কাবিলের লকডাউন জীবন
শরীরের সমস্ত শক্তি যেন বেরিয়ে গেছে।একটা পা ফেলতে গেলেও যেন উল্টে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। রোজা রেখে এমন কাহিল দশা যখন হয় তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে কাবিল। তবুও উপরওয়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা রাখতেই হয়। জাগতিক যাবতীয় কষ্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করে পরকালের কথা চিন্তা করে সে। পরকালের কথা ভাবলে শরীরে একধরনের অদৃশ্য শক্তি সঞ্চারিত হয়।সেই শক্তির জোরে সে দিনের বাকিটা সময় এগিয়ে নিয়ে যায় শরীরটাকে। আজ সারাদিন বিক্রিবাটা ভালোই হয়েছে।
সকালবেলায় বেরিয়ে যায় কাজ করতে। আজ নেতাজী মোড়ের কাছে একদল পুলিশ টহল দিচ্ছে। সে তার সাইকেল ভ্যানটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ছাউনির মত একটা জায়গা থেকে দুটো পুলিশ বেরিয়ে এলো। কদিন থেকে টিভিতে খবরের কাগজে আর লোকের মুখে মুখে সে শুনে আসছে করোনা নাকি আবার আসছে। করোনা নাকি আগের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে।
একটা কথা সে বুঝে উঠতে পারেনা, একটা ভাইরাস কী করে গোটা পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে! কী করে একটা ভাইরাসের শক্তি দিনদিনই বাড়ছে। গত একবছরে তো তাদের শক্তি অনেক কমে গেছে। অবশ্য সে কিছুই জানতে পারতো না এই ব্যাপারে। তার ছোট নাতনির কাছে ছোট একটা মোবাইল রয়েছে। সেই মোবাইলে আবার খবরের চ্যানেলও নাকি আছে। সেখান থেকেই খবর পাচার হয় তার কাছে।
'দাদো! তোমার কাছে মাক্স আছে তো? নাহিলে কিন্তু পাঁচশ টাকা করা জরিমানা করবে?' নাতনি বলে। পাঁচশ টাকা জরিমানা করবে? কে করবে জরিমানা? যে দেশে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটার পরেও পাঁচশ টাকা রোজগার করার সুযোগ নেই সেখানে পাঁচশ টাকা জরিমানা! খুব হাস্যকর লাগে এই কথা।
কাবিল বলে,'দেখ বুবু আমারহে তো অত পয়সা নাই। যুদি জরিপানা দিতে না পারি তাহিলে কি কুনু শাস্তি আছে দেখ তো?'
সত্যি তো। জরিমানার পরিবর্তে অন্য কোনো শাস্তির কথা তো উল্লেখ করা নেই।
গত একবছরে সংসারে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সংসার একেবারে রাস্তায় এসে দাঁড়ালে যেমন হয়, সেইরকমই বলা যায়। সে আগের বছর কলকাতার একটা জুটমিলে কাজ করত। নৈহাটি তে। হুকুমচাঁদ জুটমিল। মুর্শিদাবাদের অনেক লেবার সেখানে কাজ করে।
একসাথে থাকা-খাওয়া, রান্নাবান্নার সমস্ত ব্যবস্থা ওখানে ছিল। সংসার খরচ বাদেও মাসে মাসে কিছু সঞ্চয় করতে পারত। সেই সঞ্চয়ের টাকা লকডাউনের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় শেষ হয়ে গেছিল। আর জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, বাজারে হাত দেওয়াই মুস্কিল।
