ব্যক্তিত্ব

দেশজ আঙ্গিকের সহজিয়া ছোঁয়ায় আজও অমলিন যামিনী রায়

শৌভিক মুখোপাধ্যায় April 22, 2022 at 6:35 am ব্যক্তিত্ব

ব্যস্ত দিন। মানুষ ছুটছে জীবিকার প্রয়োজনে। রাজপথে যানবাহনের কোলাহল। দৈনন্দিন শোরগোল। সেই শোরগোলের রেশ এসে পৌঁছচ্ছে আর্ট কলেজের চৌহদ্দিতে। তখন সেখানে পুরোদমে ক্লাস চলছে। রোজকার অভ্যাসমত অধ্যক্ষ বেরিয়েছেন তদারকিতে। এমন সময় নজরে পড়ল একটি ছাত্র ক্লাসে না গিয়ে চৌরঙ্গির দিকের খড়খড়ি তুলে একদৃষ্টে হয়ে কী যেন দেখছে। আশেপাশে কী ঘটছে সে বিষয়ে তার কোনও খেয়াল নেই। আরও একটু কাছে পৌঁছে তিনি চিনতে পারলেন ছাত্রটিকে। আর্ট কলেজের ইতিহাসে অন্যতম প্রতিভাবান ছাত্র। এই বয়সেই তার পাকা হাতের কাজে সবাই মুগ্ধ। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ নিজেও নিঃসংশয়। তাই তো ছাত্রটিকে বিনা পরীক্ষায় যে কোন ক্লাস করার অনুমতি তো দিয়েইছেন একইসঙ্গে তার আঁকা কিছু ছবিও ক্লাসরুমের দেওয়ালে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছেন। তিনি জানেন ছাত্রটি বাঁধা গতে চলতে চায় না, তাই তাকে ক্লাসে না দেখতে পেয়ে তিনি অবাক হননি। বরং ছাত্রটি এমন তন্ময় হয়ে কী দেখছে সেই ব্যাপারে জানতে তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। পাশে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ওদিকে কী দেখছ যামিনী? আর্ট কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন যামিনী রায়। বললেন, সামনের প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে হবে। তাই তার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলেন না ব্রাউন সাহেব। চৌরঙ্গীর প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার সঙ্গে খড়খড়ির সম্পর্ক কী? একটু বাদেই ছাত্রের কথায় তার ধন্দ কেটে গেল। ছড়ানো প্রকৃতিকে কেটে সীমায় না বাঁধলে তাকে ছবিতে ফোটানো যাবে কী করে? খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে তাকালে আপনা থেকেই সীমাবদ্ধ হয়ে দৃশ্য ধরা দেয়। তাই আঁকবার আগে এভাবেই স্মৃতিতে গুছিয়ে নিচ্ছেন। ছাত্রের ভাবনায় তৃপ্তির হাসি ফুটল অধ্যক্ষের মুখে। তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘That is the way, you are right, Jamini”.

এই যে নিজের মত করে কিছু করা এই ভাবনায় আজীবন স্থিত ছিল তাঁর মন - কী আঁকায়, কী জীবনে। শুরুর দিকে নিসর্গচিত্র আঁকায় তাঁর খ্যাতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে গ্রামজীবনের উপর আঁকা ছবির জন্যেই তিনি ভাইসরয়েজ গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। সেকালে একদিকে ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুকৃত ওরিয়েন্টাল আর্ট যার প্রতিনিধিত্ব করতেন নন্দলাল বসু প্রমুখ আর অন্যদিকে ছিল ওয়েস্টার্ন স্কুল অব রিয়েলিস্টিক আর্ট। এখানে ছিলেন যামিনী রায়, অতুল বসু, হেমেন মজুমদার প্রমুখ।রিয়েলিস্টিক পোর্ট্রেটে যামিনী রায়ের অসামান্য দক্ষতা ছিল। তুলির টানে মুগ্ধ হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট। আচার্য যদুনাথ সরকার , যোগেশচন্দ্র রায় এঁরাও পোর্ট্রেট আঁকান। তবু পাশ্চাত্য ঘরানা থেকে একদিন সরে এলেন দেশের খোঁজে।  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন শিল্পে দেশজ সুরের কথা, ভারতীয়ত্বের ছাপ ছেড়ে যাওয়ার কথা। এই কথাটা তাঁকে খুব নাড়া দিয়েছিল। খুঁজতে শুরু করলেন দেশজ স্বর। তৈরি হলো নতুন আঙ্গিক। যে পথ তাঁর নিজের কাটা পথ। যামিনী রায়ের ছবি আলাদা ভাবে পরিচিতি পেল। এই সন্ধান প্রক্রিয়ায় অনুঘটক হয়ে হাজির হয়েছিল তাঁর দেশের মাটি। মাটির পুতুল, বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালের টালির ছবি, কালীঘাটের পট থেকে খুঁজে নিয়েছিলেন আগামীর ভাবনা। পরে অনেকেই তাঁর ছবির সঙ্গে কালীঘাটের পটচিত্র রীতির সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তা পুরোপুরি ঠিক নয়।  আরও এক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অহিভূষণ মালিক এই ভ্রম নিরসন করে দিয়ে গেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি কালীঘাটের পটুয়া রজনীকান্ত চিত্রকরের মুখোমুখি হয়ে পটচিত্রের নির্মাণ ও আঙ্গিক নিয়ে আলাপ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে আসেন, যামিনী রায়ের শিল্পকলা আপাত দৃষ্টিতে পটের মত দেখালেও তা ঠিক পটের ছবি নয়। স্বতন্ত্র আঙ্গিকে সমুজ্জ্বল।

একটি প্রবন্ধে শিল্পী রথীন মিত্র বলেছিলেন, “মাতিস যেমন শ্রমকাতর মানুষকে বিশ্রামের শান্তি দিতে চেয়েছিলেন তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে তেমনি আমাদের যামিনী রায় চেয়েছিলেন ঘরোয়া মানুষকে আনন্দ দিতে।” এ কথায় অতিশয়োক্তি নেই। একসময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে তার ছবির উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সহজ ছাঁদে আঁকা ছবিগুলি আজও তুমুল জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই জনপ্রিয়তা আমাদের অবাকও করে। মনে পড়ে হলডেন-এর উক্তি - “এত সহজ সরল ছবি আপনার কিন্তু বছরের পর বছর তাকিয়ে থাকা যায়।" আসলে মৌলিকতা চিরজীবী। চিরতরুণ। চিরভাস্বর। যামিনী রায় আমাদের মনে বেঁচে আছেন নিজের মতো ভাবার জোরেই।

#ব্যক্তিত্ব #যামিনী রায় #শৌভিক মুখোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

8

Unique Visitors

219112