অনুবাদ

ইভলিন

মৌসুমী রায় Sep 13, 2020 at 6:55 am অনুবাদ

[মূল কাহিনি : জেমস জয়েস]


(পূর্ববর্তী কিস্তির পরে)

ফ্র্যাঙ্ক মানুষটা বেশ দয়ালু, পুরুষালি আর খোলামেলা ধরনের। ফ্র্যাঙ্কের হাত ধরে আজ রাতের জাহাজেই সে চলে যাচ্ছে সেই সুদূর বুয়েনোস আইরেসে। তারা বিয়ে করবে, দূরদেশে গিয়ে ঘর বাঁধবে, ঘরখানা যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করে আছে। 


তার পরিষ্কার মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে প্রথম দেখা হবার কথা। বড়রাস্তার ধারে এক বাড়িতে ফ্র্যাঙ্ক তখন থাকে। সেখানে তার যাওয়া-আসা ছিল। মনে হয় যেন কয়েক সপ্তাহ আগেকার ঘটনা। গেটের সামনে ফ্র্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে। তার ছুঁচোলো টুপিটা মাথার পিছন দিকে টেনে আটকানো আর চুলগুলো লটকে আছে রোদেপোড়া ব্রোঞ্জরঙা মুখের ওপরে। 


এরপরে দুজনের মধ্যে জানাশোনা হল। প্রত্যেক সন্ধেয় ফ্র্যাঙ্ক তার দোকানের সামনে দেখা করতে আসত। দুজনে একসঙ্গে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াত। একবার তো তাকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ‘দ্য বোহেমিয়ান গার্ল’ দেখিয়ে আনল। থিয়েটারের বেশ দামি জায়গায় তারা দুজনে বসেছিল, এতে ইভলিন খুশিতে গলে গিয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক গানবাজনা ভীষণ ভালোবাসে, একটু আধটু গাইতেও পারে।


লোকে জেনে গেছে যে তারা প্রেম করছে। আর তাই, ফ্র্যাঙ্ক যখন জাহাজির প্রেমে-পড়া ছুঁড়ির গান গেয়ে শোনায়, ভালো লাগার ঘোরে চলে যায় সে। ফ্র্যাঙ্ক তাকে ‘পপেন্স’ নামে ডেকে মজা পায়। প্রথম প্রথম তারও একজন প্রেমিক আছে, একথা ভেবে খুব শিহরন হত; পরে আস্তে আস্তে ফ্র্যাঙ্ককে তার ভালো লাগতে থাকে। ফ্র্যাঙ্ক তাকে কত দূরের দেশের গল্প শুনিয়েছে। তার জাহাজি জীবনের শুরুর মাসে এক পাউন্ড মজুরিতে ডেক-বয় হিসাবে অ্যালান লাইনের এক জাহাজে চেপে কানাডায় যাওয়া। ফ্র্যাঙ্ক তাকে কত শত জাহাজের নাম শোনাত, সেই সব জাহাজে চেপে, কত রকমের কাজ নিয়ে সে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছে! ম্যাগেলান প্রণালীতে ঘোরা, ভয়ংকর প্যাটাগনীয়দের কিসসা, এইসব শোনাত ইভলিনকে। ছেলেটা ঘুরেফিরে শেষে বুয়েনোস আইরেসে থিতু হয়েছে, আর এইবারে পূর্বপুরুষের দেশে বেড়াতে এসেছে।


বাবা একদিন তাদের এই প্রেমের খোঁজ পেয়ে গেল, মেয়েকে ভয় দেখিয়ে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করল।


বলল, "এইসব জাহাজিদের আমি খুব ভাল চিনি।" 


এরপরে একদিন নিজেই গিয়ে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ঝগড়া করে এল। তারপর থেকে তারা দুজনে লুকিয়েচুরিয়ে দেখা করত।




নজরে থাকুক


ইভলিনঃ প্রথম পর্ব




সামনের রাস্তায় অন্ধকার নামছে। ইভলিনের কোলে রাখা দুটো চিঠির সাদা অংশটা ক্রমশ অস্পষ্ট। একটা চিঠি হ্যারির জন্য, আরেকটা বাবার। আর্নেষ্ট ছিল তার প্রিয় দাদা, কিন্তু হ্যারিকেও সে ভালবাসে। বাবা আজকাল তাড়াতাড়ি কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে, ও খেয়াল করেছে। ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বাবার খুব অসুবিধে হবে। বাবা কিন্তু কখনও কখনও ওর সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করে। বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, শরীরটা সেদিন বিশেষ ভালো ছিল না ওর, সারাদিন শুয়ে থাকতে হয়েছিল। বাবা সেদিন ভূতের গল্প পড়ে শুনিয়েছিল। আবার রুটি সেঁকেও খাইয়েছিল। আরও একদিন, মা যখন বেঁচেছিল, ওরা দল বেঁধে সবাই মিলে হাউথের পাহাড়ে পিকনিক করতে গেছিল। বাবা মায়ের বনেটটা পরে ওদের হাসাচ্ছিল, ওর স্পষ্ট মনে পড়ে।


হাতে বেশি সময় নেই আর। তবুও সে জানলার আলসেতে বসে থাকে, পর্দায় হেলান দিয়ে বার্নিশের গন্ধ নিতে থাকে। গলির দূর প্রান্ত থেকে অর্গ্যানের মিঠে আওয়াজ কানে আসে তার। এ সুর তার চেনা। আশ্চর্য এই যে আজকের রাতে এই সুরটাই বাজছে। যে রাতে মা মারা যায় আর মৃত্যুশয্যায় মাকে কথা দেয় যদ্দিন পারে সংসারকে আগলে রাখবে সে, সেদিনও হলঘরের উল্টোদিকের অন্ধকার বদ্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ইতালির এই বিষণ্ণ সুর শুনতে পাচ্ছিল। অর্গ্যানবাদককে ছটা পেনি দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। বাবা খটখট করে হেঁটে মায়ের ঘরে ফিরে যাচ্ছিল আর বলছিল:  


“চুলোয় যাক ইতালিয়ানগুলো! দলে দলে আসছে!”