ওপাড়ার রশিদ এসে বলল, 'জানো কাবিল চাচা, মুনে হয় আমারে কাজ বন্ধ হয়ে গেল।আমাকে মুনে হয় এবার না খায়্যা মরতে হবে গো।' এই বলে সে সিমেন্টের মেঝেতে বসে পড়ল। বাকিদের তার চোখের ভাষা বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। করিম চাচা এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক। উনি রান্নার কাজ কারবার দেখাশোনা করেন। সবাই ভাবল রশিদের বাড়িতে মনে হয় কোনো অশান্তি হয়েছে । এমনিতেই বাপের উপর রাগ করে সে কাজ করতে এসেছিল। পড়াশোনায় খারাপ ছিল না। কিন্তু সংসারের ভার টানতে টানতে খোঁজ করে সে এই জুটমিলে কাজ জুটিয়ে নেয়।কাবিল সেখ বলেছিল, 'পড়াশোনাডা করছিস কর। নাহিলে কিন্তু জীবনে এরকম চাষার বেটা চাষা হয়াই ঘুরে বেড়াতে হবে।'
'না চাচা তুমি আমাকে লিয়া চলো।জেদ ধরে বসে ছিল রশিদ।'
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল।এসময় দুটো টিউশনের জন্য খোঁজখবর লাগিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করা ছেলের কাছে কারা আর ছেলেপিলেকে টিউশন নিতে পাঠাবে? অগত্যা সে জুট মিলের কাজে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
'এ খুব চাষার কাজ। সারাদিনে অবস্থা কাহিল হয়্যা যাবে। আগেই বুল্যা দিছি কিন্তু। পরে বুলিশ না যে কাবিল এ
চাচা সাবধান করা দেয়নি।'
'আমি ঠিক শিখ্যা লিব চাচা। তোমরা তো আছোই।'
রশিদের মায়ের ইচ্ছা ছিল না।তবু ছেলের জেদ আর সংসারের হালে পানি ফেরানোর জন্য এই পথ তাকে মেনে নিতেই হল।
হঠাৎ করে রশিদের আব্বা সাইদুল ইসলামের একটা হাত আর এক পায়ে প্যারালাইসিস হয়ে গেল। শহরের হাসপাতালে তিনদিন ভর্তি ছিল। ডাক্তার বলল আগে থেকেই প্রেসার ছিল, কিন্তু কোনোদিন ডাক্তার দেখানো হয়নি বলে সেটা নাকি জানা যায় নি।
সাইদুল ইসলাম বলেছিলেন, 'কিন্তু আমার শরীলে তো কুনু অসুবিধা হয় নি বাপ।'
ডাক্তারবাবু নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, 'শরীরে অসুখ না থাকলেও বয়স হলে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হয়।'
সাইদুল ইসলামের মাথায় কোনোভাবেই ঢোকেনি শরীরে অসুখ না থাকলেও কী জন্য ডাক্তার দেখাতে হয়।এই শালা ডাক্তার আর ওষুধওয়ালাদের সব ধান্দাবাজি। কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধের টাকা দাও, গুচ্ছের ফি দাও আর গরিব থেকে আরও গরিব হও। বিশেষ কিছু অসুবিধা তখনও হয়নি। শুধু হাত আর পায়ে সামান্য দূর্বলতা ছিল। তিনদিন পরেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। রশিদ বলেছিল, 'একটা ফিজিওথেরাপিস্ট রাখব। রোজ ব্যায়াম করিয়ে দিয়ে যাবে তোমাকে।'
'তোকে আর বেশি মুড়োলি করতে হবে না। লাঙল বাহা শরীলে আবার কে ব্যায়াম করাতে আসবে।'এইসব ছেলেপিলে মানুষ হবে কি করে তাই ভাবে সাইদুল ইসলাম।
তারপর ফিজিওথেরাপিস্ট ডেকে কোনওদিন কিছু করানো হয় নি। ধীরে দুর্বলতা আসে শরীরে। আস্তে আস্তে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে ডাক্তার দেখিয়েও আর বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। তারাও জবাব দিয়ে দিয়েছে।
এমন অবস্থায় তাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। ভাইয়েরা সব আলাদা আলাদা সংসার করে। নিজেরা নিজের সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খায়। বাপের জন্য কিছু টাকা দিতে তাদের কম টালবাহানা নেই।
কোনোরকমে মাসে পাঁচশ টা করে টাকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ। একজন এক মাস করে দেয়। তিন ছেলে তিনমাস। তারপর আবার একই জনের পালি।
