ব্যক্তিত্ব

হাজারা সিং : স্বাধীনতা ও কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের এক অবহেলিত শহিদ

অলর্ক বড়াল Dec 31, 2022 at 6:01 am ব্যক্তিত্ব

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও তদপরবর্তী কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের ধারা। কর্মক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা ও অধিকারের জন্য সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি, অনশনকে কেন্দ্র করে নতুন আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। এই শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিহার, যেখানে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন ভগৎ সিংয়ের এককালের সঙ্গী, হাজারা সিং।

পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুরের হাজারা সিংয়ের প্রকৃত নাম ছিল বান্টা সিং। কিশোর বয়সেই তিনি ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৭-এর অক্টোবর মাসে যখন হোসিয়ারপুরে ‘কীর্তি কিষান পার্টি’র প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় তখন সেই সুযোগে হাজারা সিং স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কীর্তি লেহের-র সংগ্রামীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর, ভগৎ সিংয়ের ‘নওজওয়ান ভারত সভা’য় যোগদান করেন হাজারা।

১৯২৯-এ ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের গ্রেপ্তারির পর নওজওয়ান ভারত সভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে হাজারা সিংয়ের ঠাঁই হয় লাহোরের বর্স্তাল জেলে। তাতে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে তিনি ও তাঁর সমবয়সী নাবালক সংগ্রামীরা সেই জেলেই লুকিয়ে Civil and Military Gazette পড়তেন ও জেলের অন্দরেই ব্রিটিশবিরোধী প্রচার চালাতেন। ১৯৩২-এ মুক্তির পরই হাজারা ও সঙ্গীরা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থির করে ফেলেন, মাদ্রাজের তৎকালীন গভর্নর স্যার জর্জ ফ্রেডেরিক স্ট্যানলি-কে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের এক ভাড়া বাড়িতে বসেই। শুরু হয় অর্থসংগ্রহের কাজ। সংগৃহীত ছ’হাজার টাকা সমেত রামবিলাস শর্মা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলে, হাজারা সিং উটি ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে ডাকাতি করার ছক কষেন। পুলিশের ছদ্মবেশে হাজারা সিং তাঁর সঙ্গী শম্ভুনাথ আজাদ, খুশিরাম মেহতা, নিত্যানন্দ বৎস, বাচ্ছু লাল এবং গোবিন্দরাম বেহল ১৯৩৩-এর ২৮ এপ্রিল উটি ন্যাশনাল ব্যাংকে ডাকাতি করতে সফল হন। নিত্যানন্দ বৎস ও খুশিরাম মেহতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলেও আশি হাজার টাকা সমেত বাকিরা পালান।  কিন্তু ভাগ্যের লিখনে দুদিন পরে হাজারা সিংকেও গ্রেপ্তার হতে হয়।


জুলাই মাসে হাজারা সিংকে ব্যাংক ডাকাতির মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৯, ৩৯৫ ও ৩৯৭ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় এবং তাঁকে প্রথমে বেল্লারী জেলে ও পরে রাজামুন্ডরী জেলে পাঠানো হয়। রাজামুণ্ডরী জেল থেকে পালাতে সক্ষম হলেও ফের ১৯৩৪-এ তিনি গ্রেপ্তার হন, এবারে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় তাঁকে সাগরপাড়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে জেলবন্দী করতে। সেলুলার জেলে এসে কমিউনিস্ট ভাবধারার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। সেখানে হরেকৃষ্ণ কোঙারের ‘কমিউনিস্ট কন্সলিডেশন’-এ যোগ দেন হাজারা সিং। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে ধৃত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে করে তিনি ‘Veritable University of Freedom Fighters’ নামে এক স্টাডি সার্কেল গড়ে তোলেন। এভাবেই তিনি মার্কসীয় চিন্তাভাবনায় দীক্ষিত হন ও কমিউনিস্ট সাহিত্যের পাঠ নেন। ১৯৩৭-এ প্রায় ৪০০ রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে হাজারা সিং এক ঐতিহাসিক অনশন-ধর্মঘটে যোগ দেন, যার ফলশ্রুতিতে তাঁকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় এবং শাস্তি থেকে মুক্ত করা হয়। সেলুলার জেলে তাঁর সঙ্গী শ্যামদেব নারায়ণ ও প্রমথনাথ ঘোষ-কে তিনি কয়লাঞ্চল শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৩৮-এ এনারাই খনি শ্রমিকদের একজোট করে ঝরিয়া কয়লা শ্রমিক ইউনিয়ন (JCWU) গড়ে তোলেন, যার সভাপতি হন তৎকালীন কংগ্রেস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা আব্দুল বারী।


