বৃদ্ধ হয়েও তিনি “রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের রাজাধিরাজ”। গড়গড়া হাতে নাটমন্দিরে যে নিদান দেন তাতেই দিকনির্ণয় করে সমাজ। রাজা সমাজপতি রাধাকান্ত দেববাহাদুর। 

৭৩ বছরের রাধাকান্ত দেব আর ৩৫-এর ছোকরা বিদ্যাসাগরের সেই দ্বৈরথের ফল কী হয়েছিল তা সর্বজনবিদিত। কিন্তু একশো পঁয়ষট্টি বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়েও রাজা রাধাকান্ত দেবের ছবির যে ফ্রেমটা আমাদের সামনে আসে তা হল চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোঁড়া সমাজ অভিভাবকের। কিন্তু ইতিহাসের পাতাগুলো ওল্টালে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আর ‘অভিভাবক’ দুটো শব্দ নিয়েই সন্দেহ জাগে। 

রাধাকান্ত দেব জন্মেছিলেন ১৭৮৩ সালে। শোভাবাজারের দেব পরিবারের ইতিহাস যতদূর জানা যায়, রাধাকান্তের আগেও দুই পুরুষ এবং ৩৩টি বছর আছে। ১৭৫০ এ তাঁর পিতামহ নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় কর্মজীবন শুরু করছেন সামান্য একজন ফার্সি-শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু ছাত্রের নাম যে ওয়ারেন হেস্টিংস! অতঃপর তাঁর ভাগ্যের চাকা গড়াল দুর্বার গতিতে। কোম্পানির মুন্সি, কোম্পানির গুপ্তচরবৃত্তি, পলাশীর ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠা এবং সিরাজের কোষাগার লুন্ঠনের এক বিশাল অংশ আত্মসাৎ। এরপরই ১৭৫৭ এর সেই বিখ্যাত দুর্গোৎসব যাতে খরচ হবে লক্ষাধিক টাকা এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেই ন-লক্ষ টাকার মাতৃশ্রাদ্ধ সেরে কলকাতার অবিসংবাদী সমাজপতি হয়ে বসবেন নবকৃষ্ণ। দেব পরিবারের ব্যাটন এরপর গেল তাঁর পালিত পুত্র গোপীমোহনের হাতে। দুই কৃতী পুরুষের মাঝে গোপীমোহন দেব সম্পর্কে ইতিহাস কিছুটা নীরব। যদিও ২১শে মে ১৮১৬ তারিখে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে কমিটি তৈরি হচ্ছে তাতে গোপীমোহন ও রাধাকান্ত দুজনেই আছেন। রাধাকান্ত ও হিন্দু কলেজের চৌত্রিশ বছরের সম্পর্কের সেই সূচনা। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে রাধাকান্ত দেবের কার্যকলাপ বারবারই একটা প্রশ্নের জন্ম দেয়? তিনি সমাজের মাথা, না সমাজ তাঁর মাথায়? 

নবকৃষ্ণ দেবের সেই এলাহি পুজোর মতো কলকাতার পুজোর আরও গল্প জানতে হলে পড়ুন: পুজোর রোয়াক

আঠারো শতকের শেষ দশকে কলকাতায় বড় হয়েছেন রাধাকান্ত। অমিত বিত্তের অধিকারী পরিবারের সন্তান। বিলাসে মত্ত না হয়ে কানিংহাম অ্যাকাডেমিতে শিখেছেন ইংরেজি। হিন্দু কলেজের নিয়মাবলী রচনা করতে গিয়ে প্রথমেই জানাচ্ছেন ‘literature and science of Europe and Asia’ এই বিষয়টি। হিন্দু বাঙালি সমাজপতির আড়ালে থাকা প্রকৃত আধুনিক মননটি সামনে চলে আসে। ঐ নিয়মাবলীতেই পরে বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন পাঠ্যবিষয়গুলির – জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও রসায়ন। আবার একইসঙ্গে বিপুলভাবে সাহায্য করছেন পিতা গোপীমোহন স্থাপিত চতুষ্পাঠীগুলিকে। বিশিষ্ট পণ্ডিতদের দিয়ে রচনা করাচ্ছেন শব্দকল্পদ্রুম অভিধান। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমন্বয়বাদী শিক্ষার কাঠামোটাই গড়ে দিচ্ছেন এভাবে। ঐ একই বছরে তৈরি হল স্কুল বুক সোসাইটি এবং স্কুল সোসাইটি। দুটি ক্ষেত্রেই রাধাকান্ত অন্যতম সদস্য ও সম্পাদক। সে যুগের উচ্চবিত্ত হিন্দুসমাজের ধারণা হয় স্কুল বুক সোসাইটি এবং হিন্দু কলেজের ইংরেজি শিক্ষা খ্রিষ্টানির প্রথমপাঠ। ধর্মের নিগঢ়ে যাতে শিক্ষা বাঁধা না পড়ে তাই রাধাকান্ত নিজের বাড়িতে রাখলেন বইগুলি। হিন্দুয়ানি বজায় রাখার জামিন হলেন নিজেই। 