সেই রশিদকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে দেখে কাবিল বলে, 'কী হয়েছে ? অমন মেয়্যা ছেল্যার মতন করছিস কীসের লাগ্যা? আগে ভাঙ্যা বোল আমহারে সামনে। নাহিলে কি করা বুঝবো। নাটক করিস ন্যা রশিদ্যা। মাগ্যের মত করিস ন্যা। এমনিতে দ্যাশে মেলা কাজ ছিল। ঢং করতে পড়াশোনা ছেড়্যা এই কাজে আসেছিস গাধার মতন খাটতে। এবার নাটক মারলে কেলানি খাবি।'
'আহ, এরকম ভাবে বুলছো কিসের লাগ্যা? হতে তো পারে কুনু দুঃসংবাদ।এই অকে একটুখানি পানি দে তো টনিক।' টনিক এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।বাপ মা নেই।পরের বাড়িতে মানুষ।তাই পড়াশোনার প-ও জানে না সে। রান্নার কাজে জোগাড়ের কাজ করে।
'পানি ফানি কিছু লাগবে না চাচা।আমারে সবারির লাগিই একটা দুঃসংবাদ আছে।তোমরা কেহু আজ বাজারের দিকে যাওনি তাই জানত্যে পারোনি।
আজ ভারতে রাত বারোটা থাক্যা সব বন্ধ হয়্যা যাবে।'
'এমন কথা তো বাপের জন্মে কুনুদিন শুনি নি ভাইপো।'
'কী একটা ভাইরাস নাকি আস্যাছে। সেড্যা এখুন যুদি রোগ ছড়ায় তাহিলে বাছার আশা কম।'
'কি বুলছিস,এমন কুনু ভাইরাস আছে তা তো আগে শুনিনি।'
'সব শালা এই মোদ্যার কাজ।'
'মোদির কুনু কাজ নাই চাচা। আনজাদে বুল্যা দিলেই তো হবে না। এই ভাইরাস টা নাকি চিন থাক্যা আস্যাছে। চিনের লোকেরা পিথিবীর সব দেশকে কাবু করার লাগ্যা এই ভাইরাস ডা ছেড়্যাছে।
দেখোনি সব জিনিস এখন চিনের।মুবাইল থাক্যা ঘড়ি থাক্যা সব যন্ত্রপাতি অদের দ্যাশের।'
'তাও তো ঠিক বুল্যাছিস ভাইপো। এর লাগ্যা বোলে পড়াশোনা করা ছেল্যা আর আমহারে মত মুরুক্ষু ছেল্যা পার্থক্য হবে না!'
কিছুক্ষণ বাদেই মিলের যারা দেখাশোনা করে তারা এসে খবর দিয়ে গেল।আর এখানে কাজ হবে না।সবাইকে বাড়ি চলে যেতে হবে।কবে যে আবার কাজটাজ চালু হবে, লকডাউন উঠবে তার কোনরকম নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু ট্রেন তো বন্ধ। কীসে করে যাবে প্রায় পঁচিশ তিরিশটা লোক? কেউ ভগবানগোলা, কেউ বেলডাঙ্গা, কেউ ইসলামপুর, কেউ ডোমকল থেকে কাজে এসেছিল। তাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা গাড়ি পাওয়া খুব মুশকিল। কোম্পানির অ্যামবুলেন্স আছে। কিন্তু লোকজন যাতায়াতের জন্য কোনো গাড়ি নেই । অনেক খোঁজাখুঁজির পর গাড়ি পাওয়া গেল দুটো। ম্যাটাডর গাড়ি। মার্চ মাসের গা জ্বলানো গরম আর চ্যাটচেটে রোদে বেরিয়ে পড়তে হলো পরের দিন। নানান জায়গায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে কতরকমভাবে যে হেনস্থা হতে হল তার ইয়ত্তা নেই। এদিকে কোনও দোকানপাট খোলা নেই। কোথাও দাঁড়িয়ে যে দুপুরে একটু ভাত খাবে সেই সুযোগও নেই। হঠাৎ করে যেন সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা। শ্মশান কিংবা কবরস্থানে গেলে এইরকম ফাঁকা ফাঁকা ভাব দেখতে পাওয়া যায়।
মাঝেমাঝে পুলিশের গাড়ি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তারা দাঁড় করিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে তারপর ছেড়েও দিচ্ছে। মোদ্দাকথা ফিরে আসতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তারপর তিনচারটে মাস কেটে গেছে সম্পূর্ণ বেকার ভাবে। কাবিল আর কী করবে। অনেক ভেবেচিন্তে একটা পুরনো সাইকেলে ঝুড়ি বেঁধে তরিতরকারির কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করে।
