ম্যাজিকাল মিল
বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই কেটে যাবে তার এগারো বছরের জন্মদিন – এমনটাই ভেবেছিল মাসি মেসোর অনাদরে বড় হয়ে ওঠা অনাথ ছেলেটা। তার জন্মদিনে কখনও কেক কাটা হয়নি। উপহার পেয়েছে অবহেলাভরে ছুড়ে দেওয়া কোট-হ্যাঙ্গার আর পুরোনো মোজা। কে জানত এই এগারো বছরের জন্মদিনেই মস্ত বড় একটা বার্থডে কেক নিয়ে হাজির হবে এক বিশালবপু দাড়িওয়ালা হাসিখুশি লোক!
লোকটার কালো ওভারকোটের পকেট থেকে বের করা ঈষৎ-দোমড়ানো বাক্সে ছিল একটা চকলেট কেক। ওপরে সবুজ আইসিং-এ লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে হ্যারি’। কেক দেওয়ার একটু পরেই তাকে সসেজ রান্না করেও খাইয়েছিল লোকটা। এ যাবৎ অবহেলিত অনাদৃত ছেলেটার সামনে সেদিন খুলে গিয়েছিল এক নতুন জগতের দরজা, যে দুনিয়া তাকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রাখবে না, যে জীবন তাকে নতুন করে শেখাবে স্নেহ-পরিবার-বন্ধুতা শব্দের মানে। আর সেই পৃথিবীতে প্রবেশের দোরগোড়াতেই জড়িয়ে রইল কেক আর সসেজের স্বাদ-গন্ধ। রসনার পথ ধরে হৃদয়ে পৌঁছনোর কথা তো আমরা আকছার শুনি। পটার সাম্রাজ্যেরও পাঠকমনে জায়গা করে নেওয়ার পেছনে খাওয়াদাওয়ার বিশেষ ভূমিকা আছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেই জাদুদুনিয়ারই রকমারি রন্ধনভোজনের হদিশ থাকবে আজকের নিবন্ধে।
এগারো বছর বয়স পর্যন্ত কখনও একেবারে অভুক্ত থাকতে হয়নি হ্যারিকে। কিন্তু পছন্দের খাবার যত খুশি খাওয়ার সুযোগ মাসি-মেসোর কাছে সে কখনও পায়নি। হ্যাগ্রিডের সঙ্গে ডায়গন অ্যালিতে স্কুলের জন্য বই, জাদুদণ্ড, ইউনিফর্ম ইত্যাদি কিনতে গেলে হ্যাগ্রিড তাকে আইসক্রিম (‘চকলেট অ্যান্ড রাস্পবেরি উইদ চপড নাটস’) আর হ্যামবার্গার কিনে দেয়। বড়দের প্রশ্রয়ে সেই প্রথম তার পছন্দের জিনিস খেতে পাওয়া। তবে এসব খাবারের সঙ্গে মাগল দুনিয়ার খাবারের তেমন কোনও পার্থক্য নেই। প্রথম ম্যাজিকাল খাবারদাবার চেখে দেখার সুযোগ মেলে হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে। ট্রলি থেকে সে ম্যাজিকাল মুদ্রার (সিলভার সিক্ল্, ব্রোঞ্জ নাট) বিনিময়ে কিনে নেয় হরেকরকম অচেনা আর অদ্ভুত খাবার। তার মধ্যে রয়েছে ‘পাম্পকিন পেস্টি’, ‘কলড্রন কেক’, ‘লিকরিশ ওয়ান্ড’, ‘ড্রুবলস বেস্ট ব্লোয়িং গাম’ ইত্যাদি। এসব মুখরোচক খাবারের ভিড়ে সেদিন ট্রেনের কামরার একপাশে পড়ে ছিল রনের আনা টিফিন– মিসেস উইজলির বানানো স্যান্ডুইচ। এর আগে কখনও হ্যারির কাছে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো বাড়তি কিছু ছিল না, তার চেয়েও বড়ো কথা, ছিল না ভাগ করে নেওয়ার মতো কোনও মানুষ। রনের সঙ্গে খাবার শেয়ারের সেই মধুর মুহূর্তটুকু না থাকলে কি হ্যারি খুঁজে পেত তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে?
