ব্যক্তিত্ব

গ্রুপ থিয়েটারই ধাত্রী, গ্রুপ থিয়েটারই মৃত্যুবাণ : স্মরণে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

টিম সিলি পয়েন্ট Sep 30, 2020 at 4:25 am ব্যক্তিত্ব

“প্রথমজনের মেধা বা প্যাশন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছিল এক দার্শনিক প্রজ্ঞা। দ্বিতীয়জন, প্রজ্ঞা বা প্যাশনের কিছু কমতি না হলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছিল তাঁর মেধা। আর তৃতীয়জন প্রজ্ঞা বা মেধায় ভরন্ত হলেও সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল তাঁর প্যাশন।… এই তিন চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য ওই তিন প্রধানের চর্চা এবং ব্যক্তিত্বের মুখ্য সূচক, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের নিয়তিও বটে।” ব্রাত্য বসু তাঁর ‘কোম্পানি থিয়েটার : নতুন শতাব্দীর বঙ্গ থিয়েটার বিষয়ক একটি প্রস্তাবনা বা ইস্তেহার’ নামক বহু-বিতর্কিত প্রবন্ধে বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের তিন জায়ান্টকে এভাবেই ব্যাখা করেছেন। এত অল্প কথায় এত নিখুঁত ব্যাখ্যা বোধহয় আর হয় না। প্যাশন। সংরাগ। এটাই শ্রেষ্ঠ শব্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝানোর জন্য। এই প্যাশনই পুরুলিয়ার ছেলেটিকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল খাস কলকাতায়। গণনাট্যের জল-হাওয়ায় নিজের শিকড় মোটা করে কলকাত্তাইয়া গ্রুপ থিয়েটারকে কামড়ে ধরেছিলেন যুবক অজিতেশ - “বাঘ যেভাবে শিকার ধরে”। বাবা-কাকাদের মুখে শুনেছি, পুরো স্টেজের স্পেসটা যেভাবে কভার করতেন, কিংবা পর্দায় এলে পুরো স্ক্রিনটাকে যেভাবে ‘খেয়ে ফেলতেন’, তাতে বাঘের কথাই মনে হত। রসিক কেউ কেউ বলতেন ‘অজিতেজ’। ১৯৩৩ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন তিনি। আজ বেঁচে থাকলে ৮৭ বছরে পা দিতেন।

পরিচালক হিসেবে সহজ ছিল না শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তের মতো নাট্যনির্মাতার সমকালে দাঁড়িয়ে নান্দীকারের জন্য একটা শক্ত মাটি তৈরি করা। এই দুই বিপ্রতীপ ধারার মাঝে সম্পূর্ণ আলাদা এক বিকল্প মধ্যপন্থা যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, তার ভিত ছিল দেশীয় প্রাকৃত নাট্যভাবনায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ওই প্রবল প্যাশন, ওই অফুরন্ত প্রাণশক্তি। সব মিলিয়ে প্রবাদের মতো হয়ে আছে শের আফগান, মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, তিনপয়সার পালা, ভালোমানুষের মতো প্রযোজনাগুলি। নিজে ভাষান্তর করেছেন বেশ কিছু বিদেশী নাটক। লিখেছেন ‘সওদাগরের নৌকা’, ‘হে সময় উত্তাল সময়’, ‘সেতুবন্ধন’ ইত্যাদি কিছু মৌলিক নাটকও। 