এ বিষয়ে ব্রিটিশদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে ঝরিয়ার কয়লাখনির বিদেশী মালিক সংস্থা Bird & Co. শ্রমিকদের ইউনিয়নকে মান্যতা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একইসময়ে ধানবাদের ভদ্রিচক কয়লাখনির শ্রমিকরা বেতনবৃদ্ধি, কর্মপরিস্থিতির সংস্কার, মালিকপক্ষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে সামিল হলে তাদের হয়ে নানাস্থানে প্রচার চালান হাজারা সিং, শেষপর্যন্ত তাঁর মধ্যস্থতায় শ্রমিকদের সকল দাবি গৃহীত হয়। ১৯৩৯-এ জামশেদপুরে শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো হয়ে ওঠে। আন্দোলনে গতি আনতে হোসিয়ারপুরের চক মাইদাস গ্রামে আয়োজিত কীর্তি কিষান পার্টির এক গোপন সভায থেকে পার্টির নেতা বাবা বুঝা সিং হাজারা-কে দায়িত্ব দেন জামশেদপুরে সংগঠন জোরদার করার। 

জামশেদপুরে এসে হাজারা সিং Indian Steel and Wire Products (ISWP) এর কর্মীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কর্মীদের ওপর অত্যাচার ও মালিকপক্ষ কর্তৃক বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেখানেও হাজারা সিংয়ের নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু হয়। কর্মীপ্রধান অমর সিংয়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ করলে ২৮ জুন, ১৯৩৮ এক শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়। আন্দোলনরত শ্রমিকদের বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখালে শ্রমিকরা কারখানার গেট অবরোধ করে দেন। কর্তৃপক্ষ কিছু শ্রমিককে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে হাজারা সিংয়ের নেতৃত্বে ধর্মঘটিরা লরির পথরোধ করে দেন। কোম্পানির মালিক বলদেব সিংয়ের নির্দেশে, কর্মীপ্রধান অমর সিং হাজারা সিংকে লরির নিচে পিষে দেওয়া হয়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আইনি প্রক্রিয়ায় সাজা হয়নি অভিযুক্ত অমর সিং ও বলদেব সিংয়ের। ১৯৩৯-এর অক্টোবর মাসে বিচার ঘোষণা হলে অভিযুক্তদের খুনের সাজার পরিবর্তে ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানোয় মৃত্যু’র দোষে সামান্য জরিমানা করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট যুক্তি দেন যে, হাজারা সিং প্রাক্তন জেলখাটা আসামী এবং তাঁর দেহের চোটগুলির ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাজানো গল্পের জোরে তাদের শাস্তি দেওয়া অনুচিত। হাজারা সিংয়ের শেষকৃত্যে সহস্র লোকের সমাগম হয়েছিল, ঘাটশিলায় সিংভূম জেলা কৃষক সভায় কৃষক নেতা সহজানন্দ সরস্বতী ঘোষণা করেন হাজারা সিং একজন শহিদ এবং পরবর্তী দিনের কৃষক আন্দোলন অনুপ্রেরণা তাঁর এই আত্মত্যাগ।


ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, হাজারা সিং আজও বেশিরভাগ মানুষের কাছে অপরিচিত। মৃত্যুর ৮৩ বছর পর জামশেদপুরেও বিস্মৃত তিনি। সে শহরে তাঁর নিদেনপক্ষে একটি ছোট্ট মূর্তিও নেই। নিয়তির আরও বড় ছলনা এই যে, তাঁর অন্যতম হত্যাকারী বলদেব সিংয়ের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে। 

...................... 

তথ্যসূত্র : 

Singh, Mukutdhari. Bhuli Bisri Kadiyan Vol. 2. 

Sidhu, Ajmer. From Ghadar to Naxalbari – Baba Bujha Singh, An Untold Story.

Yadav, C.S.P. Majdoor Aandolan Ka Itihas (Jamshedpur 1920-2000).

Simeon, Dilip. The Politics of Labour Under Late Colonialism.

Bahl, Vinay. Making of the Indian Working Class.

Dhoot, Naina Singh. The Political Memoir of an Indian Revolutionary.

Searchlight Magazine, 18th November, 1939.

চিত্রঋণ : The Hindu 

#Hazara Singh #Indian Revolutionary #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

88

Unique Visitors

219794