পরিবেশ ও প্রাণচক্র

অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্র : হারম্যান ডালির তত্ত্ব

অনিন্দিতা দত্ত Sep 16, 2020 at 4:08 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

কোনও একটি দেশের লভ্য উপাদান বা resource-এর সঠিক বণ্টন এবং প্রয়োগের মাধ্যমে কীভাবে সর্বোচ্চ উৎপাদন ঘটানো সম্ভব, অর্থনীতি বিষয়টি তাই নিয়েই চর্চা করে। আর এই উপাদানগুলির প্রতিটিই পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত। সবকটি উপাদান পুনর্নবীকরণযোগ্য নয়। ফলে ধারাবাহিক ব্যবহারের কারণে এগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বাস্তুতন্ত্রের ওপর একটি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে - একথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ হারম্যান ডালি।

চিরাচরিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে প্রাণচক্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে, ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তিনিই প্রথম আশঙ্কার এই দিকটিতে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। পরিবেশ যে ক্রমেই নিজের স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে, তা অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই বিষয়টিকে ভরকেন্দ্রে রেখেই ডালির Ecological Economics এর তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে।  

১৯৬৭ সালে ড. ডালি ব্রাজিলের সিয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলে বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি রাচেল কারসন, পল এরলিখ প্রমুখ পরিবেশ-বিশেষজ্ঞদের কাজকর্ম নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁদের মূল বক্তব্যের সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে চাইছিলেন। ডালি দেখেছিলেন, অর্থনীতি যখন সম্প্রসারিত হয়, তখন তা হয় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের মূল্যে। ১৯৭০ সাল থেকে টানা এই সংক্রান্ত গবেষণায় লিপ্ত থেকেছেন ডালি। তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনও একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের ক্ষেত্রে পরিবেশের নিজস্ব নিয়মগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পরিবেশের উপাদানগুলিকে ব্যবহার করেই অর্থনীতিকে টিকে থাকতে হয় এবং হবে। কিন্তু তা বলে বাস্তুতন্ত্রকে নির্বিচারে দোহন করার মানসিকতা নিয়ে চললে অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র জীবজগতের জন্য সর্বনাশের দিন ঘনিয়ে আসবে। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সম্প্রসারণ বা growth বলতে পরিমাণগত বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চায় না, যা অপরিসীম দুর্ভোগের পথ প্রস্তুত করছে। এই দুর্ভোগ ডালির মতে বহুমাত্রিক। এর ফলে তৈরি হবে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং আন্তর্জাতিক বা অন্তর্দেশীয় অসম প্রতিযোগিতা; তৈরি হবে মারাত্মক মনোপলি। ক্রমশ নিঃশেষিত হয়ে আসা উৎপাদনের উপাদান নিয়ে যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হবে। অবশেষে চাষযোগ্য জমি, খাদ্য ও Energy সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন ডালি। 

বলা যেতে পারে, Sustainable Development-এর ধারণাটিকে আধুনিক অর্থনীতি-ভাবনার নিত্যসঙ্গী করে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। এই সুদীর্ঘ গবেষণা ডঃ ডালিকে বহু পুরস্কার এনে দিয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুইডেনের Right Livelihood Award-এর মতো কুলীন সম্মান। তাঁকে ‘Uneconomic Growth’ ধারণার প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয়, যা পরবর্তীকালে বহু অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ-বিশেষজ্ঞকে উদ্বুদ্ধ করেছে। 

১৯৮৯ সালে ডালি এবং জন বি. কব ‘Index of Sustainable Economic Welfare’ (ISEW) নামক সূচকটি তৈরি করেন। তাঁদের মতে, এই সূচকটি আর্থ-সামানিজ উন্নয়ন পরিমাপের ক্ষেত্রে Gross Domestic Product বা GDP-র চেয়ে অনেক বেশি উপযুক্ত। 

প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যাগুলি উন্মোচিত করার সঙ্গে সঙ্গে ডঃ ডালি তার সমাধানসূত্র বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছেন - 

প্রথমত, নবীকরণযোগ্য উপাদানগুলির দীর্ঘ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারের গতি নবীকরণের গতি অপেক্ষা বেশ খানিকটা কম হওয়া প্রয়োজন। 

দ্বিতীয়ত, নবীকরণ-অযোগ্য উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারের গতি সেই সমস্ত উপাদানের বিকল্প বা প্রতিস্থাপনযোগ্য উপাদান পাওয়ার গতির চেয়ে কম হওয়া জরুরি। 

তৃতীয়ত, দূষণ ও বর্জ্যপদার্থের নিঃসরণের হার সবসময় যথাসম্ভব কম মাত্রায় রাখা জরুরি। প্রকৃতি এমন এক ম্যাজিক যা নিজেই দূষণ বা বর্জ্যপদার্থকে শোষণ করে তাদের দূষণমুক্ত ও পুনর্ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলে। প্রকৃতির সেই স্বাভাবিক শোধন-প্রক্রিয়ার চেয়ে আমাদের দূষণের হার কম হওয়া প্রয়োজন। 

১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ডালি বিশ্বব্যাঙ্কের পরিবেশ-অর্থনীতিবিদ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনিই সম্ভবত বিশ্বব্যাঙ্কের একমাত্র আধিকারিক যিনি এই প্রতিষ্ঠানের নীতি ও কার্যক্রমে পরিবেশ বিষয়ে একটা সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যেই নীতিগত মতভেদের কারণেই তিনি পদত্যাগ করেন। পুঁজিমুখী নিয়মনীতির সঙ্গে কিছুতেই আপোস করেননি। বিদায়কালীন ভাষণে সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন কিছু অ্যান্টাসিড আর হজমির ব্যবস্থা করতে, “…to cure the combination of managerial flatulence and organizational constipation..।” 

বিশ্বব্যাঙ্কের নীতি পরিবর্তন করতে পারেননি, কিন্তু প্রতিবাদ রেখে গেছিলেন। অবশ্য হারম্যান ডালির সারাজীবনের গবেষণাই তো পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ।    


তথ্যসূত্র : ১) Ecological Economics and Sustainable Development/ Herman Daly

             ২) Grist Magazine এর বিভিন্ন সংখ্যা 

#Herman Daly #Environmentalist #Economist #Sustainable Development #Uneconomic Growth #Index of Sustainable Economic Welfare #World Bank #বাস্তুতান্ত্রিক-অর্থনীতি #পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন #Eco-Friendly #Ecological Economics #অনিন্দিতা দত্ত

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

77

Unique Visitors

182825