বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জীবাশ্ম ও জীবন: ডাইনো ভ্রূণের চমকপ্রদ আবিষ্কার

অণ্বেষা সেনগুপ্ত July 12, 2022 at 2:54 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আজ থেকে বহু যুগ আগে আমাদের অজানা অচেনা এই পৃথিবীতে ডাইনোসররা প্রবল দাপটে রাজত্ব বিস্তার করেছিল। তা অনেকদিন আগেই সে রাজপাট চুকে গেলেও বহু প্রাচীন এই প্রাণিটিকে ঘিরে মানুষের কৌতূহলে কোনো ভাঁটা পড়েনি। তাই ইতিহাস থেকে বিজ্ঞানে একে নিয়ে ঘোরতর চর্চার পাশাপাশি বিনোদন জগতেও এর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এখন বিনোদনের প্রসঙ্গ উঠতেই আপনি হয়ত প্রবল উৎসাহে ‘জুরাসিক পার্ক’-এর কথা বলবেন আর আমি বাঙালি সেন্টিমেন্টে ‘চন্দ্রবিন্দু’কে আঁকড়ে আওড়াব, “আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে জাগাল ডাইনোসর!” আর তাই ডাইনোকে নিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি ঘোষণা খুব স্বাভাবিকভাবেই গোটা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে।

বর্তমানে দক্ষিণ চিনের Ganzhou শহরে theropoda group-এর একটি দন্তবিহীন ডাইনোসরের (অন্য নাম oviraptosaur বা oviraptoridae) “unhatched egg”-এর জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন গবেষকরা। আপাতত, মূল প্রতিবেদনের আগে বিশেষ কিছু খবরে চোখ রাখব আমরা; জানব ওভির‍্যাপটরিড (oviraptorid)-দের ব্যাপারে। ধরাবাঁধা গতের বাইরে কিছু theropod ডাইনোকে গঠনবৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নাম দেওয়া হয়েছিল ওভির‍্যাপটরিড। ভিন্ন আকৃতি, ঠোঁটের গড়ন এবং খাদ্যাভ্যাস – এসবের নিরিখে এরা সবাই আবার একই দলের সদস্য নয়; চিরকালীন দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ আছে সেখানেও। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক কালের পাখিদের মধ্যে টার্কির সঙ্গে ওভির‍্যাপটরিডদের নিম্নাঙ্গের মিল যেমন স্পষ্ট, ঠিক তেমনই ৮ ফুট লম্বা বৃহদাকার জাইগ্যান্টোর‍্যাপ্টর (Gigantoraptor)-রাও কিন্তু ওভির‍্যাপটরিডদেরই সদস্য। গোড়ায় সমাজে ডাইনোদের অন্যান্য গোষ্ঠীর ডিম চুরির অপবাদ ছিল ওভির‍্যাপটরিডদের ওপর। আসলে গবেষকরা প্রোটোসের‍্যাপ্টর (Protoceraptor) গোষ্ঠীর একটি ডাইনোর বাসার খুব কাছে ওভির‍্যাপটরিড গোষ্ঠীর একটি কঙ্কালের খোঁজ পান; গবেষণা থেকে পাওয়া এমন অকাট্য যুক্তিপ্রমাণকে এড়ায় কার সাধ্য? তাই, ‘ডিমচোর’ বা ‘Egg Snatcher’ নামের প্রচলন সেখান থেকেই। পরবর্তীকালে অবশ্য ঐ বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ডিমগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সামনে আসে একটি চমকপ্রদ তথ্য। জন্মপরিচয় প্রকাশ পায় একটি ভ্রূণের, জানা যায় ডিমের আসল দাবিদার ওভির‍্যাপটরিড গোষ্ঠীর সেই ডাইনোসরটি যার কঙ্কাল গবেষকরা পেয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা, নিজেরই সংসারে সযত্নে ডিমের দেখভালের দায়িত্ব পালনে হয়ত ব্যস্ত ছিল সে; আকস্মিক কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল তার।

