বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (পঞ্চম পর্ব)

অর্পণ পাল Aug 3, 2024 at 11:07 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

...............

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ও জগদীশচন্দ্র

.........

 ১. পরিষদ-এর সূচনা ও জগদীশচন্দ্রের যোগদান 


উনিশ শতকের শেষ দশকে ১৮৯৩ সালের ২৩ জুলাই সাহিত্য পরিষদের সূচনা। শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুর-এর ২/২ নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের ঠিকানায় শুরু হয় বেঙ্গল একাডেমী অব লিটারেচার। সভা স্থাপিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি আর সংস্কৃত সাহিত্যের সাহায্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের উন্নতিবিধান করা। সভার আলোচনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র সেন-- এঁরা। প্রথম প্রথম প্রতি রবিবার সভার অধিবেশন হত, আর প্রকাশিত হত ইংরেজিতে একটি মাসিক পত্রিকা। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উন্নতির জন্য তৈরি হওয়া সভার কাজকর্ম ইত্যাদি সবকিছুই ইংরেজিতে হচ্ছে দেখে সদস্যদের অনেকে আপত্তি করেন আর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে নাম বদলে করা হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।

               পরিষদের প্রথম দিকে পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময়কাল ধরে অধিবেশনগুলো চলত বিনয়কৃষ্ণ দেবের বাসস্থানে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের দিকে বেশিরভাগ সদস্যের জোরাজুরিতে স্থান বদলে গোটা ব্যাপারটা চলে আসে গ্রে স্ট্রিটের ১০৬/১ নং বাড়িতে। কিন্তু এইভাবে কারও মালিকানাধীন বাড়িতে সভাগুলো না হয়ে একটি প্রকাশ্য ভবনে হলে সকলের পক্ষে যোগ দেওয়া অনেক সুবিধে, তাই ১৩০৬ বঙ্গাব্দের শেষভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়, যাতে নিজস্ব ভবন তৈরি করা যায়। এরপর সদস্যসংখ্যা যত বাড়তে থাকে তত জোরদার চেষ্টা শুরু হয় পরিষদের নিজস্ব ভবন তৈরির। আর সে সাহায্যও মিলে গেল কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছ থেকে, তিনি দান করলেন বেশ কিছুটা জমি। এখন আমরা যে ভবন দেখি সেটা এই জমিতেই তৈরি হয় এবং ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখে হয় গৃহপ্রবেশ।

পরিষদের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ হয়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। এর তেইশ বছর পর ১৩২৩ সালে এই পদে বসেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর আগে এই পদে ছয় জন বসেছিলেন (রমেশবাবু এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দু-বার করে), কিন্তু তাঁদের কেউই বিজ্ঞানী ছিলেন না। জগদীশচন্দ্রের পর ১৩৩৮-৪১ এই তিন বছর এই পদে ছিলেন আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়।


২. 

সাহিত্য পরিষদ নতুন ভবনে আসবার কয়েক বছর পর থেকে প্রতি বছর আয়োজন করতে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে বক্তৃতার। স্থির হয় যে এমনভাবে বক্তব্য রাখবেন তাঁরা, যেন বোধগম্য হয় সকলেরই।

জগদীশচন্দ্র নিজে এই বক্তৃতামালার অন্তর্গত একটি বক্তৃতা দেন ৭ পৌষ ১৩২৪ (১৯১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর) তারিখে। তাঁর সেদিনের বিষয় ছিল ‘আহত উদ্ভিদ’। যন্ত্রপাতি সহযোগেই তিনি সেদিন দেখিয়েছিলেন কীভাবে বিভিন্ন জড় পদার্থ এবং উদ্ভিদেরা নানাবিধ বাহ্যিক উত্তেজনায় সাড়া দেয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গাছেরাও কীভাবে উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়, সেটাকেও তিনি দেখিয়েছিলেন যন্ত্রপাতির সাহায্যে। এই বক্তৃতাতেই তিনি তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন, কেন এই যন্ত্রের নাম প্রথমে কুঞ্চনমান রেখেছিলেন, আর সেই নাম সাহেবদের মুখে কীভাবে অন্যতর উচ্চারিত হওয়ার ফলে তিনি বিরক্ত হয়ে আবার ইংরেজি নামে ফিরে গেলেন, রয়েছে সে প্রসঙ্গও।                                                                     


দ্বিতীয় বক্তৃতা

এরপর ১৩২৭-এর ১৯ চৈত্র (২ এপ্রিল ১৯২১) সন্ধে ছ-টায় তিনি আরও একটি বক্তৃতা দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা প্রবাহ’। এই বক্তৃতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিজ্ঞান মন্দিরের সভাকক্ষে, আর সভাপতি হয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেন: ‘চারি বৎসর পূর্ব্বে আচার্য্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু সাহিত্য পরিষদের সভাপতিরূপে ধারাবাহিক বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে তিনি আজ ‘স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা প্রবাহ’ বিষয়ে বক্তৃতা দিবেন। এ সম্বন্ধে তাঁহার নূতন আবিষ্ক্রিয়া প্রদর্শিত হইবে।’

