ফেলে আসা মেগাহার্টজ : ‘তুমি আছো ঘুম ঘোরে’
১৫ ই মে। সোমবার। সোমবারীয় শ্রান্তি কাটাতে কলকাতায় হয়ে গেছ কালবোশেখী। এমনই এক ঝোড়ো দিনে দেখা গেল, ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনির প্রযোজনা, ‘ফেলে আসা মেগাহার্টজ’। একটা কালো অন্ধকার ঘরে টিমটিমে আলোয় কিছু মাথা বসে আছে। মশারির ভিতর সাদা চাদরে ঢাকা মৃত মানুষের মতো শুয়ে অভিনেতা। গল্পটা সেই মৃত মানুষের। তাকেই নিয়েই এক ঘন্টা বিশ মিনিটে আসর বসিয়েছে ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনি। ভাস্কর মুখার্জীর গভীর রিসার্চ চালিয়ে মৌলিক স্ক্রিপ্ট বোনা প্রথমেই আকর্ষণ করে। শুরুর পাঁচ সাত মিনিটে ভয় হচ্ছিল তথ্যের ভারটা বেশি হয়ে না যায়, কিন্তু সেই ভয় অমূলক। রাজু,অলীক, রিমিল, অর্ক, সৌম্যরা দক্ষতায় সামলেছে সংলাপকে। কিন্তু এই নাট্য যত না সংলাপ প্রধান, তার থেকে বেশি সঙ্গীত প্রধান। রেডিওর বিবর্তন ও একটি জীবনের বিবর্তন আখ্যানে মিশে গেছে। সেই মিলমিশ প্রগাঢ় হয়, সঙ্গীত নির্বাচনে। সময়ের পথ ধরে ভারতের মানুষের পালটে যাওয়া পছন্দের গানকে বহন করে নিয়ে চলেছে রেডিও। এখনও কিছু বাড়িতে রেডিও বাজে। চাষীরা এখনও কৃষিঋণের খবর পায় রেডিওয়, জেলেরা রেডিওতে মাছ ধরতে যাওয়ার সতর্কতাও শোনে, সেলুনে অক্লান্ত কাঁচির আওয়াজে মিশে যায় রেডিওর ধুন। কিন্তু আমাদের ঝলমলে নাগরিক জীবনের আলোয় রেডিও বেশ সেকেলে। এক্ষেত্রে আখ্যানটিও আক্ষরিক অর্থেই সেকেলে। নাটকের গল্প যেখানে শেষ হয় সেখানে বর্তমানের শুরু। ফ্ল্যাশব্যাকের ক্লিশে ব্যবহারও মনোরঞ্জক হয়ে ওঠে অভিনেতাদলের এনার্জিতে। তবে এই নাট্য ইন্টিমেট স্পেসে দেখার অভিজ্ঞতা ও মঞ্চে দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় এক হবে না। যদিও ১৫ ই মে ২০২৩ এর শোয়ের পর পরিচালক জানিয়েছেন এই নাট্য মঞ্চেও অভিনীত হবে। বড় স্পেসের বিজ্ঞানকে কী ভাবে এই প্রযোজনা মানিয়ে নেয় তা দেখবার। বড় মঞ্চে দর্শক সংখ্যা বাড়বে ঠিকই, কিন্তু গল্প বলা ততটা বৈঠকী ও নিবিড় হবে কি?
