পরিবেশ ও প্রাণচক্র

অতিমারীর উৎস সন্ধানে

সুমিত ঘোষ Nov 24, 2020 at 5:01 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র



শুরু করব যেখান থেকে…


আলাদা আলাদা জীবেরা একসঙ্গে বসবাস করলে, পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে নিজেদের সামাজিক দায়িত্বগুলি পালন করতে থাকলে, তাদের একক অস্তিত্বের বদলে সমষ্টিগত সংঘবদ্ধতা অধিক গুরুত্ব লাভ করে। যেমন, ছত্রাক ও শৈবালের সংঘবদ্ধতাকে ‘লাইকেন’ বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, একটি গাছকে স্বতন্ত্র হিসেবেও দেখা যায় আবার ছত্রাক, শিকড়, ফুল, পাতা, পোকামাকড়, অন্যান্য উদ্ভিদ এবং লাইকেনের সমষ্টিগত অস্তিত্ব হিসেবেও ধরা যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও সমগ্র প্রকৃতির সঙ্গে তার সংঘবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা এবং তা উপেক্ষা করার হাতেগরম ফলাফল – করোনা অতিমারীর উৎপত্তি।

বর্তমান অতিমারী আসলে বেশ কিছু বিগতদিনের রোগের প্রাদুর্ভাবের ধারাবাহিকতা মাত্র। H1N1 ভাইরাল রোগের উৎপত্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শূকরশালা থেকে। নিপা (Nipah) ভাইরাস-জাত রোগের প্রাদুর্ভাব মালয়েশিয়ার শূকরশালা থেকে। মার্স (MERS) ভাইরাস এসেছে উটের মাংস থেকে। এখন প্রশ্ন হল, মাংস খাওয়াই কি রোগের কারণ? আমাদের দেশে নিরামিষ খাবারের প্রতি রাজনৈতিক অনুমোদনের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের নিবারণ আগে করা দরকার। উত্তর হল, ‘না’। বরং রোগের কারণ লুকিয়ে আছে বন্য পশুদের স্বাভাবিক চারণভূমির ক্ষয়, খামারের পশুদের প্রতি অবহেলাপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি এবং কোন মাংস কীভাবে খাচ্ছি তার উপর। এইরকম পরিস্থিতিতে মহামারী বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির নঞর্থক চরিত্রের ফলস্বরূপ উদ্ভূত দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং ক্ষতিকর সামাজিক অনুশীলনগুলি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে তথ্য থেকে সত্যে পৌঁছানো আজ সামাজিক দায়বদ্ধতা।  


পশুদের স্বাভাবিক চারণভূমির ক্ষয় 


বর্তমান নয়া-উদারবাদী বিশ্ব-অর্থনীতির চরিত্র হল সরকারি খরচ কমানো, বেসরকারি উদ্যোগগুলির বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন এবং শেয়ার বাজারের ফাটকা কারবার নির্ভরশীল নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দামের ওঠানামা। এই অর্থনীতিরই একটি বিশ্বজনীন অক্ষ হল কৃষিসামগ্রীর ব্যবসা বা অ্যাগ্রি-বিজনেস। এই ব্যবসাকেন্দ্রিক লক্ষ-কোটি টাকার বিনিয়োগ, খনিজ সম্পদ কিংবা মধু, কাঠ ইত্যাদির মত বন্যসামগ্রী নিষ্কাশনের নামে বনভূমি বিনষ্টের প্রকল্পগুলির সাথে জড়িত। তাছাড়া যত বনভূমি বিনষ্ট হবে, ততই বাকি অঞ্চলটুকুও বিনষ্ট করার প্রবণতা বাড়ে – একে বলে ‘Lauderdale Paradox’। জঙ্গলের মধ্যে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদের নিজস্ব পারস্পরিক বাস্তুতান্ত্রিক বা ইকোলজিক্যাল সম্পর্কের দরুণ তাদের মধ্যেকার রোগজীবাণু বনাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বনভূমির ক্ষয়ের সাথে সাথে জীবাণুগুলির বন্যপ্রাণী বা উদ্ভিদের দেহ থেকে গ্রাম বা শহরাঞ্চলের পশু ও মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘Spill Over’। কঙ্গোর নিজস্ব বনজসম্পদ উৎপাদনের কৃষিব্যবস্থাপনার (Agroforestry) জায়গায় নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির প্রবেশ ও বনভূমির পরিকল্পনামাফিক ক্ষয়সাধন ইবোলা মহামারীর উৎপত্তির প্রধান কারণ। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশে অ্যাগ্রো-ফরেস্ট্রির জায়গায় নিবিড় কারখানাভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনার (Intensive factory farming) উন্মেষ বনাঞ্চল ক্ষয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে। এতে বন্য বাদুড়রা কৃষি-অঞ্চলে বাসা বাঁধতে বাধ্য হয় এবং মানুষ ও বাদুড়ের মধ্যে স্পর্শগত সংযোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাদুড়ের শরীরে লালিত বিভিন্ন ক্ষতিকর ভাইরাস মানুষের দেহে পৌঁছানোর পথ উন্মোচিত হতে শুরু করে। এভাবেই মানবসভ্যতার অভিধানে জায়গা করে নেয় ইবোলা। অন্যদিকে লক্ষ্যণীয়, বনাঞ্চল ক্ষয়ের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগের মূল কেন্দ্রগুলিই আজ করোনা অতিমারীর প্রধান উৎস। যেমন, হংকং, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি। এর সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলগুলি। যেমন, বিশ্ব উষ্ণায়নের দরুন মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে থাকায় প্রচন্ড ঠান্ডায় এতদিন নিষ্ক্রিয় থাকা জীবাণুদের জাগরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।    


