বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিস্মৃত বাঙালি প্রসূতি-বিশারদ কেদারনাথ দাস

অর্পণ পাল April 5, 2022 at 10:58 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

উনিশ শতকের শেষ দিকের কথা। সে সময়ে গর্ভবতী মেয়েদের সন্তান প্রসব করানোর কাজটা মূলত করত দাই বা ধাত্রীরা, সেখানে পুরুষ ডাক্তারদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। অনেক মেয়েরাই হাসপাতালে আসতে চাইতেন না, পাছে পুরুষ ডাক্তারের সম্মুখীন হতে হয়, বাড়িতেই বেশিরভাগ প্রসবের কাজটা সম্পন্ন করে ফেলাই ছিল দস্তুর। অনিবার্য ভাবেই সন্তান প্রসবের সময়ে ঝুঁকি ও যন্ত্রণার পরিমাণ থাকত মাত্রাতিরিক্ত বেশি।

এই নিয়মে বদল ঘটাতে চাইলেন এক বাঙালি ডাক্তার। তাঁর প্রায়ই মনে হত কী করে এই গর্ভযন্ত্রণা কমানো যায়। অনেক ভেবে তিনি দেখলেন, প্রসব করানোর সময় আমাদের দেশের মেয়েদের জন্য যে ফরসেপ ব্যবহৃত হয়, তা পশ্চিমের দেশ থেকেই আনা, ওই ফরসেপের এ দেশের মেয়েদের জন্য ঠিক উপযোগী নয়। এমনিতে বাঙালিদের, বা বলা ভালো ভারতীয় মেয়েদের দেহের স্বাভাবিক আকার ইউরোপীয় মেয়েদের তুলনায় কিছু ছোট। এখানকার মেয়েদের উরুর মাপ ও দেশের মেয়েদের উরুর মাপের আট ভাগের সাত ভাগ, আর সদ্যজাত শিশুর ওজন ওসব দেশের শিশুদের ওজনের সাত ভাগের ছ-ভাগ। ডাক্তারবাবুটি দেখলেন, বিলেতে মেয়েদের প্রসবের জন্য ব্যবহৃত যে ফরসেপস, যেটাকে বলে সিম্পসন ফরসেপস, সেটা নিয়ে ভারতীয় মেয়েদের অপারেশন করাতে গেলে মূল সঙ্কট আসে যোনিপথে। তুলনায় আকারে বড় ওই ফরসেপস ঢোকানোর ফলে যোনিদ্বারে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হত, যা অনেক সময়েই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াত। 

কেদারনাথ দাস নামে ওই ডাক্তারবাবুটি, যিনি কর্মক্ষেত্রে কেডি দাস নামে পরিচিতি, এই ব্যবস্থাটাকেই পালটে দিতে চাইলেন। তিনি বিস্তর খেটেখুটে এক বিশেষ ফরসেপস তৈরি করলেন, যা আমাদের দেশের মেয়েদের পেলভিক কার্ভ আর শিশুদের মাথার মাপের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই ফরসেপসের নাম দেওয়া হয় ‘বেঙ্গল ফরসেপস’, যা যোনিপথে ঢুকিয়ে শিশুর মাথাকে ঘুরিয়ে এমন অবস্থায় আনা হয়, যাতে প্রসব করাতে অসুবিধা অনেক কম হয়। তাঁর এই আবিষ্কারের পর প্রসূতিমৃত্যুর হার অনেক কমে যায়। 

এছাড়া তিনি ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেন অ্যাক্সিস ট্র‍্যাকশন নামে এক ধরনের চিমটে আর ডাইলেটর। এটা পরে কে.ডি ডাইলেটর নামে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর তৈরি এই যন্ত্রগুলি ব্যবহৃত হতে শুরু হওয়ার পর দারুণ সাফল্য পায়। শুধু এই বেঙ্গল ফরসেপ আবিষ্কারের জন্য তাঁকে মনে রাখা উচিত প্রত্যেক বাঙালির, অথচ আজ তাঁর নামই জানি না আমাদের অনেকেই। এমনিতে উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের সূচনাকালে কলকাতায় বাঙালি চিকিৎসকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দারুণ খ্যাতি পেয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম আসে নীলরতন সরকার, কর্নেল সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা মহেন্দ্রলাল সরকারের নাম। আর এঁদের সঙ্গেই উচ্চারিত হওয়া উচিত কেদারনাথ দাসের নামও। 

জন্ম কলকাতায়, ১৮৬৭ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি। বাবা যাদবকৃষ্ণ দাস ছিলেন হিন্দু স্কুলের শিক্ষক। কেদারনাথও পড়েছিলেন এই স্কুলেই, এখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখান থেকে এফএ পাশ করে ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। পড়াশুনোয় তুখোর কেদারনাথ এখানে প্রায় সব পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকার করতেন, পেয়েছিলেন গুডিভ বৃত্তিসহ আরও নানা বৃত্তি।  

