লকডাউন স্পেশাল : দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি ছোট ছবি
কেউ কেউ পরিস্থিতিকে মাথায় চেপে বসতে দেননা। উল্টে পরিস্থিতিরই মাথায় চেপে বসেন যথাসম্ভব। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় যেমন। লকডাউনের বাজারে স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ। এই অবস্থায় অভিনেতাদের দিয়ে বাড়িতেই মোবাইল ক্যামেরায় শ্যুট করিয়ে নিজে এডিট করে বানিয়ে ফেলেছেন বেশ কয়েকটি শর্ট ফিল্ম।
থিয়েটারের নিষ্ঠ দর্শকেরা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে জানেন। তিনি মেধাদীপ্ত। তির্যক। স্যাটায়ারপ্রেমী। নাট্যনির্মাতা হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেকে ইতিহাসের অংশীদার করে ফেলা দেবেশ ২০১৮ সালে বানিয়েছেন তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘নাটকের মতো’। ফিল্মে তাঁর আগ্রহের কথা নানা সাক্ষাৎকারেই দেবেশ জানিয়েছেন। এর আগেও তিনি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে মোবাইলে শ্যুট করা শর্ট ফিল্ম আপলোড করেছেন। সেগুলি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। ‘শিল্পী’ আর ‘ট্রেটর’ তো মুগ্ধ করার মতো কাজ। ফলে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল থেকে তিনি এই শর্ট ফিল্মগুলির ঘোষণা করায় একটা আগ্রহের পরিসর তৈরি হয়েছিল। তবে যা দেখলাম, এগুলিকে ফিল্ম বলা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বোধহয়। বরং এদের বলা যায় এক- একটা কমেন্ট। লকডাউনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র কীভাবে আচরণ করতে পারে, সেই বিষয়ে এক একটা মন্তব্য। আলোচনার জন্য এখানে তিনটি ছবি বেছে নিচ্ছি। গলদা চিংড়ি, কবি আর লকডাউনে ফ্যাতাড়ু।
‘গলদা চিংড়ি’-র দৈর্ঘ্য দু’ মিনিট পঁচিশ সেকেন্ড। ছবিটি একটিমাত্র তির্যকতায় দাঁড়িয়ে আছে। দু’ মুখো এক বুদ্ধিজীবীর বাজার করতে যাবার আগের কয়েক মুহূর্ত। অভিনয়ে অম্বরীশ ভট্টাচার্য। এই লকডাউনের বাজারেও গলদা চিংড়ি না কিনলে তার চলবে না। কবজি ডুবিয়ে না খেলে চলবে না। বাজারে যাবার ব্রাহ্মমুহূর্তে নিউজ চ্যানেল থেকে ফোন করে কর্মহীন ও আর্থিকভাবে বিপন্ন মানুষদের বিষয়ে বাইট চাইলে বুদ্ধিজীবী নিমেষে গলা বদলে ফেলেন, কিছুটা কুম্ভীরাশ্রু ঝরান এবং ফোন রেখেই অনায়াস মসৃণতায় আবার ফিরে আসেন গলদা চিংড়িতে। এই মসৃণতা বড় সুন্দর ফুটিয়েছেন অম্বরীশ। ‘রাজা- গজা’র মতো তৃতীয় শ্রেণির স্ল্যাপস্টিক ধারাবাহিক দিয়ে কেরিয়ার শুরু করেও অভিনয়ের জোরে তিনি ক্রমশ ইন্ডাস্ট্রিতে জমি করে নিচ্ছেন। অম্বরীশের যোগ্যতার দাম দিতে পারলে ইন্ডাস্ট্রিরই মঙ্গল।
নজরে থাকুক
রিভিউ : দ্য এলিয়েনিস্ট (নেটফ্লিক্স : ২০১৮)
‘কবি’ ছবিটি এক অল্পবয়েসী প্রেমিক আর প্রেমিকার কথোপকথন। দৈর্ঘ্য দেড় মিনিট। তারাপদ রায়ের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত। লকডাউনের সঙ্গে এই ছবিটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। কথোপকথনটি লকডাউন পিরিয়ডের, এটুকুই। বি.এ. ফেল, কাঠবেকার প্রেমিক জানে তার একটিমাত্র গুণ - সে কবিতা লেখে। ওইটাই তার অন্ধের যষ্টি। প্রেমিকার বাড়িতে ওইটাই হবে তার সেলিং পয়েন্ট। কিন্তু প্রেমিকা জানায় প্রেমিক সম্পর্কে সে বাড়িতে কিছু কিছু তথ্য জানিয়েছে, তবে প্রেমিক যে কবিতা লেখে সেটা জানানোর এখনও সাহস হয়ে ওঠেনি তার। কবিতা লেখা ফেল করার চেয়েও খারাপ। কবিতা লেখা ইজ ইকুয়ালটু অপদার্থতা। পুরো ছবিটিতে ভালো লাগার বিষয় অভ্র মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। তাঁর বিপরীতের মহিলা একটু ভালো অভিনয় করলে ছবিটি সম্ভবত আরেকটু দাঁড়াত।
একেবারেই স্মরণীয় কিছু না হলেও এই দুটি ছবিই নির্মেদ, পরিচ্ছন্ন। মেজাজে বনফুলের ছোটগল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে যে ছবিটি সত্যিই স্মরণীয় হতে পারত, সেটি হল ‘লকডাউনে ফ্যাতাড়ু’। যারা প্রচুর খাদ্যসামগ্রী কিনে ঘর ভরাচ্ছে, ফ্যাতাড়ুরা তাদের ভাণ্ডার লুট করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকা অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার প্ল্যান করে। মূল ভাবনাটুকু সময়োপযোগী। সমস্যা ট্রিটমেন্টে। এর আগে দেবেশ ফ্যাতাড়ুর তিনটি গল্প একসূত্রে সাজিয়ে নিয়ে বেশ ভালো একটি মঞ্চপ্রযোজনা করেছেন। কিন্তু এখানে ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে নিজে গল্প ফাঁদতে গিয়ে তিনি কেলো করেছেন। আসলে নবারুণের প্লট ও গদ্যের নিহিত নাশকতা বড় ভয়ানক। ও জিনিস ব্রহ্মাস্ত্রের মতো। সঠিক ছুঁড়তে না পারলে নিক্ষেপকারীকেই এসে পুড়িয়ে খাক করে দেয়। হয়েছেও তাই। সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে খারাপ অভিনয়। মদনের ভূমিকায় শান্তিলালের মতো অভিনেতাকে এত ক্লান্ত, ব্যাটারি ফুরানো বলে কেন মনে হল বোঝা গেল না। অমিত সাহা তো অসহ্য ভাঁড়ামি করেছেন। যারা দেবেশের ফ্যাতাড়ু নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা ডি.এসের ভূমিকায় সতীশ সাউকে অবশ্যই মিস করবেন। তবু কিছুটা মন্দের ভালো সৌরভ পালোধীর পুরন্দর ভাট। চন্দ্রবিন্দুর পুরনো আবহ আর কিছুক্ষেত্রে ভালো এডিট ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগার মতো নয়। ছাদের দৃশ্যগুলি গ্রহণের চেষ্টা প্রশংসনীয়। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে অবশ্যই কিছু বলার নেই। এই সময়ের নানা অপ্রতুলতা, বাধ্যবাধকতার মধ্যেও যে কাজ অব্যাহত রাখার একটা চেষ্টা দেবেশ করছেন, শুধু সেটুকুর জন্যেই বেশ খানিকটা সাধুবাদ তাঁর প্রাপ্য। তবে উড্ডীন ফ্যাতাড়ুদের বোঝাতে একটি অতি অসহ্য অ্যানিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে। জায়গাটা অন্যভাবে ভাবা যেত না কি?
দেবেশের শিল্পের যাঁরা অনুরাগী, তাঁদের কাছে অবশ্যই এগুলো বিশেষ কোনও গুরুত্ব পাবে না। দেবেশ নিজেও তেমন গুরুত্ব দিয়ে এগুলো বানিয়েছেন বলে মনে হয় না। তিনি একজন অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর শিল্পী। এগুলি নিতান্ত তাঁর আলসেমির হাতমকশো। কিংবা আসল কাজের প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেওয়া মাত্র। তাঁর অ- গুরুত্বের কাজও বাংলা বাজারে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি শিল্পগুণান্বিত, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া প্রকৃতি যখন হ্যাঁচকা টানে সব থামিয়ে দিয়েছে, তখন থেমে না থেকে নিজের শিল্পকে আঁকড়ে থাকার, স্বধর্মে দাঁড়িয়ে থাকার এই প্রয়াসকে কুর্নিশ জানাতে হয়। তবে দেবেশ নতুন নাটকে হাত দেবার কথা ভাবছেন কিনা, বলা বাহুল্য সেটাই আমাদের অধিকতর আগ্রহের জায়গা।
#লকডাউন #লকডাউন ফিল্ম #শর্টফিল্ম #দেবেশ চট্টোপাধ্যায়