কিন্তু ইতিহাস আমাদের জানায় যে হিন্দু কলেজের ‘হিন্দু’ অংশটাই রাধাকান্ত দেবকে প্রভাবিত করল বেশি। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তিনি সর্বাগ্রে। কিন্তু যখন পশ্চিমের খোলা দ্বার দিয়ে জোয়ার আসে সমাজ আর ধর্মের বুকে? যে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনকে তিনি free studentship এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাঁকেই বহিষ্কার করলেন। গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সম্মতি দিলেন ডিরোজিওর বিতাড়নে। ব্যক্তি রাধাকান্তের অবশ্য ডিরোজিওর প্রতি বিরূপতা ছিল না। কিন্তু তাঁর শিক্ষার ভয়ে যে একের পর এক হিন্দু পরিবার সন্তানদের সরিয়ে নিচ্ছে হিন্দু কলেজ থেকে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই পেলেন না বাইশ বছরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ! সমাজপতি তখন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল রক্ষক।

প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যখন বৃহত্তর পটভূমিতে? আঠারো শতকের শেষভাগ থেকেই শোভাবাজার রাজবাড়িতে স্ত্রীশিক্ষার চল ছিল। নবকৃষ্ণ দেবের ছয় স্ত্রীই লিখতে পড়তে জানতেন। ১৮২২ সালে রাধাকান্ত দেব মিসেস কুক নামে এক মিশনারীকে নিযুক্ত করছেন দরিদ্র হিন্দু মহিলাদের শিক্ষাদানে। তাঁর যুক্তিও স্পষ্ট, filtration-এর মাধ্যমে শিক্ষা ছড়িয়ে যাবে সমাজের সব মহলে। নিজের বাড়িতে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ও পরীক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছেন। আবার বেথুন সাহেবের বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগের তিনি পরিপন্থী! তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টতই উঠে আসছে গোঁড়া পুরুষতান্ত্রিক স্বর – নারীদের বিদ্যাচর্চা বিবাহপূর্বকালে অন্তঃপুরের শিক্ষাটুকুর জন্যই। 

সতীদাহ প্রসঙ্গে রামমোহনের বিরোধিতা রাধাকান্তের চরিত্রকে সবচেয়ে বেশি কালিমালিপ্ত করেছে। এখানে বলে রাখা ভাল, স্ত্রীশিক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগ রামমোহনের চাইতে রাধাকান্ত দেব আরো বেশি গ্রহণ করেছিলেন। রামমোহনের শিক্ষাবিষয়ক সেরা উদ্যোগের মধ্যে যদি থাকে ১৮২৩-এ লর্ড আমহার্স্টকে সেই বিখ্যাত পত্র বা অ্যাংলো হিন্দু স্কুল, সেখানে রাধাকান্ত প্রকৃত জনশিক্ষার উদ্যোগী, স্কুল সোসাইটির মাধ্যমে। কিন্তু রামমোহনের ভাবনায় নারীমুক্তির মূলে রয়েছে মানবিকতা, তাঁর আধুনিকতা দাঁড়িয়ে আছে মানবতার ভিত্তির উপর। তাই সতীদাহের বিরোধী হতে তাঁর দেরি হয়নি। রাধাকান্তের আধুনিকতা হিন্দুসমাজের কাঠামোয় নির্মিত। সেখানে ধর্মের প্রতীক হল দেশাচার, যেখানে বিধর্মীর হস্তক্ষেপ ক্ষমার অযোগ্য। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ধর্মসভা, যাতে যোগ দিলেন মতিলাল শীল, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রসময় দত্তের মত অপরাপর সমাজপতিগণ। বেন্টিঙ্কের কাছে পত্র পাঠানো হল এই প্রথায় হস্তক্ষেপ না করতে, সেখানে একটি লাইন – “...that no one is to interfere in any shape in the religion of the customs of Hindu subjects.”

নারীস্বাধীনতা ও নারীশিক্ষা সংক্রান্ত যতগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ উনিশ শতকে নেওয়া হয়েছে তার প্রত্যেকটির চরম বিরোধিতা করেছিল ধর্মসভা। 

প্রসঙ্গত একটা তথ্য জানিয়ে রাখা যেতে পারে। শোভাবাজারের দেববাড়িতে কখনো সতীদাহ হয়নি। অথচ সতীদাহ রদ আটকাতে রাধাকান্ত ও ধর্মসভা বিপুল খরচ করে ফ্রান্সিস বেথি নামে এক ব্যারিস্টারকে নিয়োগ করে! আধুনিক মানুষ নন, দায়বদ্ধ সমাজপতি রাধাকান্ত স্বয়ং পুরাণ ও বেদ থেকে সমর্থনসূচক শ্লোক সংগ্রহ করেছিলেন।

