সহজ আলাপে ইস্কুলে জেন্ডার : স্কুলস্তরে সামাজিক লিঙ্গ ও লিঙ্গ-বৈষম্য চর্চার এপিঠ-ওপিঠ
বই- সহজ আলাপে ইস্কুলে জেন্ডার সম্পাদনা- শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, চান্দ্রেয়ী দে প্রকাশক- এবং আলাপপ্রচ্ছদের ছবি ও অলংকরণ- শ্রমণা দাস প্রচ্ছদ- কৌশিক আকী প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি, ২০২০
এ বিশ্বকে পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার মুখ থুবড়ে পড়েছে বহুদিন। তবু আজও কেউ কেউ লড়ে যান গোঁয়ারের মতো। লড়ে যান বলেই অন্ধকারের আদিগন্ত চাদর ছিঁড়ে মাঝেসাঝে আলো জ্বলে ওঠে এদিক-ওদিক। এই বই সেই নাছোড় লড়াইয়ের একটি অঙ্গ।
এখানে মোট ২৩টি নিবন্ধ রয়েছে। বেশিরভাগ লেখকই স্কুলশিক্ষক। ফলে তাঁদের একেবারে কাঁচা অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে এ বই তৈরি। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াকে যাঁরা সৃজনশীল বা মননশীল চর্চার একটা জায়গা হিসেবে দেখতে চান, তাঁদের অনেকের কাছেই ‘এবং আলাপ’ মোটামুটি পরিচিত একটা নাম। নবীন সমাজকর্মীদের এই গোষ্ঠী গত কয়েক বছর ধরেই স্কুলস্তরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নজরে পড়ার মতো কাজ করছেন, যার মধ্যে অন্যতম হল লিঙ্গভাবনা-চর্চা। স্কুলে স্কুলে এই নিয়ে তাঁরা সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি করেন। ‘এবং আলাপ’ নামের ব্লগ বা ওয়েবসাইটে এই নিয়ে নিয়মিত আপডেটও তাঁরা দেন। অফলাইন ও অনলাইন- দুরকম মাধ্যমেই এই বিষয় নিয়ে লেখালিখি বা আলোচনার একটা প্রশস্ত পরিসর তাঁরা তৈরি করতে পেরেছেন। নিজেদের এই চর্চা ও চর্চার অভিজ্ঞতাকেই এ বছর বইমেলায় দু মলাটে সাজিয়েছেন তাঁরা।
অনেকেই মনে করেন যে শুধুমাত্র কো-এডুকেশন স্কুলেই এই বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখা দরকার। অল বয়েজ বা অল গার্লস স্কুলের ক্ষেত্রে সেভাবে দরকার নেই। কারণ সেখানে সে অর্থে ‘কেলেঙ্কারি’-র সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শুধু এই আপাত ‘কেলেঙ্কারি’র মধ্যেই বিপদ সীমাবদ্ধ, এমন শিশুতোষ ভাবনা তাঁরাই ভাবেন, যাঁরা পড়ুয়াদের প্রতি আদতে কোনও দায় অনুভব করেন না। কিন্তু বয়েজ স্কুলে পড়া ছেলেটির বা গার্লস স্কুলে পড়া মেয়েটিরও তো বৃহত্তর সমাজ আছে। সেখানে প্রতিনিয়ত বিপরীত লিঙ্গের সহনাগরিকদের সংস্পর্শে না এসে তো তার উপায় নেই। ফলে সামাজিক লিঙ্গভাবনার বুনিয়াদ শুরু থেকেই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হবার সুযোগ না পেলে সেটা তার নিজের জন্যও মঙ্গলজনক নয়, তার চারপাশের বাকিদের জন্যও তীব্র অ-সুখের কারণ হতে পারে। একতাল মাটি থেকে কে শিব হয়ে উঠবে, আর কে বাঁদর- তার অনেকটাই নির্ভর করছে ছোট থেকে কে কতটা সহজভাবে সুস্থ একটা লিঙ্গ-ভাবনার আবহ পাচ্ছে, তার ওপর। সমস্ত দরজা হাট করে খুলে রেখে সামনে যৌন-গোঁয়ার্তুমির একটা পরদা ঝুলিয়ে রেখে যে তুমুল পরোক্ষ যৌন উস্কানি প্রতিনিয়ত আমাদের সংস্কৃতি দিয়ে চলেছে- তার সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে পারে ট্যাবু-বিহীন সুস্থ ভাবনাচিন্তার চর্চা।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে ভালনারেবল সম্পর্কগুলোর একটা। এটা এমন একটা সম্পর্ক যাকে সবসময় সরু সুতোর উপর দিয়ে বিপজ্জনকভাবে হাঁটতে হয়। শিক্ষকের কাজ শুধু তো ইনফরমেশন সাপ্লাই করা নয়, জীবনবোধও তারা শিখবে স্কুল থেকেই। হ্যাঁ, সবকিছুর শুরু পরিবারে, ঠিকই। কিন্তু স্কুলের আবহ পারিবারিক আবহের থেকে খুব একটা কম জরুরি না, কারণ এখানেই প্রথম একটা বিপুল নিরবচ্ছিন্ন যৌথতার মধ্যে পরীক্ষায় বসতে হয় একটি শিশুর স্ফুটনোন্মুখ জীবনবোধকে। নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখে সে, চিনে নিতে চায়, ট্রায়াল-এরর চলে। ফলে স্কুলজীবন ভয়ানক জরুরি একটা সময়, আর শিক্ষকের ভূমিকা, বিশেষত নিচু ক্লাসে শিক্ষকের ভূমিকা এক্ষেত্রে একটা বিরাট বড় নির্ধারক হিসেবে কাজ করে।