খেলা

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব: প্রতিস্পর্ধার শতবর্ষ

শিবাজী আইচ Aug 1, 2020 at 1:49 pm খেলা

গ্রিক পুরাণে আছে যে, প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন নিয়ে এসেছিলেন। সেই আগুন তিনি দিয়েছিলেন মানুষকে। তারপর দেবতার মুখাপেক্ষী মানুষ আগুনের লেলিহান শিখার উন্মত্ততাকে মুঠোবন্দী করল। জয় করল ভয়কে, জয় করল নিজের রিপুকে, নিজের ব্যর্থতাকে। দেবতা নির্ধারিত নিয়তি নামক এক মূঢ় আশীর্বাদের অন্ধত্বকে ভস্মীভূত করে সে নিজেই হয়ে উঠল নিজের ভাগ্যবিধাতা। আর প্রমিথিউস? জিউস তাঁকে রাখলেন বন্দী করে। কিন্তু তাঁর প্রদত্ত আগুন ছড়িয়ে পড়ল হাত থেকে হাত, দেশ থেকে দেশান্তরে। আজো সেই আগুনের প্রতীকি রূপ অলিম্পিকসের আসরে মশাল হয়ে জ্বলছে কয়েক হাজার বছর ধরে।

মশাল জ্বলে উঠল আবার। এই বাংলায়। ১৯২০ সালের ১ আগস্ট সেই আগুনের প্রতীক বুকে নিয়েই জন্ম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। তারপর গঙ্গায়-পদ্মায় অফুরন্ত জলাধারের সঙ্গে মিশে কেটে গেছে একশটা বছর। কখনও কাঁটাতারের দাগে তার পিঠ ছড়ে গেছে, কখনও ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা তার চোখ ঘন করে তুলেছে। কিন্তু তারপরেও আগুনে জেদের ফুলকি ফুটবলের আকার নিয়ে ছিটকে গিয়ে পড়েছে প্রতিপক্ষের জালে। প্রতিপক্ষ কোনো ফুটবল ক্লাব নয়—প্রতিপক্ষ এই বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের বঞ্চনা, অবহেলা, অবজ্ঞা, অপমানের এক মিলিত শক্তি। সেই সব কিছুর বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব জিতেছে। জিতেছে তার অদম্য জেদ, জিতেছে অসংখ্য মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা।

ঠিক একশ বছর আগের কলকাতা। শিল্প, রাজনীতি, সংস্কৃতির মতো ফুটবলেরও মক্কা হয়ে উঠছে আমাদের কল্লোলিনী। স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচ ক্রমশ ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। ১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাব গোরাদের খালি পায়ে হারিয়ে স্বাধীনতার লড়াইকে ফুটবলের মাঠেও নিয়ে এসেছে। তার কয়েক বছর পরে ১৯২০ সাল নাগাদ উত্তর কলকাতার বনেদি ঘরানার জোড়াবাগান ক্লাবে খেলতে এলেন পদ্মাপারের ‘বাঙাল’ যুবক শৈলেশ বসু। আদি কলকাত্তাইয়া মানুষদের কাছে ‘বাঙাল’-দের যে খুব কদর ছিল না, তা তৎকালীন সাহিত্যের পাতাতে চোখ রাখলেই জানা যাবে। একটা ম্যাচে হারের পর অন্যায় অভিযোগ আনা হলো দুই বাঙাল শৈলেশ বসু ও নসা সেনের বিরুদ্ধে। ময়মনসিংহের নাগপুরের জমিদার সুরেশ চৌধুরী সেই সময় জোড়াবাগান ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন। এই বৈষম্যমূলক অভিযোগের উত্তরে তিনি ঠিক করলেন এর বদলা নেবেন মাঠেই। তাঁর নেতৃত্ব ও আর্থিক সহায়তায় ১ আগস্ট কুমোরটুলির রায় পরিবারের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হলো ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। নামের প্রেরণায় এগিয়ে এলেন পূর্ববঙ্গের আরো কিছু স্বনামধন্য মানুষ। হোয়াইটওয়ে লেইডলে থেকে ৮০ টাকা দিয়ে প্রথম জার্সি কেনা হলো। রঙ? লাল-হলুদ! শুরু হলো ভারতবর্ষের অন্যতম সফল ফুটবল ক্লাবের গৌরবময় পদযাত্রা।

