ভারতে আধুনিক বায়োকেমিস্ট্রির জনক : বীরেশচন্দ্র গুহ
এ দেশে বায়োকেমিস্ট্রি বা প্রাণ-রসায়নবিদ্যা চর্চার আদিপুরুষ তিনিই। তবে নিরলস বিজ্ঞানচর্চা শুধু না, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও জড়িয়ে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিভিন্ন সামাজিক কাজেও। ড. বীরেশচন্দ্র গুহ। এদেশের বিজ্ঞানের ছাত্ররা তাঁর নাম জানলেও, বৃহত্তর বাঙালির কাছে তিনি খুব পরিচিত নাম নন।
বীরেশচন্দ্র গুহর জন্ম ১৯০৪ সালের ৮ জুন, অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে। আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশালের বানারিপাড়ায়। বিখ্যাত বিপ্লবী অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন তাঁর মামা। ফলে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ একরকম তাঁর রক্তেই ছিল বলা যায়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বিএসসি পড়ার সময়ই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ার অপরাধে ১৯২১ সালে তিনি কলেজ হতে বিতাড়িত হন। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে থেকে ১৯২৩ সালে রসায়নে অনার্সসহ প্রথম স্থান অধিকার করে বিএসসি পাশ করেন।
১৯২৫ সালে এমএসসিতেও প্রথম হন। বৃত্তি পেয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হন। এমএসসি পাঠের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে আসেন। বীরেশবাবুর জীবনে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রভাব অনেকটাই। পড়াশোনা শেষে, এক বছর বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালসে কাজ করার পর বীরেশবাবু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে 'টাটা স্কলারশিপ' পেয়ে বিলেত যান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. এবং ডি.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ষাঁড়ের যকৃতের মধ্যে ভিটামিন বি-২ অনুসন্ধান। এরপর কেমব্রিজের বিখ্যাত প্রাণ-রসায়নবিদ এফ. সি. হপ্কিন্সের অধীনেও গবেষণা করেন। লন্ডনে পড়াশোনার সময় তিনি সাম্যবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরার পর কিছুদিন বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালসে কাজ করেন। পাশাপাশি 'লেবার পার্টি'-র সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগে প্রধান অধ্যাপকের পদ পান। উদ্ভিদকোশ থেকে `অ্যাস্করবীজেন` বিশ্লেষণে তিনি ও তার সহযোগীরা মৌলিক কৃতিত্ব দেখান। ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে ঘাস-পাতা থেকে প্রোটিন বিশ্লেষণের গবেষণা শুরু করেন এবং মানুষের খাদ্যে এই উদ্ভিজ্জ প্রোটিন মিশ্রণের নানা পদ্ধতি দেখান। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে খাদ্যদপ্তরের প্রধান টেকনিক্যাল উপদেষ্টাপদে নিযুক্ত করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের সভ্য হিসাবে কাজ করেন । ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং বাকি জীবন সেখানেই অধ্যাপনা ও গবেষণা করেন।
অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বা ভিটামিন সি নিয়ে গবেষণায় বীরেশচন্দ্র গুহ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমহলে একটি শ্রদ্ধার নাম। তাঁরই প্রয়াসে ভারতে প্রাণ-রসায়ন বিজ্ঞান ও জৈবপ্রযুক্তি বিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সে কারণে তাকে ভারতের 'আধুনিক প্রাণ-রসায়ন বিজ্ঞানের জনক' আখ্যা দেয়া হয়। ১৯৪৫ সালে ইউনেস্কো তৈরির সময় পৃথিবীর পাঁচজন মনীষীকে নিয়ে গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয় তাঁকে। সে-বছরই বিখ্যাত সমাজসেবিকা ড. ফুলরেণু দত্তকে তিনি বিয়ে করেন। ফুলরেণু দেবী নিজে বেশ কয়েক বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। পদ্মভূষণ পেয়েছিলেন। ডঃ গুহ ১৯৬২ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। দুর্ভাগ্যক্রমে সে-বছরই, ২০ শে মার্চ, ৫৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ফুলরেণু দেবী তাঁদের দুজনের সঞ্চিত অর্থ ও বালিগঞ্জের বিরাট বাড়িটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাণ-রসায়ন বিষয়ে গবেষণার জন্য দান করেন। বর্তমানে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের "The Guha Centre for Genetic Engineering and Biotechnology "(GCGEB)।
আরও পড়ুন:এই শতাব্দীর 'সেরা বইয়ের লেখক' : বিদায় নিলেন দু-বারের বুকারজয়ী হিলারি ম্যান্টল/ সুমনা ঘোষ
বীরেশবাবু এমন একজন মানুষ যিনি শুকনো বিদ্যাচর্চায় বিশ্বাস করেননি কোনোদিন। দেশের-দশের কল্যাণকে সবসময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
#বায়োকেমিস্ট্রি #বীরেশচন্দ্র গুহ #বিজ্ঞান #ভারত #ব্যাক্তিত্ব #সিলি পয়েন্ট