ছায়াচিত্র অর্থাৎ স্লাইড সহকারে সেদিন তিনি যা বলেছিলেন সেটা পরে 'অব্যক্ত' বইয়ে স্থান পেয়েছে।

পরিষদের আয়োজনে

এই অনুষ্ঠানের একটি বিবরণ প্রকাশিত হয় পরিষদের নিজস্ব পত্রিকা সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায়। শুধু জগদীশচন্দ্রই নন, এখানে অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁরই ছাত্র শিশিরকুমার মিত্র একবার বলেছিলেন ‘বেতারের আবিষ্কার’ নিয়ে।


 সাহিত্য পরিষদে বিশিষ্টজনেদের সংবর্ধনা


চতুর্থ বিদেশ সফর সেরে সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র দেশে ফিরলেন ১৯১৫ সালের জুন মাসে। পরের মাসে, ১৫ শ্রাবণ ১৩২২ তারিখে (৩১ জুলাই ১৯১৫) এই উপলক্ষ্যে সান্ধ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পরিষদ ভবনে। সেখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয় জগদীশচন্দ্রকে।

পরেরটা ঘটে যায় কয়েক বছর পর। সেবারেও উপলক্ষ্য ছিল জগদীশচন্দ্রের বিদেশ থেকে ফেরা। সেটা তাঁর পঞ্চম বিদেশ সফর। মাঘ ১৩২৭ (ফেব্রুয়ারি ১৯২১) তারিখে জগদীশচন্দ্রের দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে সোনার দোয়াত-কলম দেওয়া হয় এই সংবর্ধনায়।


সাহিত্য পরিষদের বিভিন্ন সম্মেলন ও জগদীশচন্দ্র


বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় কাশিমবাজারে, ১৭ আর ১৮ই কার্তিক, ১৩১৪ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৯০৭-এর নভেম্বর মাসের ৩ আর ৪ তারিখে, সেবার সভাপতি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখনও তিনি নোবেল পাননি, তার কবিখ্যাতিও বিশ্বজনীন হয়নি।

               এর পরের দুটো বছর এই সম্মেলন হয় রাজশাহী এবং ভাগলপুরে, সভাপতি হয়েছিলেন যথাক্রমে প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং সারদাচরণ মিত্র। দেখাই যাচ্ছে, জগদীশচন্দ্রই প্রথম নন, তাঁরও আগে বিজ্ঞানী হিসেবেই প্রফুল্লচন্দ্র এই কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন। [জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রিয় বিজ্ঞানী-বন্ধুর সভাপতি হওয়ার খবরে বলেছিলেন, ‘তাঁহাকে সমাদর করিয়া সাহিত্য-সম্মিলন যে কেবল গুণের পূজা করিয়াছেন তাহা নহে, সাহিত্যের একটি উদার মূর্ত্তি দেশের সম্মুখে প্রকাশ করিয়াছেন।’ (বিজ্ঞানে সাহিত্য, অব্যক্ত থেকে।)]

            ১৯১০ সালে কোনও সম্মিলন হয়নি, আর এর পরের বছর আয়োজিত হয় ময়মনসিংহে। তারিখ ছিল পয়লা থেকে তেসরা এপ্রিল, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ।

               এবারে সভাপতি হন জগদীশচন্দ্র বসু। স্থান, আনন্দমোহন কলেজ।

এই ময়মনসিংহেই জন্ম জগদীশচন্দ্রের, তাই এখানকার মানুষের মধ্যে একটা অন্যতর উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় তাঁর আসবার খবরে। তাঁর যেমন জন্মস্থান এই জেলা তেমনই এখানেই তাঁর মামারবাড়ি। সুতরাং এখানে তাঁর বক্তৃতা শুনতে বা তাঁকে দেখতে যে জনসমাগম হবে তা তো স্বাভাবিক ছিলই। এর একটি প্রমাণ: সম্মেলন শুরুর দিন কয়েক আগে জগদীশচন্দ্রের কাছে যখন প্রাথমিক অনুষ্ঠানসূচি জানাবার জন্য অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি মহারাজার কুমুদচন্দ্র সিংহ চিঠি পাঠান, তখন সে চিঠিতেই তিনি লিখেছিলেন যে এবারের সম্মেলনে এত ভিড় হবে যে তাঁর মনে হচ্ছে বক্তৃতা-স্থানে অনেক মানুষকে জায়গাই দেওয়া যাবে না।

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ওখানকার বিশিষ্টজনেরা, সকলেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ভূমিপুত্রকে বরণ করবার জন্য। এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তি ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ২৯ চৈত্র। পথে রাণাঘাট থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। ৩০ তারিখে সন্ধে নাগাদ তাঁরা পৌঁছন ময়মনসিংহ ষ্টেশনে। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি রাজা কুমুদচন্দ্র সিংহ তাঁদের অভ্যর্থনা করেন।


৩.

ময়মনসিংহের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের আবাল্য যোগাযোগ, সুতরাং এখানে আসা মানে তাঁর কাছে এক স্মৃতির সরণি বেয়ে ফেলে আসা জীবনে ফেরা। আর সেই শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার এক সুযোগ এসে গেল ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে। এপ্রিলের চোদ্দ তারিখে আয়োজিত চতুর্থ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে কর্তাব্যক্তিরা যখন চাইলেন যে জগদীশচন্দ্র এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করুন এবং সেই মর্মে তাঁর কাছে আমন্ত্রণপত্রও এল, তখন তিনি আর আপত্তি করতে পারলেন না। তবে তাঁর আপত্তির মূল জায়গা ছিল অন্য। সেটা তিনি উল্লেখও করেছিলেন সভাপতির বক্তৃতার শুরুতেই: ‘সাহিত্য-ক্ষেত্রে কি বিজ্ঞান সেবকের স্থান আছে?’

               এই প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিতে পারি পুলিনবিহারী সেনের কিছু কথা: ‘এই যুগেই বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ কবি ও বিজ্ঞানীর যে যোগ হইয়াছিল… সমগ্র দেশ তাহার ফলভাক্‌ হইয়াছিল। জগদীশ স্বয়ং কবি-মনীষী, ‘আদিকবির প্রতিচ্ছবি’ বলিয়া অভ্যর্থিত হইয়াছেন দেশে বিদেশে; … বিজ্ঞান-সাহিত্যের আলোচনা ও সেই বিষয়ে উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদির প্রকাশ, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সংকলন সাহিত্য পরিষদের উদ্দেশ্য সাধনে উপায়’ বলিয়া প্রথমাবধিই স্বীকৃত; ময়মনসিংহ অধিবেশনের পর হইতে সাহিত্য সম্মেলনের একটি ‘বৈজ্ঞানিক বৈঠক’ বা বিজ্ঞান শাখাও গঠিত হয়।’ (অনুষ্টুপ থেকে প্রকাশিত ব্যক্ত অব্যক্ত, ২১৫ পৃ)


৪.

কিন্তু সে সমাগম যে এমন বাঁধভাঙা আকার নেবে, তা কেউই বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেননি। অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল বেলা তিনটেয়, কিন্তু বেলা এগারোটা থেকেই জনসমাগম শুরু হয়ে যায়। এত মানুষ আসেন, সভায় বিশিষ্ট অতিথিদের পর্যন্ত ববার জায়গা হচ্ছিল না। অবশেষে বেলা সাড়ে তিনটেয় সম্মেলন শুরু হয়।

               আলোচনা হয়েছিল বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, আঞ্চলিক সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে।


     জীবনের উপান্তে সাহিত্য পরিষদ ও জগদীশচন্দ্র


শেষ কয়েক বছর তিনি ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারতেন না এই পরিষদের সভায়। তারপর তিনি গিরিডি গেলেন, সেখানে তাঁর মৃত্যু হল আশি বছরের প্রাক কালে।

গিরিডিতে তাঁর মৃত্যুর পর পরিষদে একটি বিশেষ অধিবেশন বসে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ২১ অগ্রহায়ণ। তাঁর মৃত্যুর কারণে শোকপ্রস্তাব এবং স্মৃতিরক্ষা নিয়ে আলোচনা হয় এই অধিবেশনে। উপস্থিত ছিলেন নীলরতন সরকার, সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন নিয়োগী— এঁরা। আর সভাপতি হয়েছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরিষদের কার্য্যবিবরণীতে এই অধিবেশনের কথা লিখিত হয়েছিল। 

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আজও টিকে রয়েছে তার বিপুল সংগ্রহ নিয়ে, আগেকার সেই উজ্জ্বলতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে গিয়েছে, তবু সাহিত্য বিষয়ক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক সময় জড়িয়ে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বা প্রফুল্লচন্দ্রর মতো বিজ্ঞানীরা, এটা দেখে আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি যে ওই সময়ে বিজ্ঞান আর সাহিত্যে কোনো বিরোধ তো ছিলই না, বরং দুই মহলের মধ্যে আদানপ্রদান চলত বেশ খোলাপথেই। সে পথ রুদ্ধ হয়েছে আজ।

..............


#Jagadishchandra Bose #Scientist #series #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

219080