অনুবাদ

ইভলিন

অনুবাদ: মৌসুমী রায় Sep 6, 2020 at 4:05 am অনুবাদ

[মূল গল্প: জেমস জয়েস]

(প্রথম কিস্তি)

জানলার আলসেতে বসে বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল ইভলিন। তখন সন্ধ্যা নামছে। মাথাটা জানলার পর্দায় হেলান দেওয়া। নাকে আসছে বার্নিশের সুবাস। ভীষণ ক্লান্তি পেয়ে বসেছে তাকে।

সামনের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা লোক গেল। গলির শেষ বাড়ির শেষ মানুষটাও তার ঘরে ফিরছে। শান-বাঁধানো ফুটপাথে পায়ের খটখট আওয়াজ শোনা গেল। তারপর নতুন লাল ইঁটের বাড়িগুলোর সামনের মোরামের রাস্তা দিয়ে মিলিয়ে গেল শব্দটা।

অনেকদিন আগে ওখানে একটা খেলার মাঠ ছিল। তারা যখন ছোট ছিল, পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে প্রতিদিন বিকেলবেলা খেলত। তারপরে বেলফাস্ট থেকে লোক এসে খালি জায়গাটা কিনে একখানা বাড়ি তুলে ফেলল – তাদের মতন ছোটছোট পাঁশুটেমার্কা বাড়ি নয়, রীতিমতন ঝকঝকে ছাদওয়ালা ইঁটের মস্ত কোঠা-বাড়ি।

গলির সব বাচ্চারাই খেলত সেখানে - ডেভিন, ওয়াটার্স, ডানস-বাড়ির ছেলেমেয়েরা, ছোট্ট খোঁড়া কিও, ইভলিন আর তার ভাইবোনেরা। বড়ভাই আর্নেষ্ট অবশ্য কখনও তাদের সঙ্গে খেলেনি, ততদিনে বেশ লায়েক হয়েছে সে। বাবা তার কাঁটাওয়ালা কালো ছপটি নিয়ে কতবার যে তাদের সেখানে পাকড়ে আনতে গেছে! তবে বেশিরভাগ সময়ে ছোট্ট কিও টের পেয়ে চিৎকার করে তাদের সজাগ করে দিত। তবুও বেশ আনন্দেই ছিল তারা। বাবা এতটা বিগড়ে যায়নি। তাছাড়া মা-ও বেঁচে ছিল। এসব আসলে বহুদিন আগেকার কথা। তারা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। মা আর নেই। টিজি ডানও মারা গেছে, আর ওয়াটার্সেরা ফিরে গেছে ইংল্যান্ডে। সবকিছু বদলে গিয়েছে। আর এই মুহূর্তে আর সবাইকার মতন সেও সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে। এই ঘর, এই বাড়ি - সব ছেড়ে… 

ঘর-বাড়ি! নিজের ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল মেয়েটা। এর সব খুঁটিনাটি তার এত চেনা, সেই কোন যুগ থেকে…বাড়ি ঝাড়পোঁছ করতে করতে সে সবসময়ে ভাবত কোথা থেকে আসে এত ধুলো? এবার থেকে হয়তো এইসব জিনিসপত্তর, যাদের থেকে আলাদা হওয়ার কথা সে স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি, আর কোনোদিন দেখতে পাবে না তাদের। এতবছর ধরে এসবের তদারক করেও এখনও অবধি হলদে হয়ে যাওয়া ছবিটার যাজকমশাইয়ের নাম জেনে উঠতে পারেনি সে। পূত মার্গারেট মেরি অ্যালাককের রঙিন ছবির পাশে ভাঙা হারমোনিয়ামের ওপরে ওটা টাঙানো থাকে। যখনই কাউকে সেটা দেখায়, বাবা আস্তে করে জানিয়ে দেয়,

“উনি এখন মেলবোর্ণে থাকেন।” 

মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে রাজি হয়ে গেছে। কাজটা কি ভাল হল? মনে মনে সে প্রশ্নটার দুটো দিক নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার করতে শুরু করে। এ বাড়িতে আর যাই হোক, পেটের ভাত আর মাথার উপরে ছাদ, দুটোই রয়েছে; আর আছে নিজের লোকজন যাদের সে জন্ম-ইস্তক আগাগোড়া জানে। কিন্তু এবাড়িতে তার হাড়ভাঙা খাটুনিরও অন্ত নেই, ঘরের সব কাজ, আবার বাইরেরও। আচ্ছা, যে দোকানে সে কাজ করে, ওরা কী বলবে যখন শুনবে যে সে একজনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে? হয়তো বলবে মেয়েটা বোকা। তার জায়গায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন কাজের লোক রাখবে। মিস গ্যাভান নিশ্চয়ই খুশি হবে। তাকে তো মোটেই দেখতে পারে না; বিশেষ করে লোকজন সামনে থাকলে, ইচ্ছে করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে, 

“মিস হিল, দেখতে পাচ্ছ না যে ভদ্রমহিলারা সব বসে আছেন?” 

“মুখটা ব্যাজার করে থেকো না তো মিস হিল।”

ওই দোকানটা ছাড়ার কথা ভাবতে মোটেই দুঃখ হচ্ছে না তার।

কিন্তু অজানা দূর দেশে তার নতুন সংসারে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। সে ঘরের গিন্নি হবে, লোকজন তাকে অন্য নজরে দেখবে। তার মায়ের মতন বাবার সব অত্যাচার মোটেই সে মুখ বুজে সহ্য করতে চায় না। তার বয়েস সবে উনিশ পেরিয়েছে, এখনই বাবার দুর্ব্যবহারের ভয়ে সে সবসময়ে সিঁটিয়ে থাকে সে। বাবার আচরণই তার আতঙ্কের কারণ। যখন তারা ছোট ছিল, বাবা তার দুই ভাই আর্নেষ্ট আর হ্যারিকে পিটিয়ে ক্ষান্ত দিত, মেয়ে বলে তাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে বাবা তাকেও ভয় দেখানো শুরু করে দিল। সবসময়ে বলে, মেয়েটার জন্য যা কিছু, তা নাকি তার মরা মায়ের কথা ভেবে করা। আর এখন তো তাকে আগলানোরও কেউ নেই। মা নেই। আর্নেষ্টও মারা গেছে। আরেক ভাই হ্যারি গির্জা সাজানোর কাজ নিয়ে পেটের ধান্দায় সারা দেশ ঘুরে বেড়ায় বছরভর। 


আরও পড়ূন


সেই এক ঘন্টা


বাবার দুর্ব্যবহারের সঙ্গে আছে টাকাপয়সা নিয়ে আকচাআকচি। তার সপ্তাহের পুরো আয়, মোটে সাত শিলিং, সেটাও বাবার হাতে তুলে দিতে হয়। হ্যারিও মাঝেমধ্যে টাকা পাঠায়। কিন্তু সমস্যা হল বাবার থেকে পয়সা আদায় করা। বাবা সবসময়ে বলতে থাকে তার মতো মাথামোটা মেয়ের হাতে কষ্টের রোজগার তুলে দিলেই সে নাকি উড়িয়ে দেবে; তাই তাকে টাকা-পয়সা দেবে না। বিশেষ করে শনিবারের রাতে এই নিয়ে অশান্তি চরমে উঠে যায়। ঝগড়াঝাঁটির শেষে আবার বাবা-ই তাকে টাকা দিয়ে রবিবারের খাবারটা কিনে আনতে বলে। শেষমেষ সেই তাকেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়তে হয় বাজারে। ছোট কালো চামড়ার পার্সটা শক্ত করে চেপে ধরে কনুই দিয়ে বাজারের ভিড় ঠেলে কেনাকাটা করে বেলাশেষে একরাশ বাজার নিয়ে ঘরে ফেরে। ঘরে ফিরেও বিস্তর কাজ। ঘরকন্নার কাজ, তার দায়িত্বে রাখা দুটো ছোট বাচ্চাকে খেতে দেওয়া, ইস্কুলে পাঠানো, তাদের সবকিছু তদারক করা, আরো কত কী! খাটুনির জীবন তার, খুব কঠিন খাটুনি, কিন্তু এসবই তো ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। এখন, একেবারে শেষ মুহূর্তে তার আবার মনে হচ্ছে, এই জীবনটা সত্যিই হয়তো অতটাও খারাপ ছিল না। 

মেয়েটার অন্য জীবন শুরু হতে চলেছে ফ্র্যাঙ্ককে ঘিরে। কেমন হবে সে ঘর-করা?


(আগামী কিস্তিতে সমাপ্য)  


[অলংকরণ ঋণ : Samantha Cheah] 

#Translation #Adaptation #অনুবাদ #James Joyce #মৌসুমী রায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

19

Unique Visitors

219127