কাদম্বিনী
বনেদি জমিদারবাড়ির বউ। ঘোরতর অসুস্থ, হয়তো বা প্রয়োজন অস্ত্রোপচারেরও। কিন্তু ডাক্তার ঢুকবে বাড়ির অন্দরমহলে? নৈব নৈব চ। এমন সময় জমিদারবাবুর কানে এল, শহর কলকাতাতেই আছেন একজন মহিলা ডাক্তার। কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ে পাশ করেছেন। বিলাতি ডিগ্রিও আছে তাঁর। স্কটিশ কলেজ থেকে ট্রাইপস, এডিনবরা থেকে এফ আর সি পি, গ্লাসগো থেকে এম আর সি এস এবং ডাবলিন থেকে ডি এফ পি এস উপাধি লাভ করেছেন তিনি।
জমিদারবাবু স্তম্ভিত হয়ে বলেন, কী আশ্চর্য! তাঁর কথা তো কেউ আমাকে এতদিন জানায়নি। কী নাম সেই মেমসাহেবের?
আজ্ঞে না, মেমসাহেব নন, তিনি বাঙালি। তাঁর নাম শ্রীযুক্তা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।
সালটা ১৮৬১। আমাদের চেনা কলকাতার চেহারা তখন নিতান্তই সেকেলে। না আছে ট্রাম, না আছে মোটরগাড়ি। রাস্তায় নেই বিজলিবাতির আভা, আর মনের আনাচেকানাচেও জমাট বাঁধা অন্ধকার। মেয়েদের চলাফেরার জন্য পালকিই ভরসা। পরপুরুষ দেখলে নাক পেরিয়ে ঘোমটা টানাই তাদের দস্তুর, আর গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো মানে লজ্জার একশেষ। শহরের গুটিকয় অভিজাত বাড়িতে সবে অল্পে অল্পে ঢুকছে নতুন যুগের আলোবাতাস। এহেন সময়ে পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জন্মালেন যে দ্যুতিময় মনীষা, তাঁর কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সেই একই বছরে কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে, বিহারের ভাগলপুরে জন্ম যে বাঙালিনির, তাঁকে কতটুকু মনে রেখেছি আমরা? এদেশীয় মেয়েদের ঘর গড়া সুখদুঃখের খাঁচাটি ভেঙে তিনি তৈরি করেছিলেন নতুন পথ। নতুন ইতিহাস।
কেবল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী নন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের অন্যতম কাদম্বিনী। ভারতের প্রথম মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ব্রজকিশোর বসু মেয়েকে ভরতি করে দিয়েছিলেন কলকাতার হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। ১৮৭৮ সালে এই স্কুলটি মিলে যায় বেথুন স্কুলের সঙ্গে। এখান থেকে কাদম্বিনীই প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসলেন। পাশ করার পরে জুটল খোদ লর্ড লিটনের প্রশংসা ও পুরস্কার। এরপর?
কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে পরিণত করার পরিকল্পনা নিতে হল সরকারকে। একজন ছাত্রী, অধ্যাপকও একজন। এখান থেকেই বি এ পরীক্ষায় বসলেন কাদম্বিনী।
বি এ পাশের পরে, এবং আগেও, মেডিকেল কলেজে ভরতি হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন কাদম্বিনী। অবশেষে মিলল ছাড়পত্র। সৌজন্যে প্রথম ভারতীয় র্যাংলার আনন্দমোহন বসুর আইনি নোটিস।
ভরতি তো হলেন। কিন্তু বিপত্তি পিছু ছাড়ল না। পর পর তিন বছর যে মেডিসিনে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেয়েছিলেন কাদম্বিনী, এমবি-র ফাইনাল পরীক্ষায় সেই পেপারেই ফেল করানো হল তাঁকে।
পথটা কঠিন ছিল। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে, আরও অনেক ভারতীয় মেয়ের মতো কাদম্বিনী একা হয়ে যাননি। গোটা লড়াই জুড়ে পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী, তাঁর স্কুলের শিক্ষক ‘অবলাবান্ধব’ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
সমাজের চোখে লেগেছিল বইকি। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র বেরোল, দ্বারকানাথের নাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছেন কাদম্বিনী। মামলা করেছিলেন লড়াকু দম্পতি, শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমস্ত শিক্ষিত মেয়েদের প্রতি ছুড়ে দেওয়া কুৎসার বিরুদ্ধে।
স্বামীর সাগ্রহ প্রেরণাতেই আট সন্তানকে ঘরে রেখে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কাদম্বিনী। বিয়ের পর ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সম্ভবত একটি লেকচারও মিস করেনি যে ভারতীয় মেয়েটি, তার কথা চিঠিতে লিখেছেন স্বয়ং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
কাদম্বিনীর সৎ মেয়ে বিধুমুখীর বিয়ে হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর মেয়ে পুণ্যলতা লিখেছেন, “দিদিমা বিলাত থেকে ফিরলেন, নতুন কায়দায় তাঁর ড্রয়িং রুম সাজানো হল। দেশ-বিদেশ থেকে আনা কত রকম সুন্দর সুন্দর জিনিস।”
পুণ্যলতার দাদা সুবিমল রায়ের আবার মনে থেকে গেছিল কাদম্বিনীর পড়ার ঘরটিকে –
“একটা ঘর ছেলেমেয়েদের কাছে বড় অদ্ভুত লাগত। সেটা ছিল তাদের ডাক্তার দিদিমা কাদম্বিনী গাঙ্গুলির পড়বার ঘর। সেখানে দেওয়ালে একটা মানুষের কঙ্কাল টাঙানো থাকত। বড় বড় আলমারিতে নানারকম ডাক্তারি বই আর নানারকম যন্ত্রপাতি থাকত।”
বোঝা যায়, ডিগ্রি পাওয়ার পরেও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহ ফুরিয়ে যায়নি কাদম্বিনীর। সেকেলে কলকাতার ছুঁতমার্গ তাঁকে অপমান করেছে, কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারেনি। দেশে ফেরার পর তাঁর ছোট ছেলেটি মাকে চিনতে পারেনি বটে, কিন্তু বেদনার উল্টোদিকে প্রাপ্তির ভাঁড়ারও ভরে উঠেছিল অন্যভাবে।
নেপালের মরণাপন্ন রাজমাতাকে সারিয়ে তোলেন তিনি। ভিজিটের টাকা ছাড়াও উপহার হিসেবে এসেছিল ভালো ভালো পোশাক, মৃগনাভি, পিতল, তামা ও হাতির দাঁতের তৈরি সুন্দর সুন্দর জিনিস আর সুন্দর বেঁটে গোলগাল সাদা একটি নেপালি টাট্টু ঘোড়া। আধুনিক ফ্যাশনের পোশাক পরা হোক, বা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে রোগী দেখতে যাওয়া, ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের থেকে কোথাও আধুনিকতায় পিছিয়ে ছিলেন না কাদম্বিনী। বরং স্বাবলম্বী কাদম্বিনী তাঁদেরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর দিনেও তাঁর অর্জিত ভিজিটের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ টাকা, যে টাকায় নাকি সেকালের কলকাতায় শ-পাঁচেক লোককে একদিন খাওয়ানো যেত!
প্রাসঙ্গিক তথ্য : বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য , শৌভিক মুখার্জি
#নিবন্ধ