ফিচার

বন্দরে ফেরা হয়নি, চার শতাব্দী পেরিয়েও সমুদ্রে ভেসে চলে সেই ভৌতিক জাহাজ

শিরিন বসু June 7, 2022 at 6:52 am ফিচার

সমুদ্রের বুকে হঠাৎই নেমে এসেছে এক অলৌকিক কুয়াশা। যেন এই জাহাজটাকে ছোট্ট একটা খেলনার মতোই গিলে ফেলতে চায় সে। দিশেহারা নাবিকেরা। এক হাত দূরের কোনও মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। কম্পাসের কাঁটা কোন দিকে নির্দেশ করছে, বুঝতে পারছেন না অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। অতল জলরাশির মধ্যে অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছে জাহাজ।

এমনই সময়ে, জাহাজের ঠিক সামনে ভেসে উঠল একটা জমাটবাঁধা অন্ধকার। স্থির নয়, চলমান। দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে আসছে যেন এই জাহাজ লক্ষ্য করেই। ক্যাপ্টেনের হাতে উঠে এসেছে বুকে ঝোলানো ক্রসটা। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে সাধারণ নাবিকেরা। চাকরিতে যোগ দেওয়ার দিনটি থেকে তারা শুনে এসেছে, সমুদ্র যতটা মোহময়ী, ততখানিই ভয়ংকরী। খেয়ালিও। তার রাজ্যে মানুষের অনুপ্রবেশ সে মেনে নিয়েছে বটে, তবে ইচ্ছে হলেই যে কোনও দিন তাদের দিকে শাস্তির আঙুল তোলে সে। পথ ভুল করে জাহাজ, ধাক্কা খায় হিমশৈলে, কিংবা স্রেফ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় একদিন। সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেয় যেসব জাহাজ, তাদের সবার ভাগ্যে বন্দরে ফেরা ঘটে না। না, কেবল জাহাজডুবি নয়। সমুদ্রের মিথ বলে এমন অনেক জাহাজের কথা, যারা স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছে সমুদ্রের বুক থেকে। জাহাজের সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে তার ভিতরে থাকা মানুষেরাও। আর তাদের সমস্ত চাওয়া আর না-পাওয়ারা মিলেমিশে ঘনিয়ে তুলেছে এক রহস্যময় কুয়াশা, যার খোঁজ জানে কেবল সমুদ্রের নাবিকেরাই।

আর সেই কুয়াশাই যেন আজ ঘিরে ধরেছে এই জাহাজকে। আর সেই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে ওই অন্ধকার অবয়ব। আরও, আরও কাছে চলে এসেছে সে। এবার যেন আবছা দেখা যাচ্ছে, তার মাথায় তোলা পাল। মাস্তুল। সামনের ছুঁচলো অংশ। যাক, তাহলে অলৌকিক কিছু নয়। আরেকটা জাহাজই। নিশ্চয়ই পথ হারিয়েছে সেও। প্রাণপণে চিৎকার করতে থাকে নাবিকেরা। দুই জাহাজ এত কাছাকাছি, ধাক্কা লাগলে উভয়েরই সলিল সমাধি নিশ্চিত। কিন্তু, হঠাৎই যেন আবছা হয়ে এল রহস্যময় কুয়াশা। আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল আগন্তুক জাহাজের অবয়ব। এমনকি পড়া গেল তার গায়ে লেখা নামটিও। ‘ফ্লায়িং ডাচম্যান’! গুড গড! সভয়ে বুকে ক্রস আঁকলেন ক্যাপ্টেন। পাংশু হয়ে গিয়েছে নাবিকদের মুখও। নিজের বুকের লাবডুব বোধহয় শুনতে পাচ্ছে প্রত্যেকেই। এমন সময়েই, যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেভাবেই হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল সেই জাহাজ। আর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল এতক্ষণের কুয়াশাও।

১৮৩৫ সালে একটি ব্রিটিশ জাহাজের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছিল এই ঘটনার কথা। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা হয়েছিল, আচমকাই তাদের জাহাজের খুব কাছে ভেসে উঠেছিল সেই ভৌতিক জাহাজ। পাল তুলে পূর্ণ গতি নিয়ে সেই জাহাজ সরাসরি ছুটে আসছিল ব্রিটিশ জাহাজটির দিকে। দুই জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন হঠাৎ করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায় সেই জাহাজ।

‘ভৌতিক জাহাজ’ কেন? কারণ, এই প্রথম নয়। বারবার একাধিক জাহাজ জানিয়েছে একই ঘটনার কথা। যে জাহাজটি একদিন আচমকা হারিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের বুক থেকে, সেই সমুদ্রেই নাকি বারবার দেখা দিয়েছে সে। 