সেদিন রন আর হ্যারি একসঙ্গে যা যা খেয়েছিল তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘চকলেট ফ্রগ’ আর ‘বার্টি বটস এভরি ফ্লেভর বিন’। চকলেট ফ্রগ কেবল ব্যাঙের আকৃতির চকলেট নয়, সিনেমার পর্দায় তাদের নড়াচড়া করতে, এমনকি হাত ফসকে পালাতেও দেখা যায়। শুধু তাই নয়, চকলেট ফ্রগের সঙ্গে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া বিভিন্ন বিখ্যাত জাদুকরদের ছবিওয়ালা কার্ড পাওয়া যায়। ছবির সঙ্গে থাকে সেই উইচ বা উইজার্ডের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। জাদুদুনিয়াতেই বড় হয়ে ওঠা রনের ছোটবেলা থেকেই কার্ড সংগ্রহের নেশা ছিল। হ্যারি অবশ্য কার্ডের ছবিদের নড়তে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। এই চকলেট ফ্রগ কার্ডে পাওয়া অ্যালকেমিস্ট নিকোলাস ফ্ল্যামেল সংক্রান্ত তথ্যই পরে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, বার্টি বটস এভরি ফ্লেভর বিনের বিশেষত্ব হল– এর প্রত্যেকটা বিন আলাদা আলাদা স্বাদের। এবং যে খাচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই যে-কোনো স্বাদ তার ভাগ্যে জুটে যেতে পারে। এ বিন নিজ দায়িত্বে মুখে পুরতে হয়, কারণ আগে থেকে ফ্লেভর বোঝার কোনও উপায় নেই। চকলেট, স্ট্রবেরি, পিপারমেন্টের মতো ফ্লেভরের পাশাপাশি ভাগ্য নিতান্ত মন্দ থাকলে পালং শাক, মরিচ, মায় কানের খোলের স্বাদ পর্যন্ত জুটতে পারে।
হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসের ট্রলির খাবারদাবারেই হ্যারির অবাক হওয়ার পালা শেষ হয়নি। স্কুলে পৌঁছে সর্টিং সেরিমনির শেষে ‘স্টার্ট অফ টার্ম ফিস্ট’ তাকে আরও একবার হতচকিত করে দিয়েছিল। ফিস্ট শুরু হতেই টেবিলে সাজানো স্বর্ণাভ থালায় আপনা থেকেই দেখা দেয় বিবিধ পদ। কী কী থাকে সেই ফিস্ট-এর মেনুতে? এ প্রশ্নের চেয়ে বরং জিজ্ঞেস করা ভালো, কী থাকে না! রোস্ট বিফ, রোস্ট চিকেন, পর্ক চপ, ল্যাম্ব চপ, সসেজ, বেকন, স্যান্ডউইচ, বয়েলড পোট্যাটো, রোস্ট পোট্যাটো, মিন্ট হ্যামবার্গার, বিভিন্ন রকম গ্রেভি, রাইস, স্ট্রবেরি, অ্যাপল পাই, চকলেট এক্লেয়ার্স সহ নানা ধরনের পুডিং, আইসক্রিম… মোট কথা বিলিতি পদের রকমফেরের একটা প্রদর্শনী আমরা দেখতে পাই হ্যারি-রন-হারমাইওনিদের খাবার টেবিলে।
স্টার্ট অফ টার্ম ফিস্টের মতোই আরও কিছু বিশেষ দিনে ভোজের রাজকীয় আয়োজন হয় হগওয়ার্টসে। টার্মের শুরুর মতোই টার্মের শেষ দিনে কিংবা হ্যালোউইনের দিনেও বরাদ্দ থাকে বিশেষ ভোজ। বড়দিনের ছুটিতে ইচ্ছে করলে ছাত্ররা বাড়ি না ফিরে থেকে যেতে পারে স্কুলে। আর স্বল্পসংখ্যক যে ছাত্ররা থাকে তাদের উৎসবের আমেজ দিতে শিক্ষকেরা ক্রিসমাস পালনের আয়োজনে কোনও ত্রুটিই রাখেন না। সেই আয়োজনের অপরিহার্য অঙ্গ ক্রিসমাস ডিনার। খাবার টেবিল ঢেকে যায় রুপোর বাটিভর্তি গ্রেভি, ক্র্যানবেরি সস, রোস্ট, টার্কি, বয়েলড পোট্যাটো, চিপোলাটা, বাটারড