ভারতবর্ষে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন 'এমার্জেন্সি' র সময়ের প্রতিফলন। ২০২২ এর জুন মাসে 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে মোদীজি ভারতবাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, কী কঠিন সময় ছিল ‘এমার্জেন্সি’। ১ বলেছিলেন, রেডিওয় কিশোর কুমারের কন্ঠ রোধ করার খবর। এই প্রসঙ্গ মন্ত্রীর বেশ প্রিয়। এর আগে ২০১৮ র ২৩ শে জুন এই একই তথ্য উনি পরিবেশন করেন একটি অনুষ্ঠানে।২ সত্যিই, দেশে কী দুর্দিনই না ছিল! সবাই জানেন, হালে আজাদির অমৃত মোচ্ছবে, ব্যান হয়েছে বিবিসির ডকু। কেনেডি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টসে বীর দাস প্রথম ভারতীয় হিসাবে পারফর্ম করার পর, দেশে তার জন্য অপেক্ষা করেছে একের পর এক এফ আই আর। এরকম স্বর আটকানোর ঘটনা নতুন নয়। সেকালে, কংগ্রেসী নিষেধাজ্ঞায় রেডিওয় কিশোর কুমারের গান সম্প্রচার করা বন্ধ হয় তো বটেই, এমনকি কিশোর কন্ঠীদেরও কপাল পোড়ে। তাদের হেনস্থা সহ্য করতে হয়, মাচায় কংগ্রেসী গুন্ডাদের খপ্পরে পড়ে। তবু, আজও এরকম হাজার কিশোর কন্ঠী পাওয়া যাবে। তারা টিকে গেছে। আর কিশোর কুমার? বলাই বাহুল্য, কিশোর কুমার আজও বিয়ে বাড়ি থেকে পুজো প্যান্ডেলে বাজেন। মায়ে রবীন্দ্র জয়ন্তীতেও কিশোর কুমারের রবীন্দ্র সঙ্গীত অনেক বেশি হিট। এদিকে কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার লক্ষ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিজেপি সরকার। এমতবস্থায় ভাবাই যায় না, এরকম দাপটও ছিল কংগ্রেসের। আমাদের মতো নাইনটিজ বাচ্চাদের কাছে এসব অকল্পনীয়। তাই মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রী এই সব মনে করান। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের সেই ঘোর ঘোটালায়। কারণ আমাদের বর্তমানটা স্থবির। 'পোষা ভেড়ার মতো ভূতের খোঁটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যা'ও করে না, ম্যা’ও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে, যেন একেবারে চিরকালের মতো মাটি।'(‘কর্তার ভূত’,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমরা শুকিয়ে গেছি। রাগ-আবেগ-কান্না হারিয়ে গেছে। সেই হারানো কান্নাকে মনে করতে, 'ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনি'র সক্কলে মোদীজির সেই কিশোর কুমারের বক্তৃতাটা আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। নিজস্ব স্টাইলে। তাই নাট্য থেকে যে প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তা অতীতের না, ঠিক আজকের মতো - ভয়ঙ্কর।
কর্তৃত্ববাদ যে ভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বাড়ির কর্তার মধ্যে ঢুকে আছে, তা অস্বীকার করা যায় না কোন ভাবেই। কর্তৃত্ববাদে নারী পুরুষ বিভেদ নেই। ইন্দিরা কিম্বা নরেন কিম্বা মমতা কিম্বা বুদ্ধ কিম্বা পাড়ার হরেন কাকু কিম্বা নূপুর কাকিমা - যে-কোনো কেউই ‘অথরিটি’ হয়ে পড়লে বিপজ্জনক। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবন সর্বত্র এই সত্যের অলঙ্ঘনীয় অবস্থান নাট্যের বাবা, ১০১ বাবু চরিত্রগুলির মধ্যে উপস্থিত। ব্যক্তিগত সম্পর্কে ও সামজিক সম্পর্কে আগ্রাসনের একাধিক ঘটনা প্লটকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। উল্টোদিকে আলোয় উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার নাট্যবস্তুর সাথে কন্ট্রাস্ট তৈরি করে। আগ্রাসনের বাই প্রোডাক্ট হিসাবে দেখা দিয়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেগের অসাড়তা। তাকেই বহন করে 'ফেলে আসা মেগাহার্টজ'। সেট ও প্রপের মধ্যে শব্দ বিহীন চোঙাটি, হ্যালোজেন আলোটি, ভাঙা সুইচ বোর্ডটি কিম্বা জোড়া দেওয়া রেডিওটি আসলে জড় নয়। জ্যান্ত। আমাদেরই মতো অসাড়। নাট্যের দৃশ্যে মশারির তলায় তাই মড়ারা ঘুমাচ্ছে। আমরা প্রত্যেকে জীবন্মৃত। আমাদের গা মাপলে উষ্ণতা পাওয়া যাবে। কিন্তু সে উত্তাপ ঝড়ের আগের মতো গুমোট। ভ্যাপসা। তাতে বৃষ্টি ঝরুক। 'এ জীবনে সবই যে হারায়' - তা জেনেও আবার রেডিও বেজে উঠুক।
...........................
উল্লেখসূত্র :
১। https://www.pmindia.gov.in/en/news_updates/pms-address-in-the-90th-episode-of-mann-ki-baat/
২।https://timesofindia.indiatimes.com/videos/news/emergency-kishore-kumar-was-banned-by-congress-says-pm-modi/videoshow/64752292.cms
..................
[ছবি : সন্দীপ কুমার]
#Play Review #নাট্য সমালোচনা #ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনি #ফেলে আসা মেগাহার্টজ #silly পয়েন্ট