উনিশ শতক শুধু সমাজবদলের কাল নয়, এক প্রবল বৈপরীত্যময় সময়পর্ব। স্বক্ষেত্রে মহীরুহ হয়েও কলঙ্ক ধরা আছে বহু যুগন্ধরের চরিত্রে। আঠারো শতকের বাঙালি সমাজের দ্বিতীয় সমাজমুখ্য যদি নবকৃষ্ণ দেব হন, তাহলে প্রথমজন অবশ্যই মহান রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি শুধু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করতে কূটনৈতিক চালে বর্ধমানাধিপতির বিধবাবিবাহের উদ্যোগকে বানচাল করে দেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, বিশেষত নুনের ব্যবসায় দ্বারকানাথ ঠাকুরকে কোনোভাবেই সততার প্রতীক বলা যায় না। সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল কলকাতার সমস্ত অভিজাত পরিবার। রাধাকান্ত এই ধারার অন্যতম বিশিষ্ট সংযোজন। মনে রাখতে হবে নবকৃষ্ণের সমকালে কলকাতার অভিজাত বাঙালি সমাজ ছিল জায়মান অবস্থায় আর রাধাকান্তের সময় তা প্রতিষ্ঠিত শক্ত ভিত্তির উপর। সমাজকে রক্ষা মানে কঠোর অনুশাসনে তাকে বেঁধে রাখা। ধর্মকে সর্বাধিক গুরুত্বে ভূষিত করা। তাই তাঁর পক্ষে স্রোতের বিপরীত বিদ্রোহী স্বরকে অভিবাদন জানানো আদৌ সম্ভব ছিল না, বরং অনেক বেশি জরুরি ছিল সমাজ-সংগঠনকে ধরে রাখা।  বেন্টিঙ্ক থেকে ডালহৌসি সমস্ত বড়লাট তাঁর প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মের সঙ্গে মতানৈক্য ঘটেছিল ঠিকই, কিন্তু রাজভক্তি প্রদর্শনে রাধাকান্ত অকুণ্ঠ। আনুগত্যের পুরস্কারে তিনি শিরপেচ ও K.C.S.I উপাধিপ্রাপ্ত এবং ১৮৩৭-এ পিতা গোপীমোহনের মৃত্যুর পরেই তিনি রাজাবাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত। অতএব রাজা সমাজের শিরোভূষণ হলেও আদতে সমাজরক্ষক। প্রচলিত পথে সমাজের গতিকে অক্ষুণ্ণ রাখাই তাঁর কাজ। আধুনিকতা বা পাশ্চাত্যশিক্ষার প্রসারে তিনি ততটাই উদ্যোগী হতে পারেন যতটা সমাজ অনুমোদন করে। কিন্তু দরকারে শাস্ত্রকে গৌণ করে দেশাচারকে রক্ষা করতেও তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ!

এই নিবন্ধের শুরুতেই যে মন্তব্যটি রয়েছে তা ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, পাহাড়ী সান্যাল অভিনীত ‘বিদ্যাসাগর’ ছবিটি থেকে নেওয়া। এর প্রত্যুত্তর বোধহয় রয়েছে ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “রাজা রামমোহন” ছবিতে। সেখানে সতীদাহ রদের প্রস্তাব নিয়ে রামমোহন এসেছেন সমাজপতি রাধাকান্তের কাছে। রাধাকান্তের ভূমিকায় অভিনয়কারী অসিতবরণের সংলাপ- “যুগ যুগ ধরে যা চলে এসেছে তা কি আমরা এত সহজে ভাঙতে পারি? ওসব কথা এখন থাক দেওয়ানজী”। সে স্বরে রাজাধিরাজ এর দম্ভ নেই। বরং রয়েছে দেশাচারের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ।

দুই শতকের দূরত্ব থেকে ইতিহাসকে অবলোকন করলে মনে হয় দ্বিধান্বিত রাজা বোধহয় ১৮৫৬ এর প্রশ্নের উত্তর ১৮২৯-এর আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। সতীদাহ আর বিধবা বিবাহ আইনে তাঁর আপত্তি ইতিহাস-পাঠকের কাছে তাঁকে খলনায়ক করে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসকে আতসকাচে ফেললে? হয়তো সেক্ষেত্রে রাধাকান্ত দেবকে মনে হবে সমাজ ও সমকালের নির্দেশবহ এক দ্বিধান্বিত কর্মীপুরুষ।


#sillypoint #radhakanta #kolkata #19th century #রাধাকান্ত দেব #উনিশ শতক #নবজাগরণ #কলকাতা #বিদ্যাসাগর #রামমোহন #সিলি পয়েন্ট #সুদেব বসু #ফিচার #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

66

Unique Visitors

220045