পি প্রভৃতির স্তূপে। এই সমস্ত ফিস্ট কিংবা নিত্যদিনের ডিনার-লাঞ্চ সবকিছুর বাঁধাধরা জায়গা ‘গ্রেট হল’। গ্রিফিনডোর, র্যাভেনক্ল, হাফলপাফ, স্লিদারিন– চারটি হাউসের ছাত্ররা বসে চারটি আলাদা টেবিলে। শিক্ষকদের জন্য ঘরের সামনের দিকে থাকে আলাদা স্টাফ টেবিল। সমস্ত স্কুলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবর থাকলে ফিস্টের শুরুতেই তা বলে নিতেন হেডমাস্টার ডাম্বলডোর। তবে পেটে খিদে নিয়ে ছাত্ররা মাস্টারের দীর্ঘ ভাষণ শুনবে, তা তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না বলে বক্তব্যকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতেন তিনি। গোটা স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকের একসঙ্গে একই ঘরে খেতে বসার এই রীতি যে ঐক্যবোধ আর পরিবারসুলভ মনোভাব গড়ে তোলার জন্যই, সে কথা বলা বাহুল্য।
হগওয়ার্টসের প্রসঙ্গেই বলে নেওয়া যায় ‘হগস্মেড’-এর কথা। এটি হগওয়ার্টসের নিকটবর্তী একটি উইজার্ডিং ভিলেজ। থার্ড ইয়ার থেকে ছাত্রদের বিশেষ বিশেষ দিনে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি মেলে। আর সেখানেই রয়েছে ‘হনিডিউক্স’– হগওয়ার্টসের ছাত্রদের প্রিয় ‘সুইট শপ’। জাদুরাজ্যের রকমারি লজেন্স, চকলেটের পসরার আকর্ষণ ছোট বড় সবার কাছেই অপ্রতিরোধ্য। থার্ড ইয়ারে হগস্মেডে যাওয়ার অনুমতিপত্রে আঙ্কল ভার্ননের সই জোগাড় করে উঠতে পারেনি বলে সেখানে যাওয়ার অফিশিয়াল অনুমতি মেলেনি হ্যারির। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সমবেদনাসম্পন্ন হারমাইওনি এই দোকান থেকেই প্রচুর মিষ্টি এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিয়েছিল।
আবার এই হগসমেডেই আছে হগওয়ার্টসের ছাত্রদের অতিপরিচিত পাব– ‘থ্রি ব্রুমসস্টিকস’। যেসব দিনে ছাত্রদের হগসমেডে যাওয়ার সুযোগ মেলে, সেসব দিনে অনেক ছেলেমেয়েরই গন্তব্য হয়ে ওঠে এই পাব। আড্ডা-গল্পগুজব থেকে জরুরি আলোচনা, মিটিং থেকে ডেটিং– সবকিছুর জন্যই কমন মিটিং-স্পট ‘থ্রি ব্রুমসস্টিকস’। সুস্বাদু পানীয় ছাড়াও এখানকার বাড়তি আকর্ষণ সুন্দরী বারমেড ম্যাডাম রসমার্টা। ব্রিটেনের জাদুরাজ্যের আর-একটি বিখ্যাত পাব জাদুরাজ্যের বাজার ডায়গন অ্যালির মুখে অবস্থিত ‘লিকি কলড্রন’। ছোটখাট এই পাবের বাইরের জৌলুশ তেমন না থাকলেও এর ইউ.এস.পি এর অবস্থানগত গুরুত্ব এবং বহু মানুষের আনাগোনা। দরকারে মিনিস্টার অফ ম্যাজিক পর্যন্ত এখানে পদধূলি দিতে দ্বিধা করতেন না।