কিন্তু মানুষের হাতে পয়সা নেই। আয়ের জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘোরে কিন্তু কোনো লাভ হয়না। আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে তার সারা শরীরে ক্ষত তৈরি হয়।সেই ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীর থেকে মুখ, চোখ এমনকি পেটে বুকেও। এই ক্ষত সবাই দেখতে পায়না।
ভোট এসে পড়ল। দিব্যি মিটিং মিছিল হচ্ছে। আর তাদের মত নিরীহ লোকেরা মাস্ক না পরলেই নাকি করোনা ছড়িয়ে যাবে। এরপর আবার নাকি লকডাউন হবে। অজানা আতঙ্কে শিউরে ওঠে কাবিল। সেই লকডাউনের পর আর মিলের কাজে বেশি লোক নিয়ে যায়নি দফাদার। তার ডাক পড়েনি। ফলে সে বাড়িতে বসেই নানা কাজের চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছেন না। নেতারা নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি।
তাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে, তখন কেউ একবেলা দেখতেও আসেনি। এখন সবাই হাত-পা ধরে, ডেকে ডেকে বলছে আমাদের ভোট দাও, তোমাকে কাজ দেব। এইধরনের ফাঁকা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কে সে মন থেকে ঘেন্না করে।
তবু সে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়। তার পায়ের তলায় ভারতবর্ষে। কাকে ভোট দেবে এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি। সকালের দিকে একবার কাজে বেরিয়েছিল। যখন ফিরলো তখন দেখল কম করেও পাঁচশো মানুষের লাইন। অভ্যাসবশত সেও লাইনে দাঁড়ায়।লাইনে দাঁড়িয়ে সে দেখে কালু,ভোলা, মিলুরা হাতে চায়ের কেটলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভিড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে লোককে জিজ্ঞেস করছে, 'চা খাবে চাচা?' এই গ্রামে তো একশো ভাগ ঘরই মুসলিম। তাহলে কেন এরা এমন হারাম কাজ প্রকাশ্যে করছে। তারপর সে নিজের মনে মনেই বলে, মানুষ কে না খাইয়ে মেরে ফেলার চাইতে এটা বরং ভালো কাজ। কিন্তু এই লাল চায়ের মধ্যে সে দেখতে পায় রফিক, আমজাদ, নাসের, জয়নুল, মেসের সাবের আলির মত খেটে খাওয়া
লোকজনের রক্ত। টকটকে লাল রঙের রক্ত। ঠিক মানুষের গায়ের রক্ত। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে থাকে।সে আবার ভিরমি খাবে নাকি। মাথার ভিতর টলমল বাড়তে থাকে। সে ভেবে পায়না কাকে ভোট দেবে।কাকে ভোট দিলে সে খেতে পাবে, কাজ পাবে, তার দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারবে আবার। উত্তর পায়না। শুধু মাথার মধ্যে ভনভন করতে থাকে কিছু বিষাক্ত মাছি। গু ঘেঁটে ঘিনঘিনে হয়ে আছে ওদের শরীর। আর ওর মাথার মধ্যে ভনভন করে আওয়াজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব গুলিয়ে দিচ্ছে।সে কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।সব গুলিয়ে যাচ্ছে... সব গুলিয়ে যাচ্ছে...
...........................
[অলংকরণ : স্বর্ণাক্ষী ধর]
#বাংলা #গল্প #আবু তাহের #লকডাউন #কোভিড #২০২০