তারপর নানা উত্থান-পতনকে সঙ্গী করে চলতে চলতেই ১৯৪২ সালে প্রথমবার কলকাতা লিগ ও ১৯৪৩ সালে আই. এফ. এ শিল্ড জয় করল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। তারপর এলো এক বিরাট পালাবদল। এলো স্বাধীনতা, তারই সঙ্গে সঙ্গে এলো দেশভাগ। পূর্ববঙ্গ থেকে হাজারো হাজারো মানুষ নিঃস্ব হয়ে ভিড় জমালো কলকাতার বুকে। ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল হারিয়ে তাঁদের তখন একটাই পরিচয়—উদ্বাস্তু, রিফিউজি। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, রুচি, সংস্কৃতির তুলনামূলক ভিন্নতা এবং দেশীয় রাজনীতি-সমাজনীতির বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ এঁদেরকে করে তুলল প্রান্তিক মানব। শুরু হলো নিয়তির বিরুদ্ধে এক অসম লড়াই। পিঠে কাঁটাতারের দাগ আর বুকে অদম্য জেদ। এই তো মাত্র সম্বল। সেই লড়াইয়ে এই অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষকে মাতৃস্নেহ দিলো ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। জীবন সংগ্রামের এই জেদ আর সাহসই হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রাণবস্তু। এই ক্লাব তাঁদের আত্মপরিচয়ের রূপ। ক্লাব হয়ে উঠল ‘মা’।

কলকাতার উপর দিয়ে উড়ে গেল এক আগুনরাঙা ফিনিক্স পাখি। গঙ্গাবক্ষের জ্যোৎস্না মাখা আলোয় সে গা থেকে খসিয়ে ফেলল তার আগের জন্মের ছাই। সাদা-কালো শহরের কলোনিগুলিতে দ্রুত খবর পৌঁছে গেল। পাথরের বুক চিরে ফুটল লাল-হলুদ ফুল। সেই পাখি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে চক্কর মেরে ময়দানের এক কোণায় ডানা ছড়িয়ে বসল। তারপর? সময় যাচ্ছে, থিতু হচ্ছে মানুষ। প্রজন্ম বদলাচ্ছে, ঘুচছে উদ্বাস্তু পরিচয়। নিয়তির হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে মশালের আঁচে পুড়িয়ে নিজের মতো ছাঁচ বানিয়ে নিচ্ছে সে। সেই মশাল এগিয়ে চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রতিস্পর্ধার মশাল, আবেগের মশাল, জিদের মশাল। সে ভুলতে পারে না দেশ-কাল-সমাজের একটা বিরাট ইতিহাস আজও তার কাঁটাতার চেরা রক্তের ভিতরে খেলা করে। হোক না তা ফুটবলের জন্য, হোক না তা ম্যাচের দিনগুলোর জন্য। সেই পাখিটা আবার সেদিন ডানা ঝাপটায়, নিভন্ত মশালে আবার পুরে দেয় ‘বাঙালত্বের’ আগুন। আগুনে ইস্টবেঙ্গল মাঠে নামে।

ছিন্নমূল বাঙালির আকাশছোঁয়ার সেই স্পর্ধার আজ একশ বছর। অথচ, এবছরই সবচেয়ে বিশৃঙ্খল দেখাচ্ছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে। ভারতীয় ফুটবলের ‘আধুনিকীকরণ’-এর সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা, ক্লাব পরিচালনা নিয়ে সমর্থকদের উষ্মা, জাতীয় ফুটবল ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েই শতবর্ষ উদযাপন চলছে। তারপরেও তো ক্লাবটার নাম ইস্টবেঙ্গল। সে তো শুধু ক্লাব নয়, সে একটা রূপকথা। সে হার-না-মানা মানুষের বিশ্বাসের প্রতীক। সে সব হারানো মানুষের দাবানলের নাম। সে ভেঙে পড়া মানুষের মেরুদণ্ডের দৃঢ়তা। সে নব্বই মিনিটের চতুষ্কোণের বাইরে লক্ষ লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা। একদিন ফের ময়দানের উপরে জমে থাকা কালো মেঘের গুরু গর্জনকে ছাপিয়ে ফের শোনা যাবে আগুনে ডানার শব্দ। আগুনপাখি জাগবে। এসপ্ল্যানেডের ব্যস্ত ফুটপাথ থেকে, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণের পাশ দিয়ে বাইপাসের ছুটন্ত গাড়ির কাচের ওপাশ থেকে দেখা যাবে তাকে। সমগ্র ভারতবর্ষ দেখবে। দেখবে যে ইস্টবেঙ্গল ‘একাই একশো’!



পোস্টার ডিজাইন : লেখক

#খেলা #ইস্টবেঙ্গল #শতবর্ষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107