পার্টির চোখরাঙানি দমিয়ে রাখতে পারেনি গাও জিংজিয়ানকে
বিশ শতকের অন্তিম বছরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী গাও জিংজিয়ানের জীবনকে বলা যেতে পারে মহাকাব্যিক। অশীতিপর এই লেখক একাধারে যেমন রচনা করে চলেছেন উপন্যাস, নাটক, সমালোচনা - তেমনি চিত্রশিল্পী ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ঈর্ষণীয়। বিতর্কের খোরাকও অবশ্য কম নেই। এই ব্যাপ্ত ও বৈচিত্র্যময় জীবনে গাও অনেক কাঁটাই পেয়েছেন। বেশিরভাগ বিড়ম্বনা উপহার দিয়েছে তাঁর সাধের কমিউনিস্ট পার্টি।
দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় চিনের ওয়াংঝু প্রদেশের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। কৈশোরের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে আকর্ষণ করে থিয়েটার। ব্রেশট, চেকভ, স্তানিশ্লাভস্কির চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হন। বেজিং-এ স্কুলে পড়াকালীনই ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার পাশাপাশি চলতে থাকে আঁকার চর্চাও। শিল্পচর্চার প্রথম পর্বে ছবি বিক্রির টাকাতেই তাঁদের সংসার চলতো।
বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে প্রায় এক দশক ধরে চলতে থাকা মাও জে দঙ -এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬-৭৬) তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হয়ে ওঠা লেখক যৌবনের এই সময়টাতে কৃষিকাজে যোগ দেন। বলাই বাহুল্য, ঠিক এরকম সময়ই তিনি প্রথম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। তাঁর জীবনে সে- প্রভাব এতটাই যে রেডগার্ড বিগ্রেডের তখন তিনি অন্যতম নেতা। অথচ জীবনে শিল্পের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যেই। এসময় তিনি লিখেছেন অজস্র নাটক ও প্রবন্ধ। কিন্তু নিজেই সেসব লেখার পরিণাম সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। ফলে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে প্রায় দু'দশক ধরে নিভৃত শিল্পচর্চার সমস্ত পাণ্ডুলিপি এক নিমেষে অগ্নিসংযোগে শেষ করে দেন। সেসবের কোনো চিহ্নই আজ আর অবশিষ্ট নেই। আসলে একদিকে শিল্পী সত্তা অন্যদিকে রাজনৈতিক মতাদর্শ - এই দুইয়ের বিরোধ তাঁর মনকে অস্থির করে তুলছিল। দুই মেরুকে তিনি মেলাতে পারছিলেন না।
১৯৮০র পর থেকে দ্রুতবেগে প্রকাশ পেতে থাকে গাওয়ের অজস্র নাটক, ছোটোগল্প ও অনুবাদ। গদ্য ও নাটকে পশ্চিমী চেতনাপ্রবাহের শৈলীকে কাউন্টার করে তিনি তুলে আনেন অন্যতর রীতি। প্লটহীন কাহিনির আধুনিক বুনোটে গড়ে উঠতে থাকে অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ-বাস্তবের আশ্চর্য মিশ্রণ। বর্ণনার মধ্যে অনায়াসে মিশে যেতে থাকে স্বপ্ন, কল্পনা ও আবেগ। ন্যারেটিভে তিনি বহুস্বর তৈরি করতে থাকেন।
১৯৮১ তে গাও চিনের বেজিং পিপলস আর্ট থিয়েটারের সঙ্গে নাটককার হিসেবে যুক্ত হন। এরপর বেকেটের 'Waiting for Godot' এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি লেখেন 'The Bus Stop' নাটক, পরের বছর 'The Absolute Signal'। ১৯৮৬-তে প্রকাশিত 'The Other Shore' উপন্যাসে গাও বলেন, ব্যক্তি কখনও ঈশ্বর কিংবা নির্বাণের মতো চরম সত্যে উপনীত হতে পারে না। এই বক্তব্যটি প্রতিক্রিয়াশীল ও কমিউনিজম- বিরোধী বলে সাব্যস্ত করা হয়। সমাজতন্ত্র বিরোধিতার অভিযোগে এই নাটক নিষিদ্ধ হয় সমগ্র চিন জুড়ে। এই প্রথম চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর মত-পার্থক্য জনসমক্ষে আসে।
নয়ের দশকের শুরু থেকেই প্রবল রাজনৈতিক চাপ আসতে থাকে শিল্পচর্চায়। কেউ পার্টি লাইন মেনে শিল্পচর্চা না করলেই তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা শুরু হয়। গাও সৃজনশীলতার ওপর এই খবরদারি মানতে পারেননি। ফলে অচিরেই তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের ওপর চাপে এক বছরের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। তাঁকে শ্রম -শিবিরে পাঠানোর পরিকল্পনা শুরু হয়৷ এমন অবস্থায় ১৯৮৬ সালে চিত্রচর্চার সুবাদে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখানকার নাগরিকত্বও নেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শেষ সুতোটুকু চিরতরে ছিঁড়ে যায় ১৯৮৯ সালে তিয়ান - আন- মেন স্কোয়ারে প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর সরকার হামলা করলে। এই ঘটনার পরই তিনি পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। ত্যাগ করেন চিনের নাগরিকত্বও। তবে দেশের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও আজও তিনি ফ্রান্সে বসে স্বদেশীয় ভাষাতেই লিখে চলেছেন। দশক-শেষের বছরে দ্বিতীয় চৈনিক সাহিত্যিক হিসেবে 'Soul Mountain'-এর জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ক্ষোভ উগড়ে দেয়। চিনা কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশ্বের দরবারে কলঙ্কিত করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। স্বদেশে ব্রাত্য এই শিল্পী আজও মনে করেন শিল্প ও সাহিত্যের অবস্থান হওয়া উচিত রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। আসলে মহাকালের বিচারে কিল মারার গোঁসাইরা তলিয়ে যান। থেকে যান গাওয়ের মতো সৎ শিল্পীরাই, যাঁরা কোনও মূল্যেই নিজের সৃষ্টির গলায় বকলশ পরাতে দেননি।
#গাও জিংজিয়ান #বিশ্বসাহিত্য #কুনাল দাস