শিক্ষকের নিজের জীবনবোধ ও লিঙ্গ-ভাবনার প্রতিফলন তাঁর ক্লাসরুমে ঘটতে বাধ্য। তাই এই পেশার মানুষেরা এ বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন বা দায়িত্ববান না হলে, কিংবা নিজেরা লিঙ্গ-পক্ষপাতে আচ্ছন্ন হলে তার কু-প্রভাব শিক্ষার্থীদের মনে চিরস্থায়ী না হলেও দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলবেই। সবচেয়ে প্রয়োজনের জায়গা থেকেই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো উঠে আসতে শুরু করলে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। এই বইটি সেই সাধু চেষ্টাই করেছে। প্রথম নিবন্ধ ‘ছেলে হয়ে ওঠার প্রথম পাঠ’-এ শতাব্দী দাশ মূল বিষয়ের ম্যানিফেস্টো তৈরি করে দিয়েছেন। কীভাবে চারপাশের সচেতন বা অ-সচেতন ষড়যন্ত্রে শিশুমনে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’-র ভয়াবহ বিষ ঢুকে যায়, তা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। প্রাঞ্জল ভাষায় প্রায় টেক্সট বইয়ের কায়দায় বুঝিয়ে লিখেছেন বিষয়গুলো- “টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি হল ‘পৌরুষ’-এর এমন এক সংকীর্ণ ধারণা, যা ‘পৌরুষ’-কে হিংসাত্মক কার্যাবলি, যৌনক্ষুধাসর্বস্বতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, অনুভূতিশূন্যতা এবং (ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোয়) আর্থ-সামাজিক কৌলীন্য দিয়ে সূচিত করে। এ হল পুরুষত্বের এমন এক সাংস্কৃতিক ধারণা, যেখানে শক্তিপ্রদর্শন ও কর্তৃত্বই কেন্দ্রীয় ‘গুণ’। আবেগ, অনুভূতির যে-কোনো প্রকাশ এই সংস্কৃতিতে পুরুষের ‘দুর্বলতা’ বা প্রকারান্তরে ‘মেয়েলি’…”। তাঁর কথায়, “ছেলেদের জানানো প্রয়োজন কীভাবে তারা নিজেরাও নির্যাতিত।… ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠার যে ষড় তার চারপাশে, তা থেকে তাকে মুক্ত করা দরকার।” এই সময়ের মানবীবিদ্যা-চর্চায় ক্রমশই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠছেন শতাব্দী। তাঁর আরও একটি নিবন্ধ রয়েছে এখানে। এছাড়া জিনাত রেহেনা ইসলাম, শ্রমণা দাস, বিদিশা ঘোষ, সুমিতা বীথি, রংগন চক্রবর্তী প্রমুখের নিবন্ধগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা তুলে ধরেছে, যা মননশীল পাঠককে আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করাতে বাধ্য।
বইয়ের মুখবন্ধে সম্পাদক জানিয়েছেন, “আমাদের আশা এই বই আগ্রহী শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজকর্মী, গবেষক ও শিক্ষানীতি-নির্ধারকদের মধ্যে আদানপ্রদানের একটা সেতু তৈরি করবে। স্কুলস্তরে জেন্ডার স্টিরিওটাইপ, পক্ষপাত ও বৈষম্য নিয়ে অনেক বেশি মানুষের মধ্যে কথাবার্তার সূচনা করবে এবং বদল আনতে সাহায্য করবে শিক্ষানীতিতে, সিলেবাসে ও পাঠ্য বইয়ে, বি.এড. ও অন্যান্য শিক্ষক-প্রশিক্ষণে এবং স্কুল চত্বরে।” ভালো লাগে এই চেষ্টা দেখে। আমাদের সন্ততিরা ভালো নেই। তার অনেকটা দায় আমাদের। এ বই সেই দায়ের কথা মনে করাবে। আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করাবে আমাদের। আমরা দাঁড়াতে চাইব কি?
[ পোস্টারে আলোচ্য বইটির প্রচ্ছদ ব্যবহৃত হয়েছে ]
[ পোস্টার ভাবনা ও রূপায়ণে : অর্পণ দাস ]
#বই #বাংলা বই #বইয়ের খবর #লিঙ্গভাবনা #নারী #পুরুষ #কিশোর #কিশোরী #বালক #বালিকা #বিদ্যালয় #Book #Book Review #Bengali #Awareness #Gender Consciousness #এবং আলাপ #Ebong Alap #Toxic masculinity