তার চোখের সামনে যখন হতভাগা মায়ের করুণ জীবননাট্য অভিনীত হতে থাকল; সেই অসহায়তার ঘোর যেন লেগে গেল ওর সমস্ত সত্তায় - অবিরত আত্মত্যাগ আর আত্মত্যাগ আর সবশেষের পরিণতি মাথাখারাপ। থরথর করে কেঁপে উঠল সে। কানের মধ্যে মায়ের অনর্গল বলে চলা কথাগুলো আজও যেন শুনতে পাচ্ছে: 


“দেরেভন সেরাওন! সুখের শেষে কী যন্ত্রণা!”


ভয়ের একটা আচমকা ঝটকায় ও দাঁড়িয়ে পড়ে। পালাতে হবে! তাকে পালাতেই হবে! ফ্র্যাঙ্ক তাকে বাঁচাবে। সে তার প্রাণ দেবে। হয়তো ভালোবাসাও। কিন্তু সে আগে বাঁচতে চায়। কেন সে শুধু কষ্টই করে যাবে? তারও তো সুখী হবার অধিকার আছে। ফ্র্যাঙ্কই পারে দুই বাহু দিয়ে আগলে রাখতে তাকে। তাকে বাঁচাতে পারে সেই-ই।




**   **        **   **          **    **




নর্থ ওয়ালের স্টেশনে থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে ইভলিন দাঁড়িয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক তার হাত ধরে কিছু বলে চলেছে বারেবারে। স্টেশনে বাদামি রঙের লটবহর নিয়ে ফৌজিদের ভিড়। ছাউনির চওড়া দরজা দিয়ে জেটিঘাটের গায়ে দাঁড়ানো বিশাল কালো জাহাজটা আর আলো-জ্বলা পোর্টহোলগুলো দেখতে পাচ্ছিল। সে কোনও উত্তর দিচ্ছিল না। তার গালদুটো ফ্যাকাসে আর ঠাণ্ডা। অজস্র দুশ্চিন্তার ঘোরে সে প্রাণপণে ঈশ্বরকে ডেকে যাচ্ছে - পথনির্দেশ দিতে বলছে, স্থির করে দিতে বলছে তার কর্তব্য। জাহাজ থেকে একটা দীর্ঘ বিষণ্ণ ভোঁ বেজে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। আচ্ছা, আজ যদি চলেই যায় সে, কাল এইসময় ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে জাহাজে করে মাঝসমুদ্রে ভেসে চলেছে বুয়েনোস আইরেসের পথে। তাদের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ছেলেটা তার জন্যে এত কিছু করার পরে ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ইভলিনের সমস্ত সন্দেহ আর অস্বস্তিগুলো যেন বমির মতন তার শরীরে ঠেলে ঠেলে উঠছিল। তার ঠোঁটদুটো নড়ছিল বিড়বিড় করে। অর্থহীনভাবে।  


হঠাৎ বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পেটালো তার। টের পেল ছেলেটা হাত ধরে টানছে - 


“চলে এসো!”


সাতসমুদ্রের ঢেউ যেন বুকে আছড়ে পড়ে। ছেলেটা তাকে অগাধ জলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; ও তো তাকে ডুবিয়ে দেবে। মেয়েটা দু-হাত দিয়ে লোহার রেলিং চেপে ধরে থাকে। 


“চলে এসো!”


না! না! না! এ হয় না, এ অসম্ভব। বিবশ হয়ে রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সমুদ্রের অতল জলে ভাসতে ভাসতে তীব্র বেদনায় আর্তনাদ করে ওঠে।


“ইভলিন! ইভি!”  


ছেলেটা বাধা টপকে ফিরে আসে ইভলিনকে নিয়ে যেতে। কেউ একটা জাহাজের দিকে এগিয়ে যেতে আদেশ করে তাকে, কিন্তু সে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে ডেকেই যাচ্ছে। মেয়েটা অসহায় প্রাণীর মতন ফ্যাকাশে মুখে ছেলেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। সে দৃষ্টিতে না আছে প্রেম, না কোনও বিদায়-সম্ভাষণ, না পরিচিতির কোনও চিহ্ন! 


 






[জেমস জয়েস (১৮৮২- ১৯৪১) এর লেখা এই ছোটগল্পটি ১৯১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্প সংকলন “ডাবলিনারস” এর চতুর্থ গল্প। জয়েসের প্রথম যৌবনে ডাবলিন-বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই সংকলন।] 




[অলংকরণ ঋণ : Samantha Cheah]


#Eveline #James Joyce #story #english #translation #অনুবাদ #গল্প #মৌসুমী রায় #জেমস জয়েস #ইভলিন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

49

Unique Visitors

219198