বইয়ের খবর

কৌশিক মজুমদারের 'সূর্যতামসী' : লকডাউনের বেস্টসেলার

সুচরিতা বসু July 28, 2020 at 5:33 am বইয়ের খবর

লেখক: কৌশিক মজুমদার
অলংকরণ: গৌতম কর্মকার
প্রকাশক: বুক ফার্ম

পৃথিবীতে যত রকম বই মেলে তাদের যদি পাঠকের আগ্রহ টেনে রাখার মাপকাঠিতে নম্বর দিতে হয়, গোয়েন্দা কাহিনি সম্ভবত নিরঙ্কুশ প্রথম স্থানাধিকারী। এর টাটকা প্রমাণ, মাসের পর মাস বেস্টসেলারের তালিকায় এক নম্বরে থাকা ‘ফেলুদা সমগ্র’। এই বাজারে যখন লকডাউনের মধ্যে আরও এক গোয়েন্দার আবির্ভাব হয়, তাও সোশ্যাল মিডিয়ার পাড়া কাঁপিয়ে, তখন সেই বহু বিজ্ঞাপিত গল্প নিয়ে এমনিতেই খানিক কৌতূহল তৈরি হয়ে যায়।

প্রথমেই একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, লেখক সোজা ব্যাটে ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ধরুন, আপনি বাঙালি ও কন্টিনেন্টাল খাবারের বিশেষ ভক্ত এবং একটি বাঙালি রেস্তোরাঁতে উদরপূর্তি করতে গেছেন। এদিকে খাওয়া শুরু করার পর দেখছেন, এঁচোড়ের ডালনা আর চিংড়ির মালাইকারির পাশে গ্রিলড পর্ক রিবস্‌ আর রোস্টেড ডাক সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে! আপনি মনেপ্রাণে জানেন এই মিলমিশ অবাস্তব, অথচ স্পষ্ট বুঝছেন এই অমোঘ হাতছানি এড়াতে পারবেন না। সূর্যতামসী পড়ার প্রতিক্রিয়াও খানিক সেইরকম। বাঙালির পরিচিত ও বিস্মৃত একাধিক দেশি-বিদেশি নায়ককে নিয়ে উনিশ শতকের বাবু কালচারের পটভূমিকায় এক নৃশংস থ্রিলারের জাল বোনা শুরু হয়েছে, যার সুতো ছড়িয়েছে একুশ শতকের কলকাতা পর্যন্ত। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সেই সময়ের কলকাতাকে শব্দে চিত্রিত করেছেন কৌশিকবাবু আর এই কাজে তাঁকে যোগ্য সংগত করেছেন শ্রী গৌতম কর্মকার, যাঁর রেখাচিত্রের সঙ্গে নব্বই দশকের বাঙালি কিশোর এবং বাংলায় ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক’ সিরিজের তন্নিষ্ঠ পাঠকমাত্রেই নিবিড়ভাবে পরিচিত। তৎকালীন কলকাতার রাস্তাঘাট, লাশকাটা ঘর, চিনাপট্টি, মানসিক হাসপাতাল – সবকিছুই এই দুই শিল্পীর যৌথ উদ্যোগে গল্পের অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠে। কলকাতার বেশ্যাপল্লি, পাগলাগারদ, আফিমের ঠেক, এইসব জায়গার ইতিহাস সাধারণ পাঠকের অজানা, তাই এর নিষিদ্ধ আকর্ষণ আমাদের টেনে নিয়ে যায় রহস্যের চোরাগলিতে, জড়িয়ে ফ‍্যালে ১৯১১ আর ২০১৮-এর দুই প্রাইভেট ডিটেকটিভের কার্যকলাপের রোজনামচায়। এইখানে লেখার স্টাইল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; তিনটি ভাষ্যে সমস্ত গল্পটি বলা হচ্ছে – উনিশ শতকের দারোগা প্রিয়নাথের জার্নাল, লেখক ও হাল আমলের গোয়েন্দা তুর্বসু রায়ের জবানিতে। সমান্তরাল ভাষ্যে সাবলীল বিচরণের মধ্যেই লেখক পুরোনো কলকাতার ঝাঁকিদর্শন মিশিয়ে দিয়েছেন।

আর ঠিক এই জায়গাতেই পোড়া মশলার স্বাদ মুখে লাগে। ইতিহাস-আশ্রিত লেখার তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে গিয়ে এমন কিছু মুহূর্ত এসেছে যা আদতে থ্রিলারের দুরন্ত গতিবেগে অনাবশ্যক হ্যান্ডব্রেক মেরেছে। ক্লাইভ স্ট্রিট বা চাঁদপাল ঘাটের নামকরণের ইতিহাস অথবা চুঁচুড়ার ওলন্দাজ ইতিহাস, গল্পের মূল প্লটে কোনও আলাদা অভিঘাত নিয়ে আসে না, উল্টে অহেতুক মেদ বৃদ্ধি করে। অথচ সোনাগাজি পিরের থান থেকে সোনাগাছি হয়ে ওঠার ইঙ্গিত যে দক্ষতায় লেখক দিয়ে যান, কোনোরকম অতিরিক্ত তথ্যের সাহায্য ছাড়াই, সেই দক্ষতা এবং পাঠকের উপর আরেকটু ভরসা, লেখার আরও কয়েক জায়গায় থাকলে অস্বস্তি থাকত না। অস্বস্তি রয়ে যায়, উচ্চকিত “ডিটেকটিভ উপন্যাস!” বিজ্ঞাপনেও। এই কাহিনির চলনে রোমাঞ্চ, বলনে রহস্য এবং গড়নে নেটফ্লিক্স। যে কারণে ড্যান ব্রাউন বা জেম্‌স হেডলি চেজের লেখাগুলিকে গোয়েন্দা গল্প বলা যায় না, সেই একই কারণে এই কাহিনিকেও “ডিটেকটিভ উপন্যাস!” বলা যায় না।

সম্ভবত শ্রীমজুমদারের সবথেকে বড় সাফল্য, গোয়েন্দা তুর্বসু রায়। সে পড়াশোনায় সাদামাটা, ট্র্যাফিক আইন ভাঙে, প্রতিপক্ষের জালে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়, কোনও বিশেষ বিষয়েই তার অগাধ জ্ঞান নেই, প্রতিপদে ঠোক্কর খেতে খেতে তুর্বসু শেখে। অর্থাৎ কোনওভাবেই সে ফেলুদা-ব্যোমকেশ-শার্লক নয়, বরং একজন রক্তমাংসের প্রাইভেট ডিটেকটিভ, যেমনটা শহরের বুকে এখনও দেখা যায়। এই বাস্তবিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার নিরিখেই এই চরিত্র বাকিদের থেকে অনেক আলাদা। এমন প্রচেষ্টা নির্দ্বিধায় কুর্নিশযোগ্য। সেই সঙ্গে বলতে হয় বইয়ের গুণগত মানের কথা। প্রচ্ছদ থেকে নামাঙ্কন, বাঁধাই থেকে মুদ্রণ, সবকিছুতে পেশাদারিত্ব ও যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। এ বই হাতে নিলে নামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না, এই গল্প পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না।



কভার পোস্টার : অর্পণ দাস

#সূর্যতামসী #রিভিউ #বই

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219128