জাহাজের গোরস্থান বলা যেতে পারে ‘কেপ অফ গুড হোপ’-কে। সত্যি বলতে ‘গুড হোপ’ নামটাও পর্তুগিজ অভিযাত্রী বার্থেলোমিউ ডিয়াজের অবদান, নইলে আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘কেপ অফ স্টর্ম’। এই উপকূলের আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ডুবোপাথর। যে কোনও সময় তাতে ধাক্কা লেগে সলিলসমাধি ঘটতে পারে জাহাজের। আর এই অঞ্চল ঘিরেই শোনা যায় এক অদ্ভুত ভূতুড়ে গুজব। মাঝে মাঝেই নাবিকরা নাকি এখানে দেখতে পায় কয়েক শতাব্দী আগের একটি জাহাজকে, যার পরিণতি কী হয়েছিল কেউই জানে না। সেই জাহাজ নাকি এখনও অভিশপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায় সাগরের বুকে। কখনও ধাওয়া করে অন্য জাহাজকে, দিশেহারা জাহাজ ধাক্কা খায় ডুবোপাথরে। কখনও বা কোনও জাহাজের পাশে এসে চিঠি পাঠায় সেখানে। আর সেই চিঠির সঙ্গেই বয়ে আসে অভিশাপ। 

জাহাজটির নাম ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’। সময়টা, আন্দাজ করা যায় সতেরো শতক। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে অভিযানে বেরিয়েছিল ফ্লাইং ডাচম্যান। সিল্ক, রঞ্জক আর মশলা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল ঘেঁষে নিজের দেশ নেদারল্যান্ডের দিকে ফিরছিল সেই বাণিজ্যতরী। শোনা যায়, ফেরার পথে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছিল এই জাহাজ। জাহাজ তখন কেপ অব গুড হোপ-এর কাছাকাছি। একে প্রতিকূল আবহাওয়া, তার ওপর উপকূলবর্তী ডুবোপাথরের ভিড়, সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল জাহাজের নাবিকেরা। কিন্তু কিছুতেই জাহাজ থামাতে রাজি হননি ক্যাপ্টেন হেড্রিক ভ্যান ডের ডেকেন। এমনকি, নাবিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলেন ক্যাপ্টেন, এমনটাও শোনা যায়।

কিন্তু এরপর ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছিল, সে কথা আর কেউ বলতে পারে না। জাহাজের কোনও ধ্বংসাবশেষও মেলেনি। সমুদ্রের কিংবদন্তি বলে, দেবতার অভিশাপ নেমে এসেছিল এই জাহাজের উপর। যার জেরে নাকি পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত সমুদ্রের বুকে চলতেই থাকবে এই জাহাজ। পরবর্তী কালে নাবিকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই মিথ। জাহাজ বা উপকূল থেকে ফ্লাইং ডাচম্যান-কে দেখা গিয়েছে বলে দাবি করে একাধিক লোক। ১৭৯০ সালে নিজের বইয়ে এই জাহাজের উল্লেখ করেন জন ম্যাকডোনাল্ড নামে এক সমুদ্র-পর্যটক। রয়্যাল শিপ এইচ. এম. এস ব্যাশান্ট-এর ১৮৮১ সালের ১১ জুলাইয়ের লগবুকেও উল্লেখ রয়েছে এই ভূতুড়ে জাহাজের। অথচ সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়া তো দূর, আকাশে নাকি মেঘের লেশ মাত্র ছিল না। কিন্তু আশেপাশের অঞ্চলে তন্নতন্ন করে খুঁজেও সমুদ্রের বুকে হঠাৎ দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া জাহাজটির হদিশ পায়নি রয়্যাল শিপের নাবিকেরা। রয়্যাল শিপে তখন উপস্থিত ছিলেন খোদ প্রিন্স জর্জ, পরে পঞ্চম জর্জ নাম নিয়ে যিনি বসবেন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে। শোনা যায়, যে নাবিক মাস্তুল থেকে ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখতে পেয়েছিল, মাস্তুল থেকেই পিছলে পড়ে মারা যায় সে। কেবল জলের উপরে নয়, ফ্লায়িং ডাচম্যান নাকি দেখা দিয়েছে জলের তলাতেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক জার্মান সাবমেরিনও এই ভূতুড়ে জাহাজ দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেছিল।

এইসব কাহিনির কতটা ঘটনা আর কতটা রটনা, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, মরুভূমির মতোই, অকূল জলরাশির মধ্যেও মরীচিকা দেখা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই জাহাজকে দেখার পরে ঘটা দুর্ঘটনাও কি নেহাতই কাকতালীয়? ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজের পরিণতির মতোই সে উত্তরও অজানাই রয়ে গেছে। 


*******************************


#ফিচার #সিলি পয়েন্ট #জাহাজ #ভূত #শিরিন বসু #বাংলা পোর্টাল #ghost ship #Flying Dutchman #webportal #Shirin Basu #silly point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

219187