না-ফোটা ডিমের ভিতর ওভির‍্যাপ্টর ভ্রূণ

এখন, টাইম মেশিনে চেপে অনেক বছর পিছিয়ে যাব আমরা। জানব ঠিক কি হয়েছিল সেইসময়ে। প্রায় ৬৬-৭২ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে যখন Cretaceous যুগ, এখনকার উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়া তখন ওভির‍্যাপটরিডদের দখলে। ঠিক এমন একটা সময়ে theropoda group-এর এক মহিলা ডাইনোসর জন্ম দিতে চলেছে তার পরবর্তী প্রজন্মের। কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! নির্ধারিত সময়ে, সেই ডিম গর্ভধারিণী মায়ের জরায়ু থেকে প্রকৃতি মায়ের কোল অবধি এতটা পথ অতিক্রম করলেও, আদতে কোনো মাকেই কাছে পাওয়া হল না তার। সম্ভবত, ভূমিধ্বসের মতো কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিচ্ছেদ ঘটায় মা ও তার ছানা ভ্রূণের। প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় ডিমের মধ্যে সুপ্ত ভ্রুণের প্রাণবায়ু নিঃশেষ হলেও সেই প্রকৃতিই কিন্তু এতকাল ধরে তাকে আগলে রেখেছে, আবিষ্কারের পরে গবেষকরা Yingliang Stone Nature History Museum-এর নামে তার নামকরণ করেছেন ‘Baby Yingliang’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মিউজিয়ামটিই Baby Yingliang-এর বর্তমান ঠিকানা। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক Fion Waisum Ma দাবি করেছেন, ডাইনোর এমন  সুন্দর ভ্রুণের হদিশ তাঁরা এর আগে কখনো পাননি। এখন মজার বিষয় হল, আশেপাশের সমবয়সী প্রজাতিদের ঘোড়দৌড়ে সর্বশ্রেষ্ঠের খেতাব যখন জুটেছে, তার মানে Baby Yingliang অবশ্যসম্ভাবী ইতিহাস ও বিজ্ঞান – এই দুই বিভাগেই হেব্বি পারফর্ম করেছে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক, Baby Yingliang-এর সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার রহস্যটা ঠিক কী! গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ১৭ সেন্টিমিটার লম্বা ডিমের মধ্যে ২৭ সেন্টিমিটার লম্বা Baby Yingliang এর বসে থাকার ধরনটা বেশ অন্যরকম; পিঠটাকে ডিমের ভোঁতা অংশের দিকে ভাঁজ করে, মাথাটাকে পায়ের মাঝে মুড়ে দিব্যি ঝিমোচ্ছে যেন। ডাইনোসরের বিভিন্ন প্রজাতির ভ্রূণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গবেষকরা দাবি করেছেন, ভ্রূণের এহেন দেহবিন্যাস তাঁরা ডাইনোসরের অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে লক্ষ করেননি, বরং সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন পাখিদের সঙ্গে। অতএব, Baby Yingliang এই পরিস্থিতিতে কোনো রকম সুযোগ হাতছাড়া করেনি, নিজেকে পূর্বসূরী হিসেবে দাবি করে রীতিমতো আত্মীয়তা পাতিয়েছে পক্ষীকুলের সঙ্গে। বিজ্ঞানের ভাষায় ভ্রূণের এমন অনন্য দেহভঙ্গিকে ‘Tucking’ বলা হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র। এই পদ্ধতিতে ডিমের মধ্যে থাকাকালীন ছানা পাখির ভ্রূণ তার ডানদিকের ডানা দিয়ে ছোট্টো মাথাটাকে আড়াল করে রাখে যাতে ঠোঁটের সাহায্যে ডিমের খোলস ভেদ করে জন্ম নেওয়ার সময় মাথায় কোনোরকম আঘাত না লাগে। আপাতদৃষ্টিতে শুনতে সহজ মনে হলেও বাস্তবে ধাঁধার থেকেও জটিল শরীরের কলকবজা, তা সে মানুষেরই হোক কিংবা পাখির। তাই tucking-এও সবসময়ে সাফল্যের হার একশো শতাংশ হয় না; বিপত্তি ঘটলে ছোট্ট ছানা পাখির আর আকাশে ওড়ার মন্ত্র শেখা হয় না, অকালেই মৃত্যু হয় তার। তাই, tucking যেন এক অর্থে নিজ নিজ প্রজন্মকে রক্ষা করার এক অনন্য কৌশল। পুরোপুরি মিল না থাকলেও tucking-এর কাছাকাছি একটা পদ্ধতি অনুসরণ করে আরও একটি প্রাণি – কুমির। বস্তুত, প্রাপ্তবয়স্ক কুমির ভয়ঙ্কর-দর্শন হলেও ভ্রুণাবস্থায় সে কিন্তু নেহাতই গোবেচারা; মাথাটা বুকে গোঁজা, বসার ধরনে নম্র ও বিনয়ী ভাব স্পষ্ট।

গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী অক্ষত অবস্থায় ডাইনোর ভ্রূণের হদিশ মেলা নিতান্তই বিরলতম ঘটনা। এমতাবস্থায়, এমন সুদর্শন, সুগঠিত, বিশেষত পূর্ণাঙ্গ একটি জীবাশ্মের খোঁজ পেয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা যারপরনাই আপ্লুত। তাঁদের ধারণা, বেঁচে থাকার চিরাচরিত লড়াইটা জিততে পারলে প্রাপ্তবয়স্ক ‘Baby Yingliang’ হয়ত প্রায় ২-৩ মিটার লম্বা হতো এবং খুব সম্ভবত যে কোনো তৃণভোজী প্রাণির মতোই সুখে ঘরকন্না করতো। তবে, Baby Yingliang-কে নিয়ে এখানেই গবেষণার শেষ নয়; বিজ্ঞানের আশীর্বাদে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা খুঁজবেন প্রশ্নের উত্তর। আমরা তাঁদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানানোর পাশাপাশি পরম স্নেহে Baby Yingliang-কেও কাছে টেনে নেব; নিজের অজান্তে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিলেও তার প্রথম আশ্রয়, তার পৃথিবীর জন্য সে রেখে গেছে মিসিং লিংকের চাবিকাঠি। 


#সিলি পয়েন্ট #বিজ্ঞান #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #ডাইনোসর #জীবাশ্ম #অণ্বেষা সেনগুপ্ত #বাংলা পোর্টাল #silly point #science # evolution # Anwesha Sengupta # dinosaur # fossil # webportal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107