পয়সার জন্য সিনেমা করেছেন, যাত্রা করেছেন। করতে তো হবেই। গ্রুপ থিয়েটার তো আর্থিক স্বচ্ছলতা দিতে পারত না। আজও পারে না। তবে গ্রুপ থিয়েটারই অজিতেশের সাম্রাজ্য, তাঁর ধাত্রী। আবার গ্রুপ থিয়েটারই বোধহয় তাঁর মৃত্যুবাণ। নিজে থিয়েটারের হোলটাইমার হবেন বলে স্কুলে পড়ানোর চাকরি ছেড়েছিলেন। কিন্তু সে আশা তাঁর পূরণ হয়নি। এমনিতে গ্রুপ থিয়েটারের তিন মহারথীই এক আশ্চর্য ঐতিহাসিক হ্যামারশিয়ার শিকার, যার বীজ নিহিত ছিল গ্রুপ থিয়েটারের আর্থিক কাঠামোর মধ্যেই। জীবনের শেষদিকে এসে আসল অসুখটা ধরতে পেরেছিলেন অজিতেশ। ‘পেশাদার হতেই হবে’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি বলছেন, “গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে একটা চালাকি আছে। সেটাই মধ্যবিত্তের চালাকি। মনকে চোখ ঠারা এবং সত্যকে সত্য না বলা। এক ধরনের আপস মানতে মানতে এগিয়ে চলা, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে  ফুরিয়ে যাওয়া এবং অবশেষে হতাশা প্রচার করা।” অ্যামেচার শিল্পীর ছড়াছড়ি নিয়ে ভয়ানক বিরক্তি ছিল অজিতেশের। পূর্ণ সময়ের নাট্যকর্মীর সংখ্যা না বাড়লে বাংলা থিয়েটারের মুক্তি নেই। অথচ গ্রুপ থিয়েটারের মূল চরিত্রই এই বিষয়টার অন্তরায়। থিয়েটারে সেই অর্থে পয়সা নেই বলে মধ্যবিত্ত বাঙালি একে পেশা করার কথা ভাবে না। অথচ গ্রুপ থিয়েটার ব্যাপারটাই অফ দি মিডল ক্লাস, ফর দি মিডল ক্লাস, বাই দি মিডল ক্লাস। অজিতেশেরই উদ্যোগে ক্যালকাটা রেপার্টরি থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিল সমস্ত প্রধান নাট্যদল। কিন্তু বেশি আয়ু পায়নি সে উদ্যোগ। পেশাদারভাবে নিয়মিত অভিনয়ের জন্য রঙ্গনা ভাড়া নিয়ে পাঁচ বছর প্রাণপণে চালিয়েছিলেন। তারপর ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অজিতেশ অনেক চেষ্টার পর বুঝেছিলেন, এই অলাতচক্র থেকে বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের আসলে মুক্তি নেই। বারবার লিখেছেন এই খেদের কথা - “শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তের মধ্যে গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থাকা আজকাল একটা ফ্যাশানের অন্তর্গত, কারণ এতে বেশ গ্ল্যামার বাড়ে। যে শিল্পী ব্যবসায়িক মঞ্চে চাকরি করেন এবং পয়সা রোজগার করেন তাঁর কাজটাকে আদৌ সম্মান দেওয়া হয় না। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার মানেই একটা বাড়তি সম্মানের জায়গা। ... মধ্যবিত্ত জীবনে গ্রুপ থিয়েটারগুলি এক একটি ছোটোখাটো আনন্দ নিকেতন। তার মধ্যেই যতদিন রোজগারের চাপ না পড়ে ততদিন নিজেকে মেলে ধরা, আলোচনা করা এবং বাইরের থেকে টাকা- পয়সা যোগাড় করতে পারলে কমবেশি থিয়েটার চালিয়ে যাওয়া। এতে থিয়েটারের উন্নতি কীভাবে হবে, কতটা হবে সেটাই চিন্তার বিষয়।” কিছুতেই পুরোপুরি পেশাদার থিয়েটারওয়ালা হতে না পারাটা বাকি মহারথীদের মতো অজিতেশের ক্ষমতাকেও অবশ্যই খর্ব করেছিল। তাছাড়া ছিল নান্দীকারের অভ্যন্তরীণ ওঠা-পড়া। মহাকাব্যিক থিয়েটার-যাপন সত্ত্বেও দলের গোপন ফুটিফাটা অজিতেশকে জানিয়েছিল, ক্ষয়ের উৎসমুখগুলো রয়েছে এই গ্রুপ থিয়েটারের কাঠামোর মধ্যেই। অসুখের নাম মধ্যবিত্ত মানসিকতা। এরই অন্ধকার পেটের ভিতর অক্সিজেন পায় পরশ্রীকাতরতা, লবিবাজি, দলভাঙানি, কুৎসা। এরই গোপন কোনও কুঠুরি থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে আসে কপট ছুরি। ১৯৭৭-এ নান্দীকার ছেড়ে তিনি ‘নান্দীমুখ’ তৈরি করেন। সতেরো বছরের দল ছেড়ে বেরিয়ে আসার কার্যকারণ বা তার এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সে সব আলোচনার মতো পরিসর এখানে নেই। কিন্তু এটুকু নিয়ে কেউই ভিন্নমত রাখেন না যে, সব বুঝেও বুঝতে না চাওয়ার তীব্র এক অভিমান নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে - ১৯৮৩ সালে, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়েসে। আজও যে দুষ্টগ্রহ বাংলা থিয়েটারের সর্বাঙ্গে পচা ঘায়ের মতো ছড়িয়ে রয়েছে, তাকে বুঝতে গেলে অজিতেশের নাট্যচর্চার নিবিড় ঐতিহাসিক মূল্যায়ন দরকার।  

#Ajitesh Bandopadhyay #Theatre-maker #Theatre Director #Actor #Stage #Group Theatre #Nandikar #অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় #নান্দীকার #নান্দীমুখ #গ্রুপ থিয়েটার #গণনাট্য #টিম সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

215896