পাব-এর প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, তখন এই সূত্র ধরে জাদুদুনিয়ার পানীয়ের কথাও বলে ফেলা যাক। না, জাদুপানীয় বা পোশনের কথা হচ্ছে না। পোশন তৈরি করা বা পান করার পেছনে সবসময়ই কোনও না কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। উইচ বা উইজার্ডরা নিছক রসনাতৃপ্তির জন্যই যা-কিছু পান করে থাকে, তাদের কথাই আমাদের আজকের আলোচ্য। অ্যালকোহলহীন পানীয়ের মধ্যে জাদুরাজ্যে খুব বেশি প্রচলিত চা এবং পাম্পকিন জুস। বিয়ারজাতীয় পানীয়ের মধ্যে হগওয়ার্টসে জনপ্রিয় ‘বাটারবিয়ার’। এ জিনিস ভারী সুস্বাদু তো বটেই, উপরন্তু অ্যালকোহলের পরিমাণও সম্ভবত খুব বেশি নয়। কারণ পালাপার্বণে বা কুইডিচ ম্যাচে জেতার উদ্যাপনে যথেচ্ছ বাটারবিয়ার পানের পরেও কাউকে মাতাল হতে দেখা যায় না। অবশ্য মানুষের পক্ষে ‘স্ট্রং’ না হলেও এই ড্রিংক হাউজএলফদের জন্য যথেষ্ট ‘স্ট্রং’, সে কথা উপন্যাসের মধ্যেই জানানো হয়েছে। প্রভূত পরিমাণে বাটারবিয়ার খাওয়ার পর শোকগ্রস্ত হাউজএলফ উইংকিকে তাই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখা যায়। রনের দাদা বিলের বিয়ের অনুষ্ঠানে শ্যাম্পেন ইত্যাদির উল্লেখ দেখে অনুমান করে নেওয়া যায় মাগল-সমাজে প্রচলিত সবরকম পানীয়ই মোটামুটি জাদুসমাজেও প্রচলিত। তবে আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার ‘ফায়ারহুইস্কি’র কথা। এটি ম্যাজিকরাজ্যের, যাকে বলে, ‘অ্যাডাল্ট ড্রিংক’। হ্যারিদের সিক্সথ ইয়ারে রনের ফায়ারহুইস্কির প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কে হারমাইওনির তির্যক মন্তব্য শোনা যায়। হ্যারি রন হারমাইওনি কাউকেই সতেরোর গণ্ডি (জাদুদুনিয়ায় ওটাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বছর) পেরোনোর আগে ফায়ারহুইস্কিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে দেখা যায় না। সম্ভবত প্রাক্তন ‘Auror’ ম্যাড-আই-মুডির মৃত্যুর দিনেই প্রথম ফায়ারহুইস্কির স্বাদ পেয়েছিল তারা। তবে তা ছিল মৃত ব্যক্তির স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সামাজিক আচারমাত্র। হরক্রাক্স সন্ধানের অনিশ্চিত অভিযানে বেরোনোর ঠিক আগের জন্মদিনে জিনিকে চুম্বনের মুহূর্তে হ্যারির মনে পড়েছিল ফায়ারহুইস্কির সেই তীব্র জ্বালাময়ী স্বাদের কথা, যা ভয়-বিপদ, আশঙ্কা-অনিশ্চয়তা, বিপন্নতা ও বিষণ্ণতার যাবতীয় বোধকে মায়াবী মোহে আচ্ছন্ন করে দেয় সাময়িকভাবে।
পটার রাজ্যে খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ যাঁর উল্লেখ ছাড়া অসম্পূর্ণ, তিনি হলেন মলি উইজলি, রনের মা। রান্নায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর হাতের ম্যাজিকেই উইজলি পরিবারে লোভনীয় হয়ে উঠত ক্রিসমাস বা অন্যান্য ছুটির দিনের সমস্ত মিল। খাওয়ানোর ব্যাপারে তিনি টিপিকাল বাঙালি মায়েদের মতোই। অনাথ হ্যারির প্রতি তাঁর স্নেহের পরিমাণ একটু বেশিই। তাই গরমের ছুটি বা ক্রিসমাসের ছুটিতে হ্যারি এলে নানাবিধ পদের প্রাচুর্যে তিনি একাই হ্যারির মাসি-মেসোর অনাদরের যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ করতে উঠে পড়ে লেগে যান। হ্যারিকে তার স্বাভাবিক খাওয়ার পরিমাণের অন্তত চারগুণ খাবার খাওয়াতে না পারলে শান্তি পান না। রান্নার ব্যাপারে মিসেস উইজলির ঠিক উল্টো হ্যাগ্রিড। তার কটেজে নেমন্তন্ন থাকলে স্বভাবতই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত হ্যারিরা। কারণ তার বানানো ‘রক কেক’ খেয়ে দু-একটা দাঁত ভেঙে যাওয়াও বিচিত্র ছিল না।