খামারের পশুদের প্রতি অবহেলাপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি


১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘পশু খামার বিপ্লব’ শুরু হয়। নিবিড় কারখানাভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা এই বিপ্লবের মেরুদণ্ড। বর্তমান অর্থনীতির চাপে সমগ্র বিশ্বে এই ব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক কালে ভারত সরকারের আনা কৃষি বিলও এই বাস্তবায়নের জাতীয় নীল-নকশা। এই ব্যবস্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য কী? অল্প জায়গায় ঠেসাঠেসি করে প্রচুর খামারের পশুপাখিকে (যেমন, মুরগী, হাঁস, ছাগল, ভেড়া, গরু, মোষ, শূকর) আটকে রাখা এবং কিছু নির্দিষ্ট চরিত্রের চাহিদা মেনে (যেমন, মুরগির ক্ষেত্রে অতিবৃহৎ স্তন, শূকরের ক্ষেত্রে অতিপুষ্ট পেশী ইত্যাদি) খামারের সমস্ত প্রাণীদের জিনগত গঠন একইরকম রাখা। এর পরিণাম ভয়ানক। অল্প জায়গায় ঠেসে থাকার দরুন এই পশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও বিভিন্ন জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অন্যদিকে, এই প্রাণীদের জিনগত গঠন এক রাখার ফলে জীবাণুর সমগ্র খামারেই সংক্রমণ ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগে না। কার্যত, খামার বা মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণও বৃদ্ধি পায়। উল্লিখিত H1N1 কিংবা Nipah সংক্রমণের উৎপত্তি মার্কিন মডেলের পশু খামারগুলি থেকেই।     


কীসের মাংস কীভাবে খাচ্ছি? 


এই রঙিন উদারবাদ অচেনা বন্যখাদ্যকে উচ্চবিত্তের আলিশান খাদ্য পরিবেশনার অঙ্গ করে তুলেছে। যেমন, এক বিশেষ প্রজাতির হাঙর ‘Short-nose dogfish’-এর মাংস তাইওয়ানে চড়া দামে বিক্রি শুরু হয়েছে। উটপাখি, বাদুড়, কুমির, গন্ধগোকুল, শজারুর পাকস্থলীতে অর্ধেক হজম হওয়া বীজ বা বেরি চড়া দামে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। বন্যখাবারের ‘বাজার’-চাহিদা মেটাতে একদিকে গভীর বনে প্রবেশ করে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে অজানা জীবাণুর দ্বারা, অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারা এই অজানা বন্যখাদ্যের গুণাগুণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রাণীর দেহে বিভিন্ন জীবাণুর বাসা বাঁধার সম্ভাবনা পরীক্ষা না করেই তা খাবারের প্লেটে চড়া দামে সাজিয়ে অজানা সংক্রমণের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। 


উপসংহারের পরিবর্তে শপথের আর্জি 


বর্তমান করোনা অতিমারীর উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে বাদুড়কে, যদিও এবিষয়ে বিজ্ঞানী মহলে মতপার্থক্য রয়েছে। বর্তমান অতিমারী নিঃসন্দেহে একটি আর্থ-সামাজিক ও বাস্তুতান্ত্রিক সংকট। বিগতদিনের আঞ্চলিক মহামারীগুলির উৎস করোনার উৎপত্তির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে চাইলে, অতিমারীর ধারাবাহিকতা থেকে রেহাই পেতে চাইলে, আর্থ-সামাজিক সমাধানের দু’টি পথ ভাবা যায় – (১) হাতুড়ে বিদ্যাঃ বনভূমি ক্ষয় রোধ, নিবিড় কারখানা খামার ব্যবস্থাপনার বদলে খামারজাত পশুদের যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পূর্বে বন্য অজানা খাদ্য পরিত্যাগের একঘেয়ে স্লোগান; (২) প্রকৃত প্রতিষেধক ও শুশ্রূষাঃ নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির অবসান ঘটিয়ে সমাজ ও বাস্তুতন্ত্র সমন্বিত খেটে খাওয়া জনগণের অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা।



[ঋণস্বীকারঃ ‘Big Farms Make Big Flu’– Robert wallace]   




কভার হেড : Chronicle of a Pandemic Foretold

Andrea Renda / Rosa J. Castro


Ceps.eu ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উপরিউক্ত প্রবন্ধটি থেকে ছবিটি নেওয়া হয়েছে।

#bengali #Article #Science #Environment and ecosystem #H1N1 #Nipah #Mers #Lauderdale Paradox #Agroforestry #Intensive factory farming #Big Farms Make Big Flu’– Robert wallace

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

46

Unique Visitors

219570