১৮৯২ সালে কেদারনাথ এম বি (ব্যাচেলর অফ মেডিসিন) পাশ করেন প্রথম স্থানে। ধাত্রীবিদ্যায় পেয়েছিলেন প্রথম স্থান। তখন এখানে প্রসূতিবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন কর্নেল সি এইচ জুইবার, তিনি কেদারনাথকে খুবই স্নেহ করতেন, একবার এক ইংরেজ মহিলা কর্নেল জুইবারের কাছে চিকিৎসার জন্য এলে তাঁকে জুইবার সাহেব কেদারনাথের কাছে যেতে বলেন। তিনি রাজি না হলে জুইবার সাহেব রেগে গিয়ে বলেন, আগে ডা: দাস দেখবেন তারপর প্রয়োজন হলে আমি দেখব। প্রসঙ্গত ধাত্রীবিদ্যায় কেদারনাথ পুরো নম্বর পেয়েছিলেন, যে রেকর্ড পরে আর কেউ ভাঙতে পারেনি।  

ডাক্তার জুইবারের অধীনেই কেদারনাথের কর্মজীবনের শুরু। ইডেন হাসপাতালে তিনি নিযুক্ত হন হাউস সার্জেন হিসেবে। এরপর ১৮৯২-১৮৯৯ সাল অবধি কেদারনাথ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত ছিলেন। তবে তাঁর কলকাতা থেকে এম ডি পাশ করার সৌভাগ্য হয়নি, কারণ তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম ছিল যে এখান থেকে বি এ পাশ না করলে এম ডি পরীক্ষায় বসা যাবে না। কেদারনাথ চলে গেলেন মাদ্রাজে, সেখান থেকে এম ডি হয়ে ফিরলেন ১৮৯৫ সালে এরপর ১৮৯৯ সালে  নিযুক্ত হলেন ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে (এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) প্রসূতিতন্ত্রের শিক্ষক হিসেবে। এখানে থাকার সময়েই বেঙ্গল ফরসেপের দৌলতে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম।  

১৯১৮ সাল অবধি তিনি এই হাসপাতালে কাজ করেছিলেন, তাঁর উদ্যোগে এখানে ধাত্রীবিদ্যা বিভাগটি সম্পূর্ণ নতুন করে সাজানো হয়। তখনকার ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রাশভারী শিক্ষক হিসেবে কলেজে সকলেই তাঁকে সমীহ করে চলতেন। এমনিতেই কেদারনাথ উচ্চতায় ছিলেন ছ-ফুটেরও বেশি, দারুণ চেহারা। হৃষ্টপুষ্ট এই মানুষটিকে সকলেই ভয় পেতেন, বিশেষ করে ছাত্রেরা। পড়াশুনোয় অবহেলা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। তাঁর কলেজের রেজাল্টও যে কারণে বেশ ভালোই হত। ক্যাম্পবেল স্কুল থেকে তাঁর অবসর নেওয়ার সময় সেখানকার ছাত্রেরা একটি বিদায় সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে, যেখানে তিনি বলেন – “আমি এতদিন এই ধারণা করে আসছিলাম যে যখন আমি ক্যাম্পবেল হাসপাতাল ছেড়ে যাব, ছাত্ররা তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। কিন্তু আজ তোমাদের আবেগময় বক্তৃতা শুনে আমার ভুল ভেঙেছে। আমার এই ভ্রান্ত ধারণার জন্য আমি নিজেকে অপরাধী মনে করছি। আমি তোমাদের প্রতি মাঝে মাঝে কর্কশ ব্যবহার করেছি সত্য, তবে তার কারণ একটাই। আমি চেয়েছি, যাতে তোমাদের মান উঁচু হয়। আলস্য, ঔদাসীন্য আমি বরদাস্ত করতে পারি না। আমি চেয়েছি, ক্যাম্পবেল স্কুলের ছাত্ররা চিকিৎসকদের কাছে এবং সমাজে যেন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠে”।

পড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন নিবন্ধ, যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যায়, তিনটি বইও লিখেছিলেন তিনি, ‘Handbook of Obstetrics’ (১৯১৪), ‘Textbook of Midwifery’ (১৯২০), ‘Obstetric Forceps’ (১৯২৮)। পেয়েছিলেন বেশ কিছু সম্মান, যেমন ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে লাভ করেন সিআইই, এরপর আরও পনেরো বছর পর ১৯৩৩ সালে পান ‘স্যার’ উপাধি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান কোটস পদক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তিনি, পরে ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের ডিনও হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে কেদারনাথ যোগ দেন কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে। বছর চারেক পরে এই কলেজেরই অধ্যক্ষ হন তিনি এবং আমৃত্যু সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৬ সালের ১৩ই মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। যাওয়ার আগে তিনি কলেজে দান করেছিলেন তাঁর সম্পূর্ণ বইয়ের সংগ্রহ এবং ষাট হাজার টাকা, সে আমলের নিরিখে যা নেহাত কম কিছু নয়! আপন প্রতিভার আলোয় মা ও শিশুদের জীবনে আশার সঞ্চার করলেন যে মানুষটি, কজনই বা তাঁকে মনে রেখেছি? 

..................


তথ্যসূত্র: চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালী, অরুণকুমার চক্রবর্তী। 


#সিলি পয়েন্ট #অর্পণ পাল #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি # বিজ্ঞান # কেদারনাথ দাস # বেঙ্গল ফরসেপ #silly point # science # medicine # Bengal Forceps

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

219143