ভূতের রাজার বরে গুপী-বাঘা খাবারের নাম বলে হাতে হাতে তালি দিলেই এসে হাজির হত মণ্ডা মিঠাই জিবেগজা পুলিপিঠে কিংবা কোর্মা-কালিয়া-পোলাওয়ের রকমারি পদ। পটারপৃথিবীর বাসিন্দাদের কাছে কিন্তু খাদ্যসমস্যার সমাধান এত সহজ নয়। “Food is the first of the five Principal Exeptions to Gamp’s Law of Elemental Transfiguration.” – জাদুদুনিয়ার খাদ্যসম্ভার নিয়ে কথা বলতে বসে এ সূত্র এড়িয়ে গেলে গ্র্যাঞ্জার দেবীর অভিশাপ লাগতে পারে। হারমাইওনির জ্ঞানভাণ্ডারকে স্মরণ করেই বলি, পটাররাজ্যে কিন্তু ম্যাজিকালি খাবার উদ্ভূত করার কোনও পন্থা নেই। অনেক দূরে কোথাও খাবার থাকলে ম্যাজিকের সাহায্যে তাকে কাছে আনা যায়, অল্প খাদ্যবস্তুকে পরিমাণে বাড়ানো যায়, কিন্তু শূন্য থেকে খাবারের ‘আবির্ভাব’ ঘটানো যায় না। অতএব উপকরণ সংগ্রহ করে রান্না করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ম্যাজিকের সাহায্যে করা হলেও সেটা যে বেশ পরিশ্রমের কাজ তা বোঝা যায় হরক্রাক্স অভিযানের সময়ে, যখন অতি সীমিত উপকরণকে দিনের পর দিন খাদ্যযোগ্য করার চেষ্টায় রীতিমতো ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে হারমাইওনি। মেয়ে হওয়ার কারণেই রান্নার ভার প্রতিদিন তার ওপর এসে পড়ছে, দুই পুরুষ-বন্ধুর বিরুদ্ধে এই ক্ষোভও শোনা যায় তার কণ্ঠে।
অতএব এই ম্যাজিক-জগতেও খাবার-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার সবটাই সুখকর নয়। প্রদীপের নিচেই যেমন থাকে অন্ধকার, তেমনি হগওয়ার্টসেও গ্রেট হলের টেবিলে উপাদেয় খাবারদাবারের প্রাচুর্যের পেছনে আছে হাউজএলফদের পারিশ্রমিকহীন পুরস্কারহীন হাড়ভাঙা খাটুনির আখ্যান। কাজের বিনিময়ে কোনো কিছুই পায় না তারা, চায়ও না। নিজেকে প্রায় অদৃশ্য রেখে প্রভুর জন্য অক্লান্তভাবে ঐকান্তিক নিষ্ঠায় কাজ করাই তাদের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য। হগওয়ার্টসের হাউজএলফরা স্কুলের সকলের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক খাবারের জোগান দেয় তো বটেই, রান্নাঘরের গোপন হদিশ জেনে সেখানে কোনও ছাত্র পৌঁছে গেলে আলাদা করেও তারা খাবারের ব্যবস্থা করে মহা উৎসাহে। ফ্রেড জর্জ এই কৌশলেই গ্রিফিনডোরের সমস্ত পার্টির সময়ে বাটারবিয়ারের বন্যা বইয়ে দিত।
ছাত্রদের মধ্যে হারমাইওনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিল তাদের প্রতিদিনের খাবারের কণায় মিশে আছে ‘স্লেভ লেবর’। সেদিন গ্রেট হলের খাবার আর মুখে রোচেনি তার। আসলে, আমাদের প্রতিদিনের মুখের গ্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস এতটাই বাস্তব যে, কোনো জাদুকাঠির স্পর্শেই তা বোধহয় মোছা যায় না।