বইয়ের খবর

চেনা পরিসরে অচেনার আতঙ্ক: এম.আর.জেমস-এর অলৌকিক গল্পের সংকলন ‘ছায়া কায়া ভয়’

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Aug 25, 2020 at 4:06 am বইয়ের খবর

অনুবাদ: রাজর্ষি গুপ্ত
প্রকাশক: ঋত প্রকাশন
মূল্য: ২৫০/-



১৮৩০ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সময়টিকে মোটামুটিভাবে ইংরেজি সাহিত্যে অলৌকিক গল্পের স্বর্ণযুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ভিক্টোরীয় যুগের শেষ থেকে রাজা এডওয়ার্ডের শাসনকাল অবধি বিস্তৃত কালটি অলৌকিক কাহিনীর বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য সমালোচক স্টিফেন আরাতার মতে, বুয়র যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক উত্থান, ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রীর ক্রমহ্রাসমান চাহিদা ইত্যাদি নানা কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশদের আত্মবিশ্বাস যথেষ্ট ধাক্কা খায়, এবং সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাদের মনে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধতে শুরু করে। মোটামুটিভাবে এই অনিশ্চয়তা দু’রকম আশঙ্কার জন্ম দেয়- প্রথমত, অতিরিক্ত আরামদায়ক শহুরে জীবনে অভ্যস্ত ইংরেজ জনগণ ক্রমশ দৈহিক ও মানসিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এক দুর্বল জাতিতে পরিণত হচ্ছে, এবং দ্বিতীয়ত, কোন বিদেশী শক্তি বা ব্রিটিশ উপনিবেশের কোন বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারী অতর্কিতে ইংল্যান্ডে হানা দিয়ে আক্রমণ করে বসতে পারে, যার মোকাবিলা এই দুর্বল মেরুদণ্ডহীন জাত করে উঠতে পারবে না। তৎকালীন একাধিক জনপ্রিয় গল্প উপন্যাসগুলিতে আমরা এই অনিশ্চয়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করতে পারি, যেমন উইলকি কলিন্সের দ্য মুনস্টোন (১৮৬৮), স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের দ্য সাইন অফ ফোর (১৮৯১) এবং ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা (১৮৯৭)। প্রতিটি কাহিনীতেই দেখা যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো সুদূর উপনিবেশ থেকে কোন অশুভ শক্তি হামলা করছে ইংল্যান্ডের মর্মস্থলে, চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে ইংরেজ জাতির জীবনে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যুক্তিবোধে কুশলী ব্রিটিশ সমাজের সভ্যতালব্ধ জ্ঞান এক্ষেত্রে কোন কাজেই লাগছে না, বেশিরভাগ সময়েই তারা অসহায় শিকার হচ্ছে এই অজানা, অলৌকিক আতঙ্কের। সাহিত্য সমালোচক প্যাট্রিক ব্র্যান্টলিঙ্গার ভিক্টোরীয় যুগের শেষভাগে রচিত হওয়া এই ধরণের রচনাগুলিকে ‘ইম্পিরিয়াল গথিক’ নামে অভিহিত করেছেন। মন্টেগু রোডস জেমস তাঁর অলৌকিক গল্পগুলিও রচনা করেছিলেন ভিক্টোরীয় যুগের অন্তিম লগ্নে। কেম্ব্রিজের কিংস কলেজের ছাত্র জেমস ছিলেন প্রাচীন ও ইউরোপীয় ভাষায় পণ্ডিত, এবং ধর্মতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর পরিবারে অ্যাংলিকান চার্চের বিরাট প্রভাব থাকলেও হয়তো বা যুগধর্মের কারণেই অতিলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ, যার প্রতিফলন দেখা যায় এই গল্পগুলিতে। গল্পের পটভূমি হিসেবে জেমসের পছন্দ জনকোলাহল থেকে দূরে কোনও পুরনো স্কুল-কলেজ-লাইব্রেরি বা গির্জার নিস্তরঙ্গ পরিমণ্ডল, উত্তর বা পশ্চিম ইউরোপের কোনও শান্ত শহরতলি অথবা ইংল্যান্ডেরই নিরীহ সাদামাঠা কোনও গ্রামাঞ্চল বা সমুদ্রতীর। এই পটভূমিতে প্রবেশ করেন একজন শান্তশিষ্ট গোবেচারা ভদ্রলোক, পড়াশোনায় (বিশেষত ইতিহাসে) তাঁর ঝোঁক। কৌতূহল বা লোভের বশে অথবা নিছক অবস্থাগতিকে তাঁর হাতে এসে পড়ে কোনও প্রাচীন বস্তু, যার অপব্যবহার ডেকে আনে অতীতকালের কোনও অভিশাপ, জাগিয়ে তোলে অলৌকিক হিংস্র সত্তাদের। চিরপরিচিত পটভূমিকায় অজানা কোনও অতিলৌকির ভয়ঙ্করের আবির্ভাবে সৃষ্টি হয় যে ‘আনক্যানি’ পরিস্থিতি, তাই হল জেমসের গল্পে ভয়ের প্রধান উপাদান। পাঁচটি গল্পের প্রথম ‘হৃদয়হারা’ (‘লস্ট হার্টস), যেখানে লিঙ্কনশায়ারের অ্যাসওয়ার্বি হলের মালিক মিঃ অ্যাবনি ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্যে অলৌকিক ক্ষমতা লাভের জন্য নাবালক ভাইপো স্টিফেনকে বলি দেবার পরিকল্পনা করেন। দ্বিতীয় গল্প ‘কাউন্ট ম্যাগনাস’, প্রৌঢ় মিঃ রক্সল সুইডেন ভ্রমণ করতে গিয়ে মুখোমুখি হন এক ভয়াবহ ঘটনার। ‘স্কুলের গল্প’ (‘আ স্কুল স্টোরি’)র বিষয়বস্তু জনৈক ইংরেজ ভদ্রলোকের লন্ডনের নিকটবর্তী স্কুলে পড়াকালীন এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। চতুর্থ গল্প ‘রুনের মন্ত্র’ (‘কাস্টিং দ্য রুনস্’)এ মিঃ কার্সওয়েল অপবিজ্ঞানের চর্চা করতে গিয়ে সর্বনাশের সম্মুখীন হন, এবং পঞ্চম গল্প ‘কৌতূহলী, সাবধান’ (‘আ ওয়ার্নিং টু দ্য কিউরিয়াস’)এ তিন ইংরেজ পর্যটক সিবরো নামক এক ছোট্ট শহরে গিয়ে শিকার হন প্রাচীন ইংল্যান্ডের এক অভিশাপের। রাজর্ষি গুপ্ত’র স্বচ্ছন্দ অনুবাদ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত তথ্যসমৃদ্ধ মুখবন্ধ এই বইয়ের সম্পদ। সাম্প্রতিক বাংলা বইয়ের বাজারে হরর সাহিত্যের যে জোয়ার এসেছে, ‘ছায়া কায়া ভয়’ তাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা রাখা যায়।
        
[প্রচ্ছদ সৌজন্য : রাজর্ষি গুপ্ত] 

#ছায়া কায়া ভয় #এম. আর. জেমস #অনুবাদ #রাজর্ষি গুপ্ত #অলৌকিক গল্প #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

8

Unique Visitors

219112