মহামারি-উত্তর বাংলা থিয়েটার : সমস্যা ও সম্ভাবনা
চোখের সামনে একটা ছবি। পরাভবের। ভবিষ্যের ত্রাণ আছে কি না প্রশ্ন জেগে থাকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের পথে চলেছে সবকিছুই। আর কি তেমন স্বাভাবিক হবে কখনও? সবটুকু? নাকি স্বাভাবিকের বদলে যাওয়া সংজ্ঞায় বেঁধে নিতে হবে তারগুলো? কতটা সহজ হবে সেটা?
ভাবছেন অনেকেই। ভাবছেন নাট্যশিল্পীরাও। অনেকের মতো নাট্যশিল্পীরাও এই দীর্ঘ সময় কর্মহীন। থিয়েটারকে যাঁরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁদের যন্ত্রণা আরও অনেকটা বেশি-- তাঁদের মনোকষ্টের সঙ্গী অন্নকষ্ট। কাজেই, সকলেই প্রার্থনা করছেন দ্রুত মূলস্রোতে ফেরার। কিন্তু মূলস্রোতে আর ফেরা যাবে কি? নাকি করোনাপরিস্থিতি বদলে দেবে সমস্ত চেনা সমীকরণ? উত্তরে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, সময়ের মতো করেই গড়ে নিতে হবে নতুন ছক।
সেই নতুনের কাঠামো কেমন হবে তা পরের প্রশ্ন। প্রথম প্রয়োজন পর্যালোচনার। 'মা কী ছিলেন' থেকে 'মা কী হইয়াছেন' বুঝে নিতে না পারলে ভবিষ্যতের কাঠামো গড়ে তোলায় খামতি থেকে যাবে। তাই আজ নতুন ভাবনার অবকাশে প্রয়োজন নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনা।
বাংলা মঞ্চনাটক (সাধারণত, বাংলা থিয়েটার বলতে আমরা অধিকাংশই যা বুঝি) আজ সত্যি কতটা প্রাসঙ্গিক আমাদের জীবনে? অর্থাৎ, প্রায় তিনমাস থিয়েটারহীন জীবন কাটানো বাঙালি দর্শকমানস আজ কতটা অভাববোধে আক্রান্ত? সামান্যই অভাববোধ, নাকি আমফান-তাণ্ডবে ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎপরিষেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার যে অভাববোধ এ তারই সমতুল? শেষোক্ত অনুভূতি সত্যি হলে স্বর্গসুখ অনুভব করতেন যে-কোনো নাট্যশিল্পী। কিন্তু সত্যিই সাধারণ জীবনের সঙ্গে আজ কতটা লগ্ন আমাদের থিয়েটার? 'কলকেতার তলায়' থাকা সাধারণের কথা বহুদিন বাদ গেছে, হয়তো তালিকাভুক্তই হয়নি কখনও। তবে যাঁরা আজও ভিড় করেন শহর-শহরতলি বা মফসসলের প্রেক্ষাগৃহে, সেই মুষ্টিমেয় মানুষেরও জীবনলগ্ন হতে পেরেছে কি আমাদের থিয়েটার? যতটা লগ্ন হলে বিচ্ছেদের ক্ষত পীড়িত করে, ততটা? পারলে কেন প্রতি মুহূর্তে দর্শকসমাগম বিষয়ে হা-হুতাশ করতে শোনা যায় অধিকাংশ নাট্যদলকে? তাহলে কি থিয়েটার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তার প্রাণশক্তি থেকে, যে কালো কালো মাথাগুলো অন্ধকারের মধ্যে থেকে প্রেরণা জোগায় অভিনেতাকে?
প্রসেনিয়ামের আদলেই রয়েছে এই বিচ্ছিন্নতার কথা, যা আমরা গ্রহণ করেছি সাদরে। এই গ্রহণে কোথাও ভ্রান্তি নেই, ভ্রান্তি রয়েছে অধিকাংশকে বর্জনে, আর বর্জনের গরিমায়। শিল্প সর্বসাধারণের জন্য কি না, এ প্রশ্ন বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত। শিল্পকে 'পপুলার' করতে তরল বিনোদনের সুরা পরিবেশন যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনই মেধাচর্চার ভ্রান্ত মোহে আত্মসন্তুষ্টি আসলে আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। শিল্প নির্মাণে যেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন, তেমনই প্রস্তুতি প্রয়োজন তার আস্বাদনে, এ কথা সত্যি। তবে প্রস্তুতির অভাব কি শুধুই ভোক্তার? নাকি উভয় পক্ষেরই?
আমরা কিছু সরলীকৃত ভাবনায় বিশ্বাসী। তার মধ্যে একটি হল, বহুজনপ্রিয় বিকল্প মাধ্যমগুলি থিয়েটারবিমুখ করেছে মানুষকে। এ ভাবনা আমাদের কিছুটা দায়মুক্ত করে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, আমাদের থিয়েটার অনেকাংশে সময়ের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই গড়ে উঠছে না সেই কাঙ্ক্ষিত সংযোগ? অথচ একটা গোটা প্রজন্মের হাতের মুঠোয় ওয়েব সিরিজ। শুধু কি ঝাঁ-চকচকে বিনোদনই আসক্ত করছে? নিশ্চয়ই নয়। সারা পৃথিবীর অনেক অসামান্য কাজ এসে পৌঁছোচ্ছে অন্দরমহলে, যার বিষয়বস্তু, প্রয়োগনৈপুণ্য চমৎকৃত করছে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক কেন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নির্মাণ ওয়েবমুখী করেছে মানুষকে। পরবর্তী এপিসোড বা সিজন দেখে না ওঠা পর্যন্ত যে আগ্রহ, বা কোনও কারণে দেখতে না পারার যে অভাববোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বহু ওয়েব সিরিজ,তা কিন্তু নিছক চটুল বিনোদনের ছকে নয়, এ কথা মানবেন অনেকেই।
এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন এসে পড়বেই--আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সহজ কি না, থিয়েটারের আর্থিক দৈন্যে এমন প্রযোজনা সম্ভব কি না, এবং ওয়েবমুখী তো মূলত তরুণ প্রজন্ম, ইত্যাদি।প্রথমত, লড়াইটা আজ সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক, কাজেই বিশ্ববাজারের লড়াইকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং ভাবনায় আধুনিক হওয়া প্রয়োজন।দ্বিতীয়ত, অর্থের দৈন্য অনেকাংশেই ঢেকে দেওয়া যায় ভাবনার উৎকর্ষে। কিন্তু ভাবনার দৈন্য অর্থে তো ঢাকেই না, বরং আরো উৎকট হয়। বাংলা থিয়েটারে এমন অনেক প্রযোজনা হয়েছে এবং হচ্ছে, যা আন্দোলিত করতে পেরেছে সমাজকে। অর্থ যেখানে কোনও প্রতিবন্ধক হয়নি। যাঁরা তা পেরেছেন, পারছেন, তাঁরা আজও বিশিষ্ট। কিন্তু ব্যতিক্রমীর গৌরবে তো সমগ্রের গরিমা প্রকাশ পায় না।
আজ এই মহামারির দুঃসময়ে, সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিনে মানুষ আর আগের মতো ভিড় করবেন না সমস্ত ক্ষেত্রে, অনেক বিকল্পের মধ্যে একটি বেছে নেবেন ভেবেচিন্তে। ফলে, দর্শকসংকট হয়তো আরো বাড়বে। এই সংকট যে নতুন এমন নয়, তবে এমন সংকটে নতুন পথ আবিষ্কারের অনিবার্যতা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথোপকথনের অংশ উল্লেখ করছি -
"নিবারণবাবু আস্তে আস্তে বল্লেন,-- এইখানে যারা সাইকেল-রিকশ চালায় তারা এই গত ৩/৪ বৎসরের মধ্যে ভয়ঙ্কর বায়োস্কোপের পোকা হয়ে উঠেছে"।উত্তরে শম্ভু মিত্র বলেন, "কিন্তু সে সমস্ত তো মুনাফালোভী ব্যবসাদারদের কাণ্ড। রুচিকে বিকৃত করবার, মনকে হীন করবার একটা পাইকারী দরে আয়োজন।... অর্থাৎ এই বিকৃতরুচির পরিবেশনে অভ্যস্ত হয়ে শেষে এমন একদিন আসবে যেদিন সত্যকার শিল্পের, --(হঠাৎ একটু লজ্জিত হয়ে পালটে বললাম) মানে, শিল্পেরই কোনও আবেদন থাকবে না জনসাধারণের মনে। শিল্প থাকবেই না।" এর উত্তরে নিবারণ পণ্ডিতের বক্তব্যের সার শম্ভুবাবুর বয়ানে এরকম --"মানুষ থাকবে,সমাজ থাকবে, অথচ শিল্প থাকবে না!... আসলে মানুষের ভালোবাসাটা তো বুঝতে হবে, মানুষগুলোকে তো জানতে হবে।... যেটা তার ভালো লাগে সেটা অত সহজে উড়িয়ে দিলে মানুষটাকে চিনবেন কী ক'রে!... আপনার সুখ-দুঃখ যদি লোকের সুখ-দুঃখ হয় তবে আপনার কথা তারা শুনতে বাধ্য। তবু যদি না শোনে তাহ'লে আপনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও মিথ্যে আছে।"১
শেষ দুটি বাক্যেই যেন আসল সংকটটাকে চিহ্নিত করে দেওয়া আছে। একইসঙ্গে দেওয়া আছে একটা পথনির্দেশ।
তৃতীয়ত, তরুণ প্রজন্মই তো সমাজের মূল চালিকাশক্তি, অথচ এই মুহূর্তে বাংলা থিয়েটারের দর্শক হিসেবে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ কতখানি? এটা জানার জন্য কোনও জটিল সমীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যে ওয়েব সিরিজ আজ অনায়াসে পৌঁছে গেছে একটা প্রজন্মের কাছে, আসক্ত করেছে তাদের, থিয়েটার সেভাবে পারেনি তাদের হলমুখী করতে। কাজটা একেবারেই সহজ নয়, তবু বিকল্প ভাবনার সময় এখনই। ভাবার সময় যে, থিয়েটার কীভাবে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। তার মানে শুধুমাত্র চমক জাগিয়ে আসক্ত করা নয়, শূন্যগর্ভ চমক যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তারে অসমর্থ তা তো জানা। কিন্তু দীর্ঘলালিত সংস্কার যদি শুচিবায়ুগ্রস্ত করে তাহলে তা বদ্ধতাই নিয়ে আসে।
সেরকমই কিছু সংস্কার আজও রয়েছে নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ ও তার প্রচারের বিষয়ে। যেমন থিয়েটারের সঙ্গে আর্থিক সমৃদ্ধিকে যুক্ত করতে আজও আমাদের বাধে। অর্থকষ্টভোগই যেন আদর্শ নাট্যশিল্পীর কাম্য, অন্যথায় শিল্পের বিপর্যয়। আজ করোনা আবহে আমাদের ডিজিটাল মাধ্যমগুলিকেই বেছে নিতে হচ্ছে, হবেও। এক্ষেত্রেও অনেকেই আদর্শচ্যুতি দেখছেন হয়তো। অবশ্য তার বিপরীত প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে এটাই আশার কথা।
আলোচনার পরিসরে নিশ্চয় পথ/অঙ্গননাট্য এবং অন্তরঙ্গ নাট্যায়োজনের প্রসঙ্গ আসা উচিত ছিল, কিন্তু তার সমস্যা ও সম্ভাবনার প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন। এই স্বল্প পরিসরে তা সম্ভব নয়। যদিও এ কথা বলতেই হয়, অনেকেই প্রসেনিয়ামের সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা অনুধাবন করেই নতুন স্পেস খুঁজে নিতে চেয়েছেন এবং চাইছেন। তবে প্রতিটা ক্ষেত্রেই দর্শকের কাছে পৌঁছোনোটা জরুরি, জানান দেওয়া জরুরি প্রতিমুহূর্তে। আজ যেভাবে নাট্যমুহূর্তের ক্লিপিং, বা সম্পূর্ণ প্রযোজনাই পৌঁছে যাচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে, এর প্রসার ভবিষ্যৎকে প্রাণবন্তই করবে। আজ মহামারির সংকটে মুখোমুখি হতে না পেরে সোশ্যাল মিডিয়া যেভাবে সভাঘর হয়ে উঠল, যেখানে প্রবেশ সত্যিই অবাধ হল, বহু মানুষের ঘরে পৌঁছে গেল থিয়েটারের স্বর, এটা স্মরণ করা প্রয়োজন পরবর্তীতেও।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রযোজনার বলিষ্ঠতা-- নাটক থেকে নাট্য হয়ে ওঠার প্রতিটা স্তরে। উদাহরণ রয়েছেই অতীত এবং সাম্প্রতিকে। তবে, সে উদাহরণের ব্যতিক্রম থেকে নিয়ম হয়ে ওঠা প্রয়োজন। তাহলেই হয়তো আগামীতে আরও বেশি করে জীবনলগ্ন হয়ে উঠবে আমাদের থিয়েটার।
গ্রন্থসূত্র : সন্মার্গ-সপর্যা, শম্ভু মিত্র, বৈশাখ ১৪২০, পৃ. ২-৩
#নিবন্ধ #মহামারি #থিয়েটার #বাংলা থিয়েটার