বাজার করার বিপত্তি এড়াতে ‘লেখক’ হয়ে ওঠেন জগদীশ গুপ্ত
মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি উপন্যাসের একটি চরিত্র ভজা বাজারু। তার প্যাশনই ছিল বাজার করা। কিন্তু বাস্তব জীবনে এমন মানুষও আছেন বাজার করার নামেই যাঁদের গায়ে জ্বর আসে। যাঁদের মনে হয় ‘দরাদরি করে বাজার করার চেয়ে ডাকাতি করা বোধ হয় অনেক সহজ’।
বাজার করা সম্বন্ধে ঠিক এরকমই বিতৃষ্ণা ছিল জগদীশ গুপ্তের। যাঁর নির্ভীক, নির্লিপ্ত জীবনদৃষ্টি বাংলা কথাসাহিত্যকে এক সম্পূর্ণ নতুন বাঁকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। অহেতুক ভাবালুতার স্পর্শ এড়িয়ে জীবনের অস্বস্তিকর, বিস্ময়-উদ্রেককারী সত্যের সামনে পাঠককে দাঁড় করাতে দ্বিধা করেনি তাঁর লেখনী। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক, স্নেহময়, অহংকারশূন্য মাটির মানুষ। নিজেই বলতেন স্রেফ ‘জোচ্চুরি’ করে তিনি নাকি লেখক হয়ে পড়েছেন।
দেশ পত্রিকার কিংবদন্তী সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ছাত্রজীবনে তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখনই তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর ‘ফাঁকি দিয়ে’ লেখক হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত।
জগদীশ গুপ্ত পেশায় ছিলেন বোলপুর আদালতের মুহুরী। ফলে সারাদিন কেটে যেত আদালতের ব্যস্ততায়। রাতে বাড়ি ফেরার পরের সময়টা বরাদ্দ ছিল স্ত্রী-কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। সুতরাং গোটা দিনের মধ্যে একমাত্র সকালটুকুই ছিল তাঁর নিজস্ব সময়, বই পড়া বা পথের দৃশ্য দেখে শুয়ে-বসে কাটানোর সেই-ই ছিল একমাত্র অবসর।
এদিকে সেটুকু অতিমূল্যবান সময়েও টান পড়ছিল গৃহিণীর বকাবকিতে। কাছারির যে বেয়ারা সকালে কুয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যেত, জগদীশ গুপ্তের স্ত্রী চারুবালা দেবী তাকেই বাজারে পাঠাতেন। কিন্তু তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল সে নিশ্চয়ই পয়সা চুরি করে। আর টাটকা সবজির বদলে বাজারের যত শুকনো ঝড়তি-পড়তি আনাজ এনে হাজির করে। অতএব বেয়ারার বদলে বাজার করার ভার এসে পড়ল স্বয়ং জগদীশ গুপ্তের ওপরেই। নিতান্ত অনিচ্ছে নিয়ে হাঁটুভর্তি ধুলো পেরিয়ে এক মাইল দূরের বোলপুর বাজারে যেতে শুরু করলেন। তবে লোক গিজগিজ-করা বাজারের ভিড় থেকে পারলে শতহস্ত দূরে থাকেন তিনি। তাই ফাঁকা জায়গা দেখে হাতের কাছে যা পান তাই-ই কিনে আনতে হয়।
প্রথমদিকে বেশ সাফল্যের সঙ্গেই এই পদ্ধতিতে বাজার করা চলছিল। তাঁর বিড়ি সিগারেটের পয়সায় টান পড়ল ঠিকই, কিন্তু গৃহিণী রীতিমতো বিস্মিত হলেন তাঁর অল্পদামে নানা জিনিস কেনার ক্ষমতা দেখে। ধরেই নিলেন, এতদিন ধরে বাজার করছিল যে বেয়ারা তার নিশ্চয়ই হাতটান ছিল। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী মুহুরী-গিন্নির কাছে স্বামীর বাজার করার এমন সুখ্যাতি করলেন যে তিনিও চাকরকে বরখাস্ত করে নিজের স্বামীকে রোজ বাজারে পাঠাতে শুরু করলেন। সেই ভদ্রলোকেরও ছিল বাজার করার অনীহা। ফলে জগদীশ গুপ্তের ওপর তিনি বেজায় চটে উঠলেন।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর আবার নতুন সমস্যা দেখা দিল। নির্ঝঞ্ঝাটে বাজারের ফাঁকা এলাকা থেকে যা কেনেন জগদীশ, তা চারুবালা দেবীর মোটে পছন্দ হয় না। বাজারের থলিতে লাউ থাকে তো কুচো চিংড়ি থাকে না। মাছের মাথা, ধনেপাতা ইত্যাদি যখন যা চান, না পেয়ে বেজায় অসন্তুষ্ট হন স্ত্রী।
নিত্যদিনের এই খিটিমিটিতে যখন জীবনের ওপর ঘেন্না ধরার উপক্রম হয়েছে, তখন বাজারের বিড়ম্বনা এড়ানোর এক নতুন উপায় আবিষ্কার করলেন জগদীশ গুপ্ত। আদালত থেকে বাড়ি ফিরলেন গুচ্ছের কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ নিয়ে। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে জানালেন আদালতের অনেক কাজ জমে আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম, দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে সেসব। চারুবালা জানতেন জগদীশবাবুর চোখের সমস্যা, রাতে দেখতে পান না। তাই কাজ করার একমাত্র সময় সকালবেলা।
এভাবে বাজার করার যন্ত্রণা থেকে ছুটি মিললে কী হবে, প্রতিদিন আদালতের একঘেয়ে কাগজপত্র একটানা দেখার যন্ত্রণাও তো কম নয়। তাই সেই একঘেয়েমি কাটতেই গল্প লিখতে শুরু করেন জগদীশ গুপ্ত। একদিন একটি ছোটগল্প লিখে পাঠিয়েও দিলেন পত্রিকার দপ্তরে। তার পরেই দ্রুত স্বীকৃতি মিলল লেখক হিসেবে। বাংলা সাহিত্য পেল এক নতুন ধারার কথাকারকে।
আপেল মাটিতে পড়ার পর নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের গল্প নিছক গল্পকথাই। কিন্তু অতি সামান্য দৈনন্দিন ঘটনা থেকে অসামান্য কোনোকিছুর জন্ম হয়তো একেবারে অসম্ভব নয়। বাজার-বিভ্রাট এড়াতে জগদীশ গুপ্তের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ সে কথাই আরও একবার প্রমাণ করে।
******************************
ঋণ : সম্পাদকের বৈঠকে, সাগরময় ঘোষ
#silly point #personality #webportal #জগদীশ গুপ্ত #ব্যক্তিত্ব #সিলি পয়েন্ট #সৃজিতা সান্যাল #বাংলা #বাংলা পোর্টাল