কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
একের পর এক নৃশংস খুন। ধরন একই। খুনের পর প্রতিটি শিকারের দেহ চিরে দেওয়া। অথচ আততায়ী অধরা। অচেনাও। ভয়ে থমকে গিয়েছিল উনিশ শতকের লন্ডন শহর। এই অজ্ঞাতপরিচয় খুনি আজও দুনিয়ার কাছে পরিচিত জ্যাক দ্য রিপার নামে। কিন্তু এরও আট বছর আগে খাস কলকাতায় আবির্ভাব ঘটেছিল এক সিরিয়াল কিলারের। তাও পুরুষ নয়, মহিলা খুনি। তার ঠান্ডা মাথায় করা খুনগুলির তদন্তে নেমে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছিল কলকাতা পুলিশ।
পুলিশের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ এক চুরির সূত্রে। বড়বাজারের এক বিখ্যাত গয়নার দোকান থেকে দশ হাজার টাকার জহরত পছন্দ করেছিলেন এক রানি। শর্ত ছিল ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’-র। কিন্তু সেসব পৌঁছে দিতে গিয়ে নিখোঁজ হন দোকানেরই এক কর্মী। হদিশ মেলে না টাকা কিংবা জহরতেরও। দীর্ঘ তদন্তের পর ধরা পড়ল, খুন হয়েছেন ওই কর্মী, আর লোপাট হয়েছে দামি জহরতগুলি। দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের কৌশলে ধরা পড়ল দুই অপরাধীও। তাদের মধ্যে একজন আবার মহিলা! পেশায় বারবনিতা, নাম ত্রৈলোক্যতারিণী। কিন্তু ধরা পড়লেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে শাস্তি দেওয়া গেল না তাকে। তবে তক্কে তক্কে ছিলেন দারোগাবাবু। বুঝেছিলেন, এমন আটঘাট বেঁধে কাজ করে যে, সে পাকা অপরাধী। সুতরাং ক্রাইমের জালে সে জড়াবেই কখনও না কখনও। আর হলও তাই।
আরও পড়ুন : শরীর-ই গুপ্তচর / রণিতা চট্টোপাধ্যায়
কিছুদিন পরেই পুলিশের কাছে এল এক বারাঙ্গনার খুনের খবর। তদন্তে গিয়ে ফের সেই ত্রৈলোক্যের দেখা পেলেন দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। এবারও সন্দেহের আঙুল ত্রৈলোক্যের দিকেই। অথচ ফের প্রমাণের অভাব। কিন্তু এবার দারোগাও নাছোড়বান্দা। রীতিমতো চালাকির ফাঁদে ফেলেই অপরাধীর স্বীকারোক্তি আদায় করলেন তিনি। যে ছেলেটিকে সে পুত্রস্নেহে বড় করে তুলেছে, যে ছাড়া পৃথিবীতে আপনার জন বলতে তার কেউ নেই, সেই ছেলেকেই খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে দেখে আর আত্মগোপন করে থাকতে পারেনি ত্রৈলোক্য। নিজের অপরাধ স্বীকার করে সে। আর এই স্বীকারোক্তির ফলে, ১৮৮৪ সালে ফাঁসি হয় ত্রৈলোক্যতারিণীর।
ফাঁসির আগে প্রিয়নাথ দারোগার কাছে দীর্ঘ জবানবন্দি দিয়েছিল ত্রৈলোক্য। তার কথা থেকেই জানা গিয়েছিল, গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত খুন করে গিয়েছে সে। উদ্দেশ্য একটাই। গয়না চুরি। আর সেই উদ্দেশ্যেই সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়েছিল অজ পাড়াগাঁয়ের সম্ভ্রান্ত কুলীন বংশের এই মেয়েটি। এর আগেও গয়নার লোভে এক দেশীয় রাজ-এস্টেটের কর্মচারীকে খুন করেছিল সে। কিন্তু সেই মামলায় ধরা পড়ে তার সহকারীর ফাঁসি হয়। এর পর থেকে নিজস্ব পদ্ধতিতে একাই পাঁচ-পাঁচটি খুন করেছিল ত্রৈলোক্য। নিষিদ্ধ পল্লির পড়শিদের মধ্যে থেকেই শিকার বেছে নিত সে। তাদের বিশ্বাস অর্জন করার পর, এক গুরুদেবকে দর্শন করানোর ছলে তাদের নিয়ে যেত মানিকতলার পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে। ধর্মীয় আচারের অজুহাতে নির্দেশ দিত গা-ভরা গয়না পরে যেতে। আর গুরু দর্শনের আগে বাগানবাড়ির পুকুরে স্নান করার ছুতোয় শিকারকে ডুবিয়ে মারত সে।
অথচ, বর্ধমানের গ্রামে বেড়ে ওঠা গেরস্থ ঘরের সুন্দরী মেয়ে ত্রৈলোক্যের জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচজনের মতোই। সেকালে কুলীন ঘরের মেয়েদের যে নিয়তি বরাদ্দ ছিল, তার ভাগ্যেও অন্যরকম কিছু হয়নি। ষাট পেরোনো এক বৃদ্ধের একাধিক স্ত্রীর একজন ছিল সে। নাম কা ওয়াস্তে স্বামী। শ্বশুরবাড়ির প্রশ্নই নেই। বিধবা হওয়ার খবরটুকু অবশ্য ঠিক পৌঁছে গিয়েছিল বছর কয়েক পরে। এই অবস্থায় প্রেম এসেছিল একলা মেয়েটির জীবনে। সে প্রেমের খবর রটে যেতেও সময় লাগেনি। ঘরে বাইরে অপমানের মুখে দাঁড়িয়ে প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়ার পথটাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল বেপথু তরুণীর। আর সেই প্রেমিকের দৌলতেই কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লিতে হাতবদল হয়ে যায় তার।
আরও পড়ুন : ম্যাও বনাম মানুষ: গুপ্তচরের আজব কিসসা / রোহন রায়
জীবন যাকে বারবার ঠকিয়েছে, জীবনকে প্রতারণা ছাড়া আর কী-ই বা ফিরিয়ে দিতে পারত সে! ত্রৈলোক্যের কথা যিনি লিখেছিলেন, সেই দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় অবশ্য এত কিছু ভাবতে চাননি। আদালতও তাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ত্রৈলোক্যকে কেবল সিরিয়াল কিলারের তকমা দিয়েই থেমে গেলে, সামাজিক নিয়মকানুনের ফাঁসে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটির প্রতি সুবিচার হয় কোথায়!
...................
#serial killing #হত্যা #সিরিয়াল কিলিং #কলকাতা #ত্রৈলোক্